পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উপলক্ষ্যে প্রকাশিত ধারাবাহিক নিবন্ধ
রাসূলুল্লাহ (স)-এর জন্ম এবং এতদসংক্রান্ত অলৌকিক ঘটনাবলী
প্রকাশিত হয়েছে : ৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১:৫৬ অপরাহ্ণ
ধারাবহিক পর্ব || ০১
গর্তে অবস্থানকালে মা আমিনার স্বপ্নদর্শন
প্রামাণ্য ও প্রাচীন ঐতিহাসিক গ্রন্থাবলীর তথ্যে প্রমাণিত যে, রাসূলুল্লাহ (স)- এর জন্মগ্রহণের প্রাক্কালে মাতৃগর্ভে অবস্থানকালে তাঁহার আম্মা সায়্যিদা আমিনা প্রায়ই তাঁহার শুভাগমনের সুসংবাদ সম্বলিত স্বপ্ন দেখিতেন। ইবন হিশাম তাঁহার সীরাত-এ উল্লেখ করিয়াছেন যে, আমিনা বিনত ওয়াহ্ব বর্ণনা করিয়াছেন, রাসূলুল্লাহ (স)-কে গর্ভে ধারণকালে তিনি স্বপ্ন দেখিয়াছিলেন যে, কেহ তাঁহাকে বলিতেছেন, নিঃসন্দেহে তুমি মানবজাতির শ্রেষ্ঠতম সরদারকে স্বীয় গর্ভে ধারণ করিয়াছ। যখন তিনি ভূমিষ্ট হইবেন তখন এই কথা বলিবে, ‘একমাত্র আল্লাহর আশ্রয় চাহিতেছি’ এবং তাঁহার নাম রাখিবে মুহাম্মাদ (ইবন হিশাম, আস্-সীরাতুন-নাবাবিয়্যা, ১খ, পৃ. ১৬৪)। ইবন কাছীর তাঁহার সীরাত-এ ইবন ইসহাকের উদ্ধৃতিতে আরও উল্লেখ করিয়াছেন যে, ‘তাঁহাকে অঙ্গীকার পূর্ণকারী পূণ্যবান এবং সুসংবাদ দানকারী দূত- এর অন্তর্ভুক্ত করুন। সংরক্ষণকারী নিশ্চয়ই তাঁহাকে সংরক্ষণ করিবেন। কেননা তিনি সর্বপ্রশংসিত মর্যাদাপূর্ণ প্রতিপালকের তত্ত্বাবধানেই রহিয়াছেন’ (ইবন কাছীর, আল- বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১ম সং, ১৪০৮/১৯৮৮, ২খ., পৃ. ২৪৫)।
মা আমিনার কষ্টক্লেশহীন সহজ গর্ভধারণ
রাসূলুল্লাহ (স)-এর মাতৃগর্তে অবস্থানকালে আমিনা কোন দিনই সামান্যতম বেদনাও অনুভব করেন নাই। ইবনুল জাওযী এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করিয়াছেন, ইয়াযীদ ইব্ন আবদুল্লাহ ইবন যামআ তাঁহার খালা হইতে বর্ণনা করিয়াছেন যে, তিনি বলিয়াছেন, রাসুলুল্লাহ (স)-এর গর্ভধারণকালীন আমরা সায়্যিদা আমিনাকে বলিতে শুনিয়াছি যে, আমি তাঁহাকে গর্ভধারণ করিয়াছি অথচ কোন দিন সামান্যতম বেদনাও অনুভব করি নাই এবং কোন কষ্টও পাই নাই, যেমন অন্যান্য গর্ভবর্তী মহিলারা অনুভব করিয়া থাকেন। আমার রজঃস্রাব বন্ধ হইলে আমি বুঝিতে পারিয়াছি যে, আমার গর্ভে সন্তান আসিয়াছে। তন্দ্রাবস্থায় আমার কাছে একজন
