পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উপলক্ষ্যে প্রকাশিত
তায়েফবাসীদের আচরণ ও মহানবী (সা.)-এর দোয়া
প্রকাশিত হয়েছে : ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭:৩০ পূর্বাহ্ণ
তায়েফ সফর ও কঠিন সংকটের মুখোমুখি
আবু তালিবের ইনতিকালের পর রাসূলুল্লাহ (সা) কুরায়শদের পক্ষ থেকে এমন বহুবিধ কষ্ট জুলুম-নির্যাতনের সম্মুখীন হন যা আবু তালিবের জীবদ্দশায় কুরায়শদের সাহসে কুলায়নি। একবার তাঁর মস্তকের ওপর মাটিও নিক্ষেপ করা হয়। তাঁকে কষ্ট ও যন্ত্রণা প্রদানের ধারা যখন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে লাগল এবং কাফির ও মুশরিকদের ইসলামের প্রতি অবজ্ঞা, অপমান ও অসম্মান প্রদর্শনের ফিরিস্তি যখন বৃদ্ধি পেতে থাকল তখন রাসূলুল্লাহ (সা) তায়েফ গমনের ইচ্ছা করলেন। তাঁর ইচ্ছা ছিল তিনি তায়েফের ছাকীফ গোত্রকে ইসলামের দাওয়াত দেবেন এবং এ ব্যাপারে তিনি তাদের সাহায্য চাইবেন। তায়েফবাসীদের নিকট তিনি ভাল কিছু আশা করেছিলেন আর এতে বিশ্বয়েরও কিছু ছিল না। তাঁর এই প্রত্যাশার পেছনে কারণ ছিল আর তা এই যে, দুগ্ধ পানকালীন তিনি বনী সা’দ কবিলায় অতিবাহিত করেছিলেন। এই কবিলার বসতি ছিল তায়েফেরই নিকটবর্তী।
তায়েফের গুরুত্ব
তায়েফ শহর নিজস্ব গুরুত্ব, আবাদীর বিস্তৃতি, স্বাচ্ছন্দ্য ও প্রাচুর্যের দিক দিয়ে মক্কার পর ছিল দ্বিতীয় শহর। কুরআন মজীদে কুরায়শদের যবানীতে একথার দিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে- ‘আর এরা বলে, এই কুরআন কেন অবতীর্ণ হল না দুই জনপদের (মক্কা ও তায়েফ-এর) কোন প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তির ওপর?’ (যুখরুফ: ৩১ আয়াত)।
এই শহর বিখ্যাত প্রতিমা ‘লাত’-এর পূজা-অর্চনারও কেন্দ্র ছিল যেখানে লোকে নিয়মিত তীর্থ দর্শনের জন্য আগমন করত। আর এ ব্যাপারে তায়েফ ছিল মক্কার সমকক্ষ এবং একই আসনে সমাসীন। মক্কা ছিল কুরায়শদের সর্ববৃহৎ প্রতিমা ‘হুবল’-এর পূজা-অর্চনার কেন্দ্র। আমীর-উমারা ও প্রাচুর্যের অধিকারী লোকেরা গ্রীষ্মকাল এখানেই অতিবাহিত করত। মুসলিম আমলে এবং এরপরও তার এই গুরুত্ব অক্ষুণ্ণ ছিল। উমায়্যা কবি ওমর ইবন রবী’আ বলেন:- ‘বিলাসপ্রিয় ও প্রাচুর্যের অধিকারী লোকেরা শীতকাল মক্কায় কাটায় আর গ্রীষ্মকাল অতিবাহিত করে তায়েফে।’
