প্রতারণার মাধ্যমে উত্তরা মোটরস মিনিবাসের নামে ট্রাকের চেসিস বিক্রি করছে
প্রকাশিত হয়েছে : ২৫ অক্টোবর ২০১৪, ৬:০৪ পূর্বাহ্ণ
অর্থ-বাণিজ্য ডেস্ক ::
ট্রাকের চেসিস মিনিবাস নামে আমদানি করছে উত্তরা মোটরস লিমিটেড। মিনিবাসের চেসিস নামে ক্রেতাদের কাছে তা বিক্রিও করছে প্রতিষ্ঠানটি। এর মাধ্যমে একদিকে শুল্ক ফাঁকির ঘটনা ঘটছে, অন্যদিকে প্রতারিত হচ্ছেন ক্রেতা। প্রতারণার অভিযোগে গাড়ি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে সম্প্রতি মামলাও হয়েছে।
এদিকে বিক্রীত গাড়ির নিবন্ধনও করানো হচ্ছে অর্থ লগ্নিকারী সহযোগী প্রতিষ্ঠান উত্তরা ফিন্যান্স লিমিটেডের নামে, যা মোটরযান আইনের পরিপন্থী। ফলে ঋণের কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হলে নানা হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে গ্রাহককে।
জানা যায়, ২০১২ সালে উত্তরা মোটরস থেকে ইসুজুর তিনটি মিনিবাসের (মডেল এনপিআর-৬৬পি) চেসিস কেনার জন্য চুক্তিবদ্ধ হন চট্টগ্রামের সৈয়দ মুহাম্মদ আবু ইছা। ২০১২ সালের ২৮ জুলাই এগুলো সরবরাহ করে উত্তরা মোটরস। তিনটি চেসিসের দাম ধরা হয় ৬৩ লাখ টাকা। ডাউন পেমেন্ট হিসেবে উত্তরা মোটরসে তিনি পরিশোধ করেন ১৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা। বাকি টাকা উত্তরা ফিন্যান্স ঋণ হিসেবে প্রদান করে। তবে গাড়ি তিনটি নিবন্ধন করা হয়েছে উত্তরা ফিন্যান্সের নামে। ২০১২ সালের ২২ অক্টোবর চট্টগ্রাম থেকে বাস তিনটির নিবন্ধন দেয়া হয়, যেগুলোর নম্বর যথাক্রমে চট্ট মেট্রো-জ-১১-১৫৪৩, চট্ট মেট্রো-জ-১১-১৫৪৪ ও চট্ট মেট্রো-জ-১১-১৫৪৫।
নিবন্ধনের আনুষঙ্গিক নথিপত্রে ছয় সিলিন্ডার উল্লেখ করা হলেও প্রকৃতপক্ষে চেসিসগুলো চার সিলিন্ডারের। সাধারণত ইসুজুর হালকা ট্রাকের চেসিস চার সিলিন্ডারের হয়। এছাড়া এনপিআর-৬৬পি মডেলটিও ট্রাকের চেসিস।
সূত্র জানায়, বডি তৈরি করে গাড়িগুলো ২০১২ সালের শেষ দিকে চট্টগ্রামের বিভিন্ন রুটে চলাচল শুরু করলে ঘন ঘন ত্রুটি ধরা পড়ে। তিন মাস অন্তর একবার প্রতিটি বাসের পাম্প পাল্টাতে হয়। ওয়ারেন্টি থাকায় এক বছর বাসগুলো মেরামত করে দেয় উত্তরা মোটরস। তবে ওয়ারেন্টির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর সাধারণ ওয়ার্কশপে মেরামত করানোর সময় এসব বাসে ট্রাকের চেসিস দেয়ার বিষয়টি ধরা পড়ে। পরে প্রতারণার অভিযোগে উত্তরা মোটরস ও উত্তরা ফিন্যান্সের বিরুদ্ধে মামলা করেন সৈয়দ মুহাম্মদ আবু ইছা।
এ বিষয়ে সৈয়দ মুহাম্মদ আবু ইছা জানান, ‘বাসের নামে আমার কাছে ট্রাকের চেসিস বিক্রি করা হয়েছে। ইসুজু মোটরসের সঙ্গে ই-মেইলে যোগাযোগ করে বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছি আমি।’
তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করেন উত্তরা মোটরসের জ্যেষ্ঠ মহাব্যবস্থাপক কাজী মতিউর রহমান। যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, বাসের নামে ট্রাকের চেসিস বিক্রি করার অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট। উত্তরা মোটরস ৪০ বছর ধরে সুনামের সঙ্গে ব্যবসা করে আসছে। বাংলাদেশে উত্তরা মোটরসই ইসুজুর একমাত্র বিক্রয় প্রতিনিধি। চেসিসগুলোর সিলিন্ডার-সংক্রান্ত যে তথ্য গাড়ির নিবন্ধনে দেয়া হয়েছে, সেটা ভুলবশত। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) ভুলবশত এটা করেছে। এরই মধ্যে বিআরটিএকে বিষয়টি জানানো হয়েছে।
একই ধরনের বক্তব্য দেন উত্তরা মোটরসের হেড অব লজিস্টিকস মাকসুম আজিমও। তিনি প্রতিষ্ঠানটির আমদানি প্রক্রিয়া দেখাশোনা করেন।
তবে বিআরটিএকে এজন্য দায়ী করার সুযোগ নেই বলে দাবি করেন সংস্থাটির উপপরিচালক (প্রকৌশল) শিতাংশু শেখর বিশ্বাস। তিনি বলেন, সাধারণত গ্রাহকের জমা দেয়া ডকুমেন্টের ভিত্তিতে গাড়ির নিবন্ধন দেয়া হয়। এক্ষেত্রে ভুল হলে সঙ্গে সঙ্গে বিআরটিএতে আবেদন করতে হয়।
তিনি আরো বলেন, বাসের চেসিসের শুল্ক কম ও ট্রাকে বেশি। তাই শুল্ক ফাঁকি দেয়ার জন্য এ ধরনের কাজ যে কোনো প্রতিষ্ঠানই করতে পারে। ফলে এর দায়দায়িত্ব আমদানিকারককেই নিতে হবে।
ইসুজু মোটরসের ওয়েবসাইটে দেখা গেছে, ইসুজু এনপিআর-৬৬পি মডেলের বাসের কোনো চেসিস প্রতিষ্ঠানটির নেই। ‘এন’ সিরিজের অধীনে এনপিআর ও এনকেআর মডেলটি প্রতিষ্ঠানটির শুধু ট্রাক ও পিকআপের চেসিসের। ‘এন’ সিরিজের এসব ট্রাক ও পিকআপ চেসিস ফিলিপাইনসহ বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে উত্পাদন করে ইসুজু মোটরস।
জানা গেছে, উত্তরা মোটরস এরই মধ্যে ২ হাজার ৫০০ থেকে ৩ হাজার ইসুজু এনপিআর-৬৬পি মডেলের মিনিবাস দেশের বাজারে বিক্রি করেছে। এগুলোর বেশ কয়েকটির ক্ষেত্রে প্রতারণার অভিযোগ উঠেছে। এক্ষেত্রে গাড়ির মালিকানা বা নিবন্ধন ক্রেতার নামে না হওয়ায় কেউ আইনি পদক্ষেপ নিতে পারছেন না।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, ক্রয়কৃত এসব মিনিবাসের সামনের (চালকের) অংশটি ট্রাক ও পিকআপের মতো ফোল্ডিং করার ব্যবস্থা আছে। বাসের ক্ষেত্রে ফোল্ডিং সিস্টেম থাকার কথা নয়। এছাড়া সরাসরি ইসুজু জাপান থেকে আমদানির কথা থাকলেও চেসিসের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ ভিন্ন ভিন্ন ব্র্যান্ডের।
উত্তরা মোটরসের কাছ থেকে এনপিআর-৬৬পি মডেলের পাঁচটি মিনিবাস কিনে প্রতারিত হয়েছে চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার মেসার্স জয়নাল ফুড প্রোডাক্টস। প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী মো. জয়নাল আবেদীন অভিযোগ করেন, উত্তরা মোটরস এনপিআর ও এনকেআর মডেলের ট্রাক-পিকআপের চেসিস বাসের চেসিস বলে বিক্রি করেছে। এছাড়া সম্পূর্ণ নতুন ব্র্যান্ডের বাস চেসিসের ঘোষণা দেয়া হলেও চাকাসহ বেশ কিছু পার্টস দেশি প্রতিষ্ঠান থেকে সংগ্রহ করে ক্রেতাদের সরবরাহ করা হয়েছে। এর মাধ্যমে রাজস্ব ফাঁকির পাশাপাশি ক্রেতাদের ঠকানো হয়েছে।
বিআরটিএর তথ্যমতে, মোটরযান অধ্যাদেশ ১৯৮৩-এর ধারা-৪১ ও মোটরযান বিধি ১৯৪০-এর ধারা-৬৫ মোতাবেক বিভিন্ন ব্যাংক বা লিজিং কিংবা অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠান কর্তৃক কিস্তি বা বন্ধকে বিক্রীত মোটরযানের নিবন্ধন যৌথ নামে করা বাধ্যতামূলক। কিন্তু তা মানছে না উত্তরা মোটরস ও উত্তরা ফিন্যান্স।
সৈয়দ মুহাম্মদ আবু ইছার কেনা গাড়িগুলোর নিবন্ধনও করা হয় উত্তরা ফিন্যান্সের নামে। ২৩ লাখ ১০ হাজার টাকা কিস্তি পরিশোধ করলেও মামলার পর গাড়ি জব্দ করেছে উত্তরা ফিন্যান্স। অথচ ঋণের কিস্তি ঠিকমতো পরিশোধ করা হচ্ছে না এ অভিযোগে আবু ইছার বিরুদ্ধে পাল্টা মামলার প্রস্তুতিও নিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।
এ প্রসঙ্গে উত্তরা ফিন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টস লিমিটেডের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ও চিফ ফিন্যান্সিয়াল অফিসার (সিএফও) উত্তম কুমার সাহা বলেন, আবু ইছা ঠিকমতো ঋণের কিস্তি পরিশোধ করছিলেন না। তাই গাড়ি জব্দ করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে চেক ডিসঅনারের মামলাও করা হবে। আর বাসের নামে ট্রাকের চেসিস লাগানোর অভিযোগটি সম্পূর্ণ মিথ্যা। এরই মধ্যে মামলা খারিজ হয়ে গেছে।
তবে মামলা খারিজ হওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেন চট্টগ্রামের বাকলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মহসিন। তিনি বলেন, ‘উত্তরা মোটরসের বিষয়ে মামলা নিয়ে আমরা এরই মধ্যে তদন্তে নেমেছি। একজন তদন্তকারী কর্মকর্তাও (আইও) নিয়োগ করা হয়েছে। আমরা উভয় পক্ষের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহ করছি। বর্তমানে আইও ছুটিতে থাকায় তদন্ত কিছুটা বিলম্ব হচ্ছে।’