আগমনকারী আসিয়া বলিলেন, তুমি একজন পুণ্যবর্তী গর্ভধারিণী মহিলা, ইহা কি তুমি অনুভব করিয়াছ? উত্তরে আমি যেন ইহাই বলিলাম, ‘মা আদরি’ (আমি কিছুই অনুভব করি না)। অতঃপর তিনি বলিলেন, তুমি এই বিশ্বমানবের সরদার ও তাহাদের নবীকে গর্ভে ধারণ করিয়াছ (ইবনুল জাওযী, কিতাবু সিফাতিস্-সাফওয়াত, পৃ. ১৩)।
এই প্রসঙ্গে ইবন ‘আব্বাস (রা)-এর রিওয়ায়াত ইবন সা’দ উল্লেখ করেন যে, আমিনা বিনতে ওয়াহ্ব বলেন, আমি তাঁহাকে অর্থাৎ মুহাম্মাদ (স)-কে গর্ভে ধারণ করিয়াছি। তিনি ভূমিষ্ট হওয়া পর্যন্ত আমি কখনও’ সামান্যতম বেদনাও অনুভব করি নাই। কষ্টক্লেশহীন অবস্থায় রাসূলুল্লাহ (স) ভূমিষ্ঠ হইয়াছিলেন। আমার উদর হইতে বিচ্ছিন্ন হওয়া মাত্রই এমন এক নূর বা জ্যোতি প্রকাশ পাইয়াছিল যাহা প্রাচ্য-প্রতীচ্যের মধ্যবর্তী সকল কিছুকে আলোকিত করিয়াছিল। এই সময় তিনি উভয় হাতের উপর ভর দিয়াছিলেন। অতঃপর উভয় হাতের সাহায্যে এক মুষ্টি মাটি গ্রহণ করিলেন এবং আসমানের দিকে মাথা উত্তোলন করিলেন।
কোন কোন ঐতিস্থাসিক বলিয়াছেন, ভূমিষ্ঠকালীন তিনি উভয় হাঁটুর উপর ভর দিয়াছিলেন এবং আসমানের দিকে মাথা উত্তোলন করিয়াছিলেন। সেই সময় এমন এক জ্যোতি প্রকাশ পাইয়াছিল যাহারা আলোকে সিরিয়ার সকল প্রাসাদ ও বাজার আলোকিত হইয়াছিল। ফলে আমি বুসরা নগরীর উটগুলির গর্দান দেখিতে পাইয় ছিলাম (ইবন সা’দ, তাবাকাত, দারু সাদির, বৈরূত, ১খ., পৃ. ১০২; অনুরূপ বর্ণনার জন্য দ্র. ইবন কাছীর, সীরাতুন নাবাবিয়্যা, তাহকীকঃ মুস্তাফা আবদুল ওয়াহিদ, দারু ইহয়াইত্-তুরাছিল-আরাবিয়্যা, বৈরূত, ১খ., পৃ. ২০৭; তু. আস-সুয়ূতী, খাসাইসুল কুরা, দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যা, বৈরুত, তা, বি. ১খ, পৃ. ৪৬)। ইবন আব্বাস (রা)-এর এই বর্ণনায় উৎসের উল্লেখ না করায় রিওয়ায়াতটি দুর্বল।
ভূমিষ্ঠকালীন মুহূর্তে তিনি ছিলেন অতি পূতঃপবিত্র। এই প্রসঙ্গ ইবন সা’দ ইসহাক ইব্ আবদুল্লাহ-এর বর্ণনা উল্লেখ করিয়াছেন যে, ‘আমি তাঁহাকে পূত-পবিত্র অবস্থায় প্রসব করিলাম। এই সময় তাঁহার শরীরে কোন প্রকার ময়লা বা মলমূত্র ছিল না’। এই মুহূর্তে তিনি উভয় হাতের উপর ভর দিরা ভূপৃষ্ঠে বসিয়াছিলেন (প্রাগুক্ত)। বিচ্ছুরিত আলোকরশ্মিটি ছিল যেন এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। এই প্রসঙ্গে তিনি ইবনুল-কিবতিয়্যার বর্ণনাটিও উল্লেখ করিয়াছেন। