নষ্ট হচ্ছে কোটি কোটি টাকার ‘গলানো সোনা’
প্রকাশিত হয়েছে : ২৪ আগস্ট ২০২২, ৫:৩৯ অপরাহ্ণ
ওমর ফারুক নাঈম, শ্রীমঙ্গল থেকে::
সিলেটের চা কে ‘গলানো সোনা’র সাথেই তুলনা করা হয় তবে শ্রমিক আন্দোলনে স্থবির হয়ে পড়েছে দেশের অর্থকরী ফসলের খাতটি। উৎপাদন মুখর হওয়ার পরিবর্তে চা কারখানাতে এখন শুনসান নিরবতা
দেশের গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী ফসল চা। আর এই চা শিল্পের অন্যতম অঞ্চল সিলেট। পরিকল্পিত চাষ ও অনুকূল আবহাওয়ার কারণে বিগত বছরে সিলেটে রেকর্ড সংখ্যক চা উৎপাদন করা সম্ভব হয়েছে। তবে এবার ভরা মৌসুমে শ্রমিক আন্দোলনের ফলে শতকোটি টাকা ক্ষতির সম্মুখীন সংশ্লিষ্টরা। দফায় দফায় বৈঠকের পরও শ্রমিকরা তাদের সিদ্ধান্তে এখনো অনড়।
বাগান কর্তৃপক্ষ জানায়, একটি গাছ থেকে একবার কচি পাতা তোলার পরবর্তী সাত থেকে নয়দিন ওই গাছ থেকে আর পাতা তোলা হয় না। তখন সেখানে নতুন কুঁড়ি ও পাতা আসে। নতুন পাতা আসার তিনদিনের মধ্যেই তা তুলতে হয়। একবার পাতা তোলাকে বলা হয় ‘এক রাউন্ড’। পাতা বড় হয়ে গেলে গুণগত মান ভাল থাকে না। বড় পাতা অনেক সময় বাগান কর্তৃপক্ষ আর তোলেন না। কারণ, এতে তাদের উৎপাদন খরচও আসে না।
শ্রমিকরা জানান, তারা দৈনিক ১২০ টাকা মজুরি তখনি পান যখন বাগান নির্ধারিত দৈনিক ন্যূনতম ২৪ কেজি পাতা সংগ্রহ করতে পারেন। ২৪ কেজির নিচে হলে মজুরিও অনুপাতে কম আসে।
তবে সাধারণত ভরা মৌসুমে একজন শ্রমিক ৫০ কেজি পর্যন্ত পাতা তুলতে পারেন। কারণ, গাছে তখন কচি পাতা বেশি থাকে। দুহাত ভরে পাতা আসে। এ সময় আয়ও তাদের বেশি হয়।
২৪ কেজির পরবর্তী প্রতি কেজিতে বাগানভেদে শ্রমিকরা চার থেকে পাঁচ টাকা করে পান বলে জানায় বাগান কর্তৃপক্ষ।
নভেম্বর থেকে ডিসেম্বর-জানুয়ারি পাতায় ভাটা থাকে। গাছে কচি পাতার পরিমাণ থাকে অনেক কম। শ্রমিকরা এ সময় দৈনিক বড়জোর ১৪-১৫ কেজি পর্যন্ত পাতা সংগ্রহ করতে পারেন। ফলে এই সময়ে শ্রমিক দৈনিক মজুরি ১২০ টাকাও তুলতে পারেন না।
ভরা মৌসুমের একটু বাড়তি আয়ই ভাটার সময়ে ‘সম্বল’ হিসেবে কাজ করে শ্রমিকের। জানুয়ারি থেকে মে’র শুরু পর্যন্ত শ্রমিকরা বাগানের অন্যান্য কাজে যোগ দেন। এই অগাস্টের মাঝামাঝিতে এসে বাগানের পাতা গাছেই বড় হচ্ছে। তোলার কেউ নেই।
দৈনিক মজুরি ১২০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা করার দাবিতে ভরা মৌসুমে চা শ্রমিকরা ধর্মঘটে যাওয়ায় কচি পাতা তোলা নিয়ে শঙ্কার মধ্যে পড়েছে বাগান কর্তৃপক্ষ। চায়ের পাতা সংগ্রহের ভরা মৌসুম বলা হয়ে থাকে। এ সময় শ্রমিকরা বাগান নির্ধারিত পরিমাণের চেয়ে বেশি পাতা তোলতে পারেন। ফলে তাদের মজুরিও বেশি আসে।
এই সময়ে কাজে যোগ না দিয়ে দৈনিক মজুরিভিত্তিক চা শ্রমিকরা যেমন বেতন থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন ঠিক তেমনি পাতা বড় হয়ে গেলে চায়ের গুণগত মান বজায় থাকে না বিধায় মালিকও ক্ষতির শিকার হন।
