মৌলভীবাজারের আওয়ামীলীগ নেতাদের ‘গা ঢাকা’, কোথায় আছেন, কেমন আছেন?
প্রকাশিত হয়েছে : ১৭ অক্টোবর ২০২৪, ৭:৫৯ অপরাহ্ণ
নিজস্ব প্রতিবেদক::
গণঅভ্যুত্থান ও শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর এখন গ্রেফতার আতঙ্কে দিন কাটছে মৌলভীবাজারের আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও অঙ্গসংগঠনের নেতৃবৃন্দ। বিভিন্ন সূত্র জানায়, অন্তত কয়েকজন নেতাকর্মী সিলেট, জুড়ী ও কমলগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে ভারতে পাড়ি দিয়েছেন। পালিয়ে যাওয়ারা ভারতের গৌহাটি, শিলং, ডাউকি, জোয়াইসহ কয়েকটি এলাকায় বসবাস করছেন বলে একাধিক সূত্র জানায়। এছাড়া প্রবাসী অধ্যূষিত এলাকা হওয়ায় লন্ডন, আমেরিকা কিংবা কানাডায় অবস্থান করা স্বজনদের কাছে অনেক নেতাই ইতোমধ্যেই চলে গেছেন বলে জানা গেছে। দেশ থেকে পালাতে গিয়ে অনেক নেতা বিমানবন্দরে আটকাও পড়েছেন।
গত ২৯ আগস্ট বৃহস্পতিবার সালেহ আহমদ জুয়েল ও জালাল আহমদ সৌদি আরব যাওয়ার পথে ওসমানী বিমান বন্দরে আটক হন। সালেহ আহমদ সাবেক পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিনের ভাগনা ও ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান। জালাল আহমদ বড়লেখা সদর ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি।
এমসময় জেলা দাপিয়ে বেড়ানো আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা ও সাধারণ কর্মীরাও গ্রেফতার, জনরোষ এড়াতে গা ঢাকা দিয়েছেন। অনেকেই সীমান্ত অতিক্রম করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গরু ও চিনির চোরাই কারবারিদের সঙ্গে অবৈধভাবে বিরাট অঙ্কের দফারফা করে তারা সীমান্ত পাড়ি দেন। মৌলভীবাজার সীমান্তপথ অনেকটা নিরাপদ ভেবে জেলার বাহির থেকেও আওয়ামী লীগ নেতা ও সমর্থকরা এ পথে পাড়ি দিয়েছেন। ইতিমধ্যে মৌলভীবাজার থেকে সাবেক এমপি ও সিটি কাউন্সিলার গ্রেফতারও হয়েছেন।
বিগত আওয়ামী লীগ স্বৈরাচারী সরকারের আমলে মৌলভীবাজার জেলার সর্বত্রই ছিল আওয়ামী নেতাদের দখল। তারা ছিলেন সকল হর্তাকর্তা। জেলার চার দাপুটে নেতা নেছার আহমদ, মিছবাহুর রহমান, ফজলুর রহমান ও কামাল হোসেনের এখন সন্ধান নেই। তারা কোথায় আছেন, কেমন আছেন কেউ জানে না।
মৌলভীবাজারে জেলার চারটি সংসদীয় আসনের এমপি ছিলেন সদ্য সাবেক কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুশ শহীদ, সাবেক পরিবেশ মন্ত্রী মো শাহাব উদ্দিন, ডাকসুর সাবেক ভিপি সুলতান মনসুর, আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নেছার আহমদ, সদ্য সাবেক এমপি মোহাম্মদ জিল্লুর রহমান, প্রয়াত সমাজকল্যাল মন্ত্রীর সহধর্মীনী সৈয়দা সায়রা মহসীন, সৈয়দা জোহরা আলাউদ্দিন। এদের মধ্যে শুধু মাত্র সুলতান মনসুরছাড়া আর কেউই গ্রেফতার হননি। দুই নারী নেত্রী সায়রা মহসীন ও সৈয়দা জোহরা আলাউদ্দিন ছাড়া সবাই নাশকতা ও সহিংসতা মামলার আসামী।