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (স)-এর আম্মা বলিয়াছেন, তাঁহার জনগ্রহণের সময় আমি দেখিলাম যে, আমার উদর হইতে যেন এক উজ্জ্বল নক্ষত্র বাহির হইল, অতঃপর সমগ্র পৃথিবী আলোকিত করিয়া তুলিল (অনুরূপ বর্ণনার জন্য দ্র. সুয়ূতী, আল-খাসাইসুল কুবরা, প্রাগুক্ত, ১খ, পৃ. ৪৬)। মুহাম্মাদ ইবন ‘আবদুল ওয়াহ্হাব তাঁহার সীরাত গ্রন্থ’ ‘মুখতাসারু সীরাতুর রাসূল’-এ ‘আব্বাস ইবন আবদুল মুত্তালিব (রা.)-এর একটি স্বরচিত কবিতা উল্লেখ করিয়াছেন, যাহাতে এই বিচ্ছুরিত আলোকরশ্মির এক চমৎকার বর্ণনা সুস্পষ্টভাবে উল্লিখিত হইয়াছে: (কবিতার অর্থ: – ‘(হে মহান)! যখন তুমি ভূমিষ্ঠ হইয়াছিলে তখন তোমারই জ্যোতিতে সারা ভুবন জ্যোতির্ময় হইয়া উঠিয়াছিল, এমনকি তোমার আলোতে দিগন্ত জুড়িয়া আলোকিত হইয়া উঠিল। আমরা সকলেই ঐ উজ্জ্বল নূর বা জ্যোতির্ময় আলোতে অবগাহন করিলাম। অতঃপর সত্য-ন্যায়ের পথগুলি উদ্ভাসিত হইয়া উঠিল।’
এই উজ্জ্বল-জ্যোতির্ময় আলো প্রকাশিত হওয়ার সূক্ষ কারণ প্রসঙ্গে গ্রন্থকার আরো উল্লেখ করিয়াছেন যে, ‘মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ (স)-এর ভূমিষ্ঠকালীন সময়ে জ্যোতির্ময় আলোর প্রকাশ নিঃসন্দেহে এই দিকে ইঙ্গিত বহন করে যে, উহা দ্বারা সমগ্র জগতবাসী হিদায়াত লাভ করিবে এবং শিরক-এর অন্ধকার হইতে মুক্তি লাভ করিবে।’ এই দিকেই ইঙ্গিত করিয়াই মহান আল্লাহ ইরশাদ করিয়াছেন :
‘অবশ্যই তোমাদের কাছে মহান আল্লাহর পক্ষ হইতে জ্যোতি এবং স্পষ্ট কিতাব আসিয়াছে। যাহারা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করিতে চাহে, ইহা দ্বারা তিনি তাহাদিগকে শান্তির পথে পরিচালিত করেন এবং নিজ অনুমতিক্রমে অন্ধকার হইতে বাহির করিয়া আলোর দিকে লইয়া যান এবং উহাদিগকে সরল পথে পরিচালিত করেন (৫৪ : ১৫-১৬)।
আর বুসরা সিরিয়ার একটি প্রসিদ্ধ শহর। সমগ্র বুসরা শহর জ্যোতির্ময় হইয়া উঠা নিঃসন্দেহে এই দিকে ইঙ্গিত বহন করে যে, ঐ নূরের জ্যোতিতে সিরিয়া উদ্ভাসিত হইয়া উঠিয়াছিল। কেননা শাম এলাকার বুসরা শহর সর্বপ্রথম মুসলমানগণ কর্তৃক বিজিত হয়। যেমন কা’ব (রা) বলিয়াছেন, “অবশ্যই পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবে বর্ণিত আছে যে, মুহাম্মাদ (স)-এর জন্মভূমি হইবে মক্কা নগরী, হিজরতের আবাসস্থল হইবেই ইয়াছরিব এবং তাঁহার শাসন প্রতