পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উপলক্ষে প্রকাশিত
হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর ওহি লাভ ও ইসলাম প্রচারের সূচনা
প্রকাশিত হয়েছে : ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৯:৫৩ অপরাহ্ণ
সন্দেহ নাই যে, হানীফ হিসাবে যাহাদের বর্ণনা করা হইয়াছে তাহাদের অধিকাংশই ছিলেন মহানবী- এর সমসাময়িক এবং যাহারা মক্কার অধিবাসী ছিলেন তাহাদের কাহারও সহিত তাঁহার যোগাযোগ ছিল। তাহাদের অনেকেই তাঁহার আত্মীয় ও পরিচিত ছিলেন। যেমন যায়দ ইব্ন ‘আমর ইব্ন নুফায়ল, ওয়ারাকা ইবন নাওফাল ও উবায়দুল্লাহ ইব্ন জাহ্শ। সূত্রসমূহ তাঁহার এইরূপ যোগাযোগ সম্পর্কে কোন বিস্তারিত তথ্য প্রদান করে নাই অথবা একের উপর অন্যের পারস্পরিক প্রভাব সম্পর্কে কোন স্পষ্ট ইংগিত দেয় নাই। কিন্তু এইরূপ সংযোগের প্রকৃতি যাহাই হউক না কেন ইহা স্পষ্ট যে, মহানবী খাঁটি ধর্মের অনুসন্ধানে সিরিয়ার মত দূরদেশে ভ্রমণের মাধ্যমে তাহাদের কাহারও অনুকরণ করেন নাই। ইহার সম্পূর্ণ বিপরীতে তাঁহার নবুওয়াত লাভের পূর্বে তাঁহার স্বাভাবিক প্রবণতা ও কার্যাবলী সম্পর্কে যাহা জানা যায় তাহা হইতেছে, তিনি ক্রমান্বয়ে নির্জনতা পছন্দ করিতে আরম্ভ করেন এবং একাকী নির্জনে হেরা পর্বতের উপরে অবস্থিত একটি গুহায় ইবাদত ও গভীর ধ্যানে নিমগ্ন হন। হেরা পর্বতটি কা’বা শরীফের তিন মাইল পূর্ব-উত্তর-পূর্ব দিকে অবস্থিত। ইহা এখন অবশ্য মক্কা নগরীর সীমানার অন্তর্ভুক্ত। গুহায় এইভাবে নির্জনে অবস্থানকালে তিনি একদিন ফেরেশতা জিবরাঈল (আ)-এর মাধ্যমে আল্লাহর নিকট হইতে ওহী লাভ করেন। তাঁহার জীবনের এই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সবচাইতে বিশ্বস্ত বিবরণ তাঁহার সহধর্মীনী আয়েশা (রা.) কর্তৃক প্রদত্ত হইয়াছে এবং বুখারী (র) কর্তৃক সংকলিত সহীহ হাদীছ গ্রন্থে সংরক্ষিত আছে। এই ঘটনাটি তাঁহার ভাগিনা’ উরওয়াহ ইবনুয যুবায়র (মৃ. ৯৪ হি.) কর্তৃক প্রচারিত হয়। তাঁহার নিকট হইতে ইব্ন শিহাব আয-যুহরী (মৃ. ১২৪ হি.), তাঁহার নিকট হইতে উকায়ল (মৃ. ১৪৪ হি.) এবং তাঁহার নিকট হইতে আল-লায়ছ (মৃ. ১৭৫ হি.), তাঁহার নিকট হইতে ইয়াহইয়া ইন্ন বুকায়র (মৃ. ২৩১ হি.) এবং তাঁহার নিকট হইতে ইমাম বুখারী (মৃ. ২৫৬ হি.) কর্তৃক ধারাবাহিকভাবে এই ঘটনা বর্ণিত হয়। ঘটনাটি নিম্নরূপঃ
