শ্রীমঙ্গলে ‘ওয়ানগালা’ উৎসবে মেতে উঠলেন গারোরা
প্রকাশিত হয়েছে : ২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৫:১১ অপরাহ্ণ
নিজস্ব প্রতিবেদক::
মৌলভীবাজারের শ্রীমেঙ্গলে পালিত হয়েছে গারো সম্প্রদায়দের ওয়ানগালা নবান্ন উৎসব। গারো জাতিগোষ্ঠীর বিশ্বাস, ‘মিশি সালজং’ বা শস্যদেবতার ওপর ভরসা রাখলে ফসলের ভালো ফলন হয়। দেবতাকে নতুন ফসলের জন্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে এবং নতুন ফসল খাওয়ার অনুমতি চেয়ে তারা পালন করেন এই উৎসব। এই উৎসবের মূল উদ্দেশ্য আগামী বছরে যেন ফসল ভালো হয়। তাদের সন্তান ও পরিবার-পরিজনরা যেন ভালো থাকে।
নৃ-গোষ্ঠি গারোদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক ও কৃষ্টির অন্যতম উৎসব হলো নবান্ন বা ওয়ানগালা উৎসব। নানা আয়োজনে শ্রীমঙ্গলের ফুলছড়া চা বাগান মাঠে সকাল থেকে নানা আয়োজনের মধ্যদিয়ে ওয়ানগালা অনুষ্ঠানের সূচনা করা হয়। ওয়ানগালা উদযাপন পরিষদ এর আয়োজনে গারো সম্প্রদায়ের দিনব্যাপী এই উৎসবে আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হয়। এসময় গারো জনগোষ্ঠী তাদের নতুন ফসল সৃষ্টি কর্তার নামে উতসর্গ করেন।
ওয়ানগালা উপলক্ষে আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন শ্রীমঙ্গল উপজেলার নবাগত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইসলাম উদ্দিন, বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন সহকারী কমিশনার (ভূমি) সালাউদ্দিন বিশ্বাস, জাতীয় নাগরিক কমিটির কেন্দ্রীয় সদস্য প্রীতম দাস প্রমুখ।
উৎসবের প্রথম পর্বে ক্রুশচত্বরে বাণী পাঠ, খামালকে খুথুব ও থক্কা প্রদান, জনগণকে থক্কা দেয়া, পবিত্র খ্রীষ্টযাগ, দান সংগ্রহ, আলোচনা সভা ও জাতির মঙ্গল কামনা করে বিশেষ প্রার্থনা করা হয়। মূলত এ অনুষ্ঠানটি গারোদের হলেও খৃষ্ঠান ধর্মাবলম্বীরা সেখানে উপস্থিত থেকে অনুষ্ঠানাদি পরিচালনা করেন।
অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বে তাদের পুরোহিত জংসন ম্রি (খামাল) মোরগ কেটে এর ভিতরের খাদ্য নালি দেখে আগামী বছর কেমন যাবে এর ভবিষৎবাণী করেন। পুরহিত মোরগের খাদ্যনালী দেখে বলেন, দেশ একটি দু:সময় কাটিয়ে ভালো দিকে এগুচ্ছে। এ বছর দেশে শস্য উৎপাদন ভালো হবে। মানুষের মেলবন্ধন সুদৃঢ় হবে। স্বামী-স্ত্রীর সু-সর্ম্পক গভীর হবে এতে সংসার জীবনে উন্নতি আসবে বলে জানান।
গারোদের মূল ধর্ম ছিল সাংসারেক এখন খৃষ্ঠানদের সাথে মিশে গেছে। ‘ওয়ানা’ শব্দের অর্থ দেবদেবীর দানের দ্রব্যসামগ্রী আর ‘গালা’ অর্থ উৎসর্গ করা। দেবদেবীর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ও মনোবাসনার নানা নিবেদন হয় এ উৎসবে। সাধারণত বর্ষার শেষে ও শীতের আগে, নতুন ফসল তোলার পর এ উৎসবের আয়োজন করা হয়। এর আগে নতুন খাদ্যশস্য খাওয়া নিষেধ থাকে এ সম্প্রদায়ের জন্য। তাই অনেকেই একে নবান্ন বা ধন্যবাদের উৎসবও বলে থাকেন।
ধর্মীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানাদি ছাড়াও আয়োজন করা হয় তাদের ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও আলোচনা সভা। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গারো কিশোরীরা তাদের ঐতিহ্যবাহী গান ‘ওয়ানগালা ওয়ানগালা’ গানের সাথে নৃত্য করে। এছাড়াও বিভিন্ন গারো লাইন থেকে আসা কিশোরীরা একেরপর এক নৃত্য পরিবেশন করে।
ফুলছড়া চা বাগান মাঠে ওয়ানগালাটি মিলন মেলায় পরিণত হয়। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও ভাল ফসল লাভের আশায় পালন করা হয় এই ওয়ানগালা। উৎসবকে নিয়ে ছিল নানা বর্ণিল আয়োজন। তিনদিনব্যাপী আনুষ্ঠানিকতা থাকলেও তা নানা কারনে এখন দুদিনেই পালিত হয়।
মূলত গারোরা ছিল প্রকৃতিপূজারী কিন্তু কালের পরিক্রমায় গারোরা ধীরে ধীরে খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার পর তাদের ঐতিহ্যবাহী সামাজিক প্রথাটি এখন ধর্মীয় ও সামাজিকভাবে একত্রে পালন করা হয়। এক সময় তারা তাদের শস্য দেবতা মিসি সালজংকে উৎসর্গ করে ‘ওয়ানগালা’ পালন করলেও এখন তারা নতুন ফসল কেটে যিশু খ্রিস্ট বা ঈশ্বরকে উৎসর্গ করে ‘ওয়ানগালা’ পালন করে থাকেন।