তায়েফের লোকেরা স্থাবর সম্পত্তি ও জায়গা-যমীনের মালিক ছিল। তাদের ছিল বড় বড় বাগ-বাগিচা ও ক্ষেত-খামার। এই সম্পদ ও সুখ-সাচ্ছন্দ্য তাদের ভেতর অহংকার ও অহমিকা সৃষ্টি করে দিয়েছিল আর তারা ছিল কুরআন করীমের এই আয়াতের প্রয়োগস্থল : ‘যখনই আমি কোন জনপদে সতর্ককারী প্রেরণ করেছি ওর বিত্তশালী অধিবাসীরা বলেছে, তোমরা যা-সহ প্রেরিত হয়েছ আমরা তা প্রত্যাখ্যান করি। ওরা আরও বলত, আমরা ধনে-জনে সমৃদ্ধিশালী; সুতরাং আমাদেরকে কিছুতেই শাস্তি দেওয়া হবে না’ (সূরা সাবাঃ ৩৪-৩৫)।
এ সময় আল্লাহ্ তা’আলা পাহাড়সমূহের ফেরেশতাকে তাঁর নিকট পাঠান এবং তিনি তাঁর নিকট তায়েফ যে দু’টো পাহাড়ের মাঝে অবস্থিত সে দু’টোকে একত্রে মিলিয়ে দিয়ে তায়েফবাসীদেরকে পিষে মেরে ফেলার অনুমতি প্রার্থনা করেন। কিন্তু তিনি অনুমতি দিতে অস্বীকার করেন এবং বলেন, আমি আশা করি, তাদের বংশধরদের মধ্যে এমন লোক জন্ম নেবে যারা এক আল্লাহর ইবাদত করবে এবং তাঁর সাথে অপর কাউকে শরীক করবে না।
তায়েফবাসীদের আচরণ ও মহানবী (সা)-এর দোয়া
রাসুলুল্লাহ (সা) যখন তায়েফ গমন করেন তখন তিনি সর্বপ্রথম ছাকীফ নেতৃবৃন্দ ও দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য যান এবং তাদের কাছে ‘দীনে হক’-এর দাওয়াত দেন। কিন্তু তিনি এর খুবই খারাপ ও কড়া জওয়াব পান।
তারা তাঁকে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করল এবং শহরের উচ্ছৃংখল বখাটে যুবক ক্রীতদাসদেরকে তাঁর পেছনে লেলিয়ে দিল। এরা তাঁকে গালি দেয়, হৈ চৈ করে এবং তাঁর প্রতি পাথর নিক্ষেপ করে। এরূপ কষ্টকর ও অসহায় অবস্থায় তিনি আশ্রয় নেবার উদ্দেশ্যে একটি আঙ্গুর বাগানে তশরীফ নেন। তায়েফে তাঁকে যতটা কষ্ট ও যন্ত্রণা দেওয়া হয়েছিল মক্কায় প্রদত্ত কষ্টের তুলনায় তা ছিল অনেক বেশি। তারা রাসুলুল্লাহ (সা)-র গমন পথের দু’পাশে লোক দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। তিনি চলার জন্য পা তুলতেই দু’দিক থেকে পাথর নিক্ষিপ্ত হত। শেষ পর্যন্ত তাঁর পদদ্বয় রক্তাক্ত ও ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যায়। সে সময় তাঁর মুখ থেকে স্বতঃস্ফূর্ত ও অন্তর নিংড়ানো দোয়া বেরিয়ে আসে এবং তিনি আল্লাহ তা’আলার নিকট নিজের দুর্বলতা, নিঃসম্বলতা ও মানুষের চোখে নিকৃষ্টতার ফরিয়াদ জানান এবং আল্লাহর সাহায্য- সহায়তার জন্য নিম্নোক্ত ভাষায় প্রার্থনা জানান। তিনি বলেন:
‘আল্লাহ। তোমার কাছেই আমি ফরিয়াদ জানাই আমার দুর্বলতার, আমার কৌশলহীনতার এবং মানুষের কাছে আমার নিকৃষ্টতার। তুমিই রহমকারীদের মধ্যে সর্বাধিক রহম করনেওয়ালা। অসহায় ও দুর্বলদের প্রভু তো তুমিই আর আমার কৌশলহীনতার এবং মানুষের কাছে আমার নিকৃষ্টতার। তুমিই রহমকারীদের মধ্যে সর্বাধিক রহম করনেওয়ালা। অসহায় ও দুর্বলদের প্রভু তো তুমিই আর আমার প্রতিপালক রবও তুমিই। তুমি কার হতে সোপর্দ করছ আমাকে? অনাত্মীয় রুক্ষ চেহারাওয়ালাদের কাছে অথবা এমন দুশমনদের কাছে ঠেলে দিচ্ছ আমাকে যারা আমার কাজে-কর্মে আমার ওপর কাবু পেয়ে যেতে পারে তার কাছে? তুমি যদি আমার ওপর অসন্তুষ্ট না হয়ে থাক তবে এরও কোন পরওয়া করি না আমি। তবে তোমার পক্ষ থেকে নিরাপত্তা ও আফিয়াতই আমার জন্য অধিক বিস্তৃত। ইয়া আল্লাহ। আমি তোমার সত্তার নূর তথা আলোক-রশ্মির আশ্রয় প্রার্থনা করছি যদ্দারা সমগ্র আঁধার আলোময় হয়ে যায় এবং দীন ও দুনিয়ার সকল কাজ সহীহ-শুদ্ধ হয়ে যায়। তোমার ক্রোধ আমার ওপর আপতিত হোক অথবা তোমার অসন্তুষ্টিই আমার ওপর আপতিত হোক, সর্বাবস্থায় তোমার রেযামন্দী ও সন্তুষ্টিই আমার কাম্য। নেক কাজ করার কিংবা অন্যায় ও পাপ থেকে বেঁচে থাকার শক্তি আমি তোমার কাছ থেকেই পেয়ে থাকি।’
এ সময় আল্লাহ্ তা’আলা পাহাড়সমূহের ফেরেশতাকে তাঁর নিকট পাঠান এবং তিনি তাঁর নিকট তায়েফ যে দু’টো পাহাড়ের মাঝে অবস্থিত সে দু’টোকে একত্রে মিলিয়ে দিয়ে তায়েফবাসীদেরকে পিষে মেরে ফেলার অনুমতি প্রার্থনা করেন। কিন্তু তিনি অনুমতি দিতে অস্বীকার করেন এবং বলেন, আমি আশা করি, তাদের বংশধরদের মধ্যে এমন লোক জন্ম নেবে যারা এক আল্লাহর ইবাদত করবে এবং তাঁর সাথে অপর কাউকে শরীক করবে না।
যখন উতবা ইবন রবী’আ ও শায়বা ইবন রবী’ আর মন রাসূলুল্লাহ (সা)-র এই অবস্থাদৃষ্টে কিছুটা কোমল হল এবং তাদের মানবতার শিরায় কিছুটা কাঁপন সৃষ্টি হল তখন তারা উভয়ে আদ্দাস নামক তাদের এক খৃস্টান ক্রীতদাসকে ডেকে পাঠাল। তারা তাকে বলল লও, এই সব আঙুরের খোশা। একটি তশতরীতে করে ঐ লোকটির কাছে নিয়ে যাও এবং তাকে খেতে বল। আদ্দাস নির্দেশ মাফিক হুকুম তামিল করল এবং রাসুলুল্লাহ (সা)-এর সঙ্গে আলাপ-আলোচনান্তে ও তাঁর মহানুভব চরিত্রদৃষ্টে মুসলমান হয়ে গেল।
রাসূলুল্লাহ (সা) তায়েফ থেকে মক্কায় ফিরে এলেন। তাঁর সম্প্রদায় তখনও তাঁর বিরোধিতায়, শত্রুতায়, ঠাট্টা-বিদ্রূপ ও যন্ত্রণা প্রদানে ছিল তেমনি জোর তৎপর।
সূত্র: নবীয়ে রহমত : সাইয়্যিদ আবুল হাসান আলী নদভী