‘আয়েশা (রা) বলিলেন, আল্লাহর নিকট হইতে রাসূলুল্লাহ-এর প্রতি ওহী নাযিল হওয়ার সূচনা হইয়াছিল ঘুমের মধ্যে সুস্বপ্নের মাধ্যমে। তারপর হইতে তিনি যে স্বপ্ন দেখিতেন তাহাই ঊষার আলোকের ন্যায় ইহা ঊষাকালে ভাস্মর হইয়া উঠিত। তারপর হইতে নির্জনতা তাঁহার আরও প্রিয় হইয়া উঠিল। তিনি হেরা পর্বতের গুহায় নির্জন অবস্থায় থাকিতেন এবং আত-তাহান্নুছ অর্থাৎ ইবাদত ও আত্মসমর্পণ (তা’আব্বুদ) করিতেন। এইভাবে গুহাতে একাদিক্রমে অনেক রাত্রি যাপন করিতেন এবং কিছু পরিমাণ খাবার সংগ্রহের জন্য স্ত্রী খাদীজার নিকট ফিরিয়া আসিতেন, তারপর পুনঃ গুহায় প্রত্যাবর্তন করিতেন। এইভাবে তাঁহার নিকট সত্য ধর্ম অবতীর্ণ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তাঁহার নির্জনবাস ও ইবাদত চলিতে থাকে। ফেরেশতা তাঁহার নিকট আসিয়া বলিলেন, ‘পড়’। তিনি উত্তর দিলেন ‘আমি ত পড়ি নাই’। তিনি (মহানবী) বলিলেন : ‘ইহাতে ফেরেশতা আমাকে ধরিয়া এমনভাবে চাপ দিলেন যাহা সহ্য করা আমার জন্য কষ্টকর হইয়া পড়ে’। তারপর তিনি আমাকে ছাড়িয়া দিলেন এবং বলিলেন, “পড়”। আমি বলিলাম, আমি ত পড়ি নাই। তৎকারণে তিনি আমাকে দ্বিতীয়বার সবলে ধরিয়া চাপ দিলেন এবং এই চাপ সহ্য করিয়া থাকিবার পর্যন্ত ধরিয়া রাখিলেন। তারপর আমাকে ছাড়িয়া দিয়া বলিলেন, ‘পড়’। আমি উত্তর দিলাম, ‘আমি পড়িতে জানি না’। এইবার তৃতীয়বার আমাকে জাপটাইয়া ধরিয়া চাপ প্রয়োগ করিলেন এবং কিছুক্ষণ পর ছাড়িয়া দিয়া পুনঃ বলিলেন, ‘পড়, তোমার প্রভুর নামে যিনি সৃষ্টি করিয়াছেন, সৃষ্টি করিয়াছেন মানুষকে রক্তবিন্দু (‘আলাক) হইতে। পড়; এবং তোমার প্রভু বড়ই করুণাময়। তখন আল্লাহ্ দূত ইহা লইয়া প্রত্যাবর্তন করেন। ভয়ে ও হতবুদ্ধি অবস্থায় তাঁহার হৃদয় তখন ধড়ফড় করিতেছিল। তিনি তখন খাদীজা বিনত খুওয়ায়লিদ (রা.)-এর নিকট গিয়া তাঁহাকে বলিলেন, ‘আমাকে চাদর দিয়া ঢাকিয়া দাও, ঢাকিয়া দাও।’ তাঁহাকে চাদর দিয়া ঢাকিয়া দেওয়া হইল এবং তাঁহার ভয় দূর না হওয়া পর্যন্ত তিনি তদবস্থায় থাকিলেন। তিনি খাদীজাকে এই ঘটনা সম্পর্কে খুলিয়া বলিলেন এবং ইহার সহিত আরও যুক্ত করিলেন, ‘আমি আমার জীবনের আশংকা করিতেছি’ (অর্থাৎ আমার উপর দুর্ঘটনা ঘটিবার আশংকা করিতেছি)। খাদীজা ইহা শুনিয়া বলিলেন, আল্লাহর কসম! তিনি (আল্লাহ) কখনও আপনাকে অপমানিত করিবেন না। কারণ আপনি আত্মীয়দের খোঁজ-খবর রাখেন ও সাহায্য করেন, আপনি দুর্বলের বোঝা বহন করিয়া দেন, আপনি অসহায় নিঃস্ব গরীবদের অর্থ সাহায্য করেন, আপনি অতিথিপরায়ণ ও নিয়তির কষাঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের আপনি আশ্রয়স্থল।
আল্লাহর কসম! তিনি (আল্লাহ) কখনও আপনাকে অপমানিত করিবেন না। কারণ আপনি আত্মীয়দের খোঁজ-খবর রাখেন ও সাহায্য করেন, আপনি দুর্বলের বোঝা বহন করিয়া দেন, আপনি অসহায় নিঃস্ব গরীবদের অর্থ সাহায্য করেন, আপনি অতিথিপরায়ণ ও নিয়তির কষাঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের আপনি আশ্রয়স্থল।
তখন তিনি তাঁহার এক চাচাত ভাই ওয়ারাকা ইবন নওফাল ইন্ন আসাদ ইব্ন ‘আবদুল ‘উযযা’র নিকট তাঁহাকে লইয়া গেলেন। ওয়ারাকা জাহিলিয়ার যুগে খৃস্টধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করেন। তিনি হিব্রু ভাষায় ধর্মশাস্ত্র লিখিতেন এবং আল্লাহর ইচ্ছানুযায়ী হিব্রু ভাষায় ইনজীল গ্রন্থের অনুলিপি তৈয়ার করিতেন। তাঁহার অনেক বয়স হইয়াছিল এবং তিনি অন্ধ হইয়া গিয়াছিলেন। খাদীজা তাঁহাকে বলিলেন, ‘হে আমার ভ্রাতা! আপনার ভ্রাতুষ্পুত্রের কথা শুনুন।’ ওয়ারাকা তখন তাঁহাকে (মহানবী) বলিলেন, ‘হে আমার ভ্রাতুষ্পুত্র! আপনি কি বলিতে চাহেন তাহা খুলিয়া বলুন’? তখন আল্লাহর রাসূল যাহা দেখিয়াছেন তাহা তাঁহার নিকট বর্ণনা করিলেন। ওয়ারাকা তাঁহাকে বলিলেন, ‘ইনি হইতেছেন ‘নামূস’ (অর্থাৎ বার্তাবাহক ফেরেশতা জিবরীল) যাঁহাকে আল্লাহ তা’আলা মূসার নিকট প্রেরণ করিয়াছিলেন। হায়! আমি যদি তখন যুবক থাকিতাম! যখন আপনার লোকেরা আপনাকে তাড়াইয়া দিবে তখন যদি আমি বাঁচিয়া থাকিতাম!’ ইহা শুনিয়া আল্লাহ্র রাসূল জানিতে চাহিলেন, ‘তাহারা কি সত্যই আমাকে আপনার জন্মস্থান হইতে তাড়াইয়া দিবে?’ ওয়ারাকা বলিলেন, “হাঁ! আপনি যে বিষয় লইয়া আসিয়াছেন আমার পূর্বে ইহা লইয়া যাহারাই আসিয়াছেন তাহারাই শত্রুতার লক্ষ্যবস্তু হইয়াছেন। যদি সেই সময় পর্যন্ত আমি বাঁচিয়া থাকি তাহা হইলে আমার সর্বোত্তম সাধ্যানুযায়ী আমি আপনাকে সাহায্য করিব।’ এই ঘটনার কিছুকাল পর ওয়ারাকা ইন্তেকাল করেন এবং ওহী নাযিলে কিছু বিরতি ঘটে’।
সূত্র: সিরাত বিশ্বকোষ (৮ম খন্ড)