সংসদ সদস্য ছাড়াও মৌলভীবাজার জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মিছবাহুর রহমান, পৌরসভার মেয়র ছিলেন আওয়ামীলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মিছবাহুর রহমান, সদর উপজেলার চেয়ারম্যান ছিলেন মো. কামাল হোসেন। এছাড়াও বড়লেখা পৌরসভার মেয়র ও উপজেলার চেয়ারম্যান, জুড়ী উপজেলা চেয়ারম্যান, কুলাউড়া পৌরসভার মেয়র, কমলগঞ্জ পৌরসভার মেয়র ও উপজেলা চেয়ারম্যান এবং শ্রীমঙ্গল উপজেলার চেয়ারম্যান ছিলেন স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার মনোনীত ব্যক্তিরাই। এদের কেউই এখনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক হননি।
সরকার পতনের পর থেকে জেলার বিভিন্ন থানা ও আদালতে বিশটিরও বেশি মামলা হয়েছে। প্রতিনিয়ত আদালত ও থানায় মামলা করছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও বিএনপি-ছাত্রদলের নেতারা। এসব মামলায় সাবেক সরকারে মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, পুলিশ কর্মকর্তা, স্থানীয় আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা ও কর্মী এবং আওয়ামী লীগকে মদদ দেয়া ব্যবসায়ী ও সাংবাদিকদের আসামি করা হচ্ছে। তবে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে কোন হত্যার ঘটনা না ঘটায় কোন হত্যা মামলা হয়নি। সব মিলিয়ে এসব মামলায় আসামি কয়েক হাজার।
পূর্বদিকের অনুসন্ধ্যানে জানা গেছে, মৌলভীবাজার জেলার সাবেক সংসদ সদস্য সবাই দেশে আত্মগোপনে আছেন। কেউ আশ্রয় নিয়েছেন দূরের স্বজনের বাড়ি কিংবা নিরাপদ গোপন স্থানে। বাকি নেতাদের মধ্যে ইতিমধ্যে দেশ ছেড়েছেন ব্রিটিশ নাগরিক হওয়ায় লন্ডনে গিয়েছেন সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মালিক তরফদান ভিপি সুয়েব, আমেরিকায় পড়ি দিয়েছেন যুবলীগের সভাপতি সৈয়দ রেজাউর রহমান সুমন, ছাত্র আন্দোলনের আগ থেকেই লন্ডনে অবস্থান করছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক সাইফুর রহমান বাবুল। তবে মৌলভীবাজার পৌরসভার সাবেক মেয়র মো. ফজলুর রহমান ভারতে ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মো. কামাল হোসেন দেশেই রাজধানীর একটি অভিজাত এলাকায় অবস্থান করছেন বলে বিশ্বস্থ সূত্র নিশ্চিত করেছে।
একমসয় এসব নেতাদের পেছনে সময় দেয়া কর্মীরাও পড়েছেন বিপাকে। কর্মীরা অনেকটা দিশেহারা জীবন যাপন করছেন। কেউ গা ঢাকা দিয়েও থাকতে পারছেন না দীর্ঘকাল। জনসম্মুখে এসে গ্রেফতার হয়েছেন প্রায় ৫০জন কর্মী। তাই বাকি কর্মীরাও বিদেশ যাওয়ার চেষ্টার করছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ছাত্রলীগ কর্মী বলেন, আমরা রাজনীতি করেই গেছি। কোনসময় খিয়াল করিনি, সরকারের পতন হবে। পাসপোর্টটাও বানাইনি, নয়তো বিদেশে চলে যেতাম। এখন আতঙ্কে দিন কাটছে। যে নেতাদের জন্য এত কিছু করলাম তারা এখন কোন খবর রাখেন না। আর জীবনে রাজনীতি না। তবে নেতারা গা ঢাকা দিলে কর্মীরা গোপন স্থান থেকেও তৎপর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
প্রবাসে অবস্থান করা এক আওয়ামীলীগ নেতা বলেন, স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দেয়া এই দলকে ধ্বংস করেছে হাইব্রিড নেতারা। এসব নেতারা মৌলভীবাজারে চাঁদাবাজি, টেণ্ডারবাজি ও জমি দখল নিয়ে ব্যস্ত থাকতো। তারা দলকে সাংগঠনিকবাবে গঠন করতে চাইতেন না। মৌলভীবাজারের চার খলিফাসহ সকল আওয়ামী লীগ নেতাদের এই সরকার গ্রেফতার করে বিচার করা দরকার। আমাদের মতো ত্যাগী নেতাদের তারা কোন মূল্যায়ন করেনি, বরং বঞ্চিত করেছে।