চা শ্রমিক ইউনিয়নের সহ-সভাপতি জেসমিন আক্তার বলেন, প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠকের পর সিদ্ধান্ত হয়েছে চা শ্রমিকরা আগের ১২০ টাকা মজুরিতে কাজ শুরু করবে। আসছে দুর্গাপূজার আগে প্রধানমন্ত্রী ন্যায্য মজুরি ঘোষণা করবেন। চা-শ্রমিক ইউনিয়ন প্রধানমন্ত্রীর প্রতি শ্রদ্ধা রেখে তাদের কাজে যোগদান করতে বলেছে। কিন্তু তাদের কথা হলো, চা-শ্রমিক ইউনিয়ন এই কথা ঘোষণা দেবে কেন? তারা এও বলছেন, আমরা তো প্রধানমন্ত্রীর মুখ থেকে শুনিনি। প্রধানমন্ত্রী যা নির্ধারণ করে দেবেন, আমরা মেনে নেব। কিন্তু চা শ্রমিক ইউনিয়নের নেতাদের কথা শুনব না।
তিনি আরও বলেন, শ্রমিকরা আমাদের কোনো কথাই শুনছে না। এমনকি ইউএনও, ওসি, ডিসির কথাও শুনছে না। একমাত্র উপায় প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি হস্তক্ষেপ, এছাড়া এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়।
বাগান বাগানে প্রশাসনের কর্মকর্তারা কর্মবিরতি প্রত্যাহার করে কাজে ফেরার আহ্বান জানালেও শ্রমিকদের ভাষ্য হচ্ছে, নিজের ক্ষতি জেনেও তারা অধিকার আদায়ের জন্যই ধর্মঘটে যেতে বাধ্য হয়েছেন। এ ছাড়া তাদের আর কোনো পথ নেই।
চা সংসদ সূত্রে জানা যায়, চলমান ধর্মঘটের কারণে দেশের চা বাগানগুলোর দৈনিক ১৫ কোটি টাকা করে ক্ষতি হচ্ছে। এ পর্যন্ত অন্তত ৮০ কোটি টাকার বেশি চা নষ্ট হয়ে গেছে। অন্যদিকে সংকট সমাধান হয়ে নতুন করে শুরু করা হলে অন্তত দেড় মাস চা উৎপাদন শূন্যের কোটায় নেমে আসবে। প্রায় এক সপ্তাহের বেশি চা প্লাগিং না হওয়ায় এসব পাতা কেটে ফেলে দিতে হবে। কিছু ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ চা গাছই কেটে ফেলতে হবে। সব মিলিয়ে চলমান শ্রমিক অসন্তোষ চা খাতের ৫০০ কোটি টাকারও বেশি ক্ষতি করবে বলে মনে করছেন তারা।
বাংলাদেশ টি অ্যাসোসিয়েশন সিলেট শাখার চেয়ারম্যান জিএম শিবলী পূর্বদিককে বলেন, এখন পাতা তোলার ভরা মৌসুম। এখন যদি কচি পাতা সংগ্রহ না করা যায় তাহলে বছরের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে না। যেসব পাতা উঠানো হয়েছে শ্রমিকরা কাজ না করায় সেসব পাতা বাগানের সেকশনে সেকশনে নষ্ট হচ্ছে। এতে বাগান কর্তৃপক্ষ ক্ষতির মুখে পড়বে।
গবেষকরা বলছেন, সব সংকট কাটিয়ে চা বাণিজ্যে মনোনিবেশ করতে পারলে চা হতো দেশের অন্যতম রপ্তানি পণ্য।
চা বোর্ড সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে বিভিন্ন কার্যকরী পদক্ষেপের কারণে চা শিল্পের ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে চা উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৩১.৩৮ মিলিয়ন কেজি। ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দে ৮৫.০৫ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদন হয়, ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে ৮২.১২ মিলিয়ন কেজি এবং ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে রেকর্ড পরিমাণ ৯৬.০৭ কেজি এবং ২০২০ খ্রিষ্টাব্দে ৮৬.৩৯ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদন হয়। এছাড়া ২০২০ খ্রিষ্টাব্দে রেকর্ড পরিমাণ ২.১৭ মিলিয়ন কেজি চা রপ্তানি হয়। এই ধারা অব্যাহত থাকলে আগামীতে চা আমদানির প্রয়োজন হবে না বরং রপ্তানির ক্ষেত্র সম্প্রসারিত হবে।
বাংলাদেশ চা বোর্ডের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মো: আশরাফুল ইসলাম পূর্বদিককে বলেন, বিভিন্ন তথ্য অনুযায়ী আনুমানিক প্রতিদিন গড়ে ২০ কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। এই ভরা মৌসুমেও দীর্ঘ সময় চা বাগান বন্ধ থাকায় বড় ধরণের সংকটে পড়েছে। এবছর আমরা লক্ষ্যমাত্রা ধরেছি ১০০ মিলিয়ন কেজি। আমরা আশা করছি এই বছর এটি অর্জষ করতে পারবো। তবে এই সংকটের সমাধান না হলে কিন্তু উৎপাদনেও প্রভাব পরবে।
মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসান বলেন, আমরা রবিবার রাতে শ্রমিকনেতাদের সঙ্গে কথা বলে একটা সুন্দর সমাধান করেছিলাম। শ্রমিকেরা প্রধানমন্ত্রীর কথা শুনতে চাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী কয়েক দিনের ভেতরে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে তাঁদের সঙ্গে কথা বলে ন্যায্য মজুরি নির্ধারণ করবেন বলে আশ্বস্ত করেছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, শ্রমিকেরা চা–বাগানকে ভালোবেসে কাজে ফিরুক। তাঁদের সব দাবি বিবেচনা করে মানা হবে। আজ সকাল থেকে জেলার অনেক চা–বাগানে কাজ শুরু হয়েছে। শ্রীমঙ্গলেও চা–শ্রমিকেরা কাজ করতে চাচ্ছেন, কিন্তু কিছু দুষ্কৃতকারী তাঁদের যেতে বাধা দিচ্ছে। শ্রমিকদের উসকাচ্ছে। আমরা সাধারণ শ্রমিকদের কাজে যেতে অনুরোধ করছি, তাঁদের নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব আমাদের।
উল্লেখ্য, দেশের ১৬৭ চা বাগানে শ্রমিকের সংখ্যা দেড় লাখেরও বেশি। বর্তমানে দৈনিক মজুরি ১২০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০০ টাকা করার দাবিতে আন্দোলন করছেন তারা। গত ৯ আগস্ট এ আন্দোলন শুরু হয়। শুরুতে প্রথম কয়েকদিন কেবল ২ ঘণ্টা করে কর্মবিরতি পালন করা হয়। সে সময় মজুরি বৃদ্ধি ও মজুরি চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে শ্রমিক ইউনিয়নগুলোর পক্ষ থেকে বাগান মালিকদের সাতদিনের আলটিমেটাম দেয়া হয়। কিন্তু মালিক পক্ষ এ সময়ের মধ্যে বৈঠক বা সমঝোতায় না আসায় ১৩ আগস্ট থেকে লাগাতার পূর্ণ দিবস কর্মবিরতি পালন শুরু করেন শ্রমিকরা। দফায় দফায় বৈঠক করেও এখন পর্যন্ত কোনো সঠিক সমাধানে যায়নি এই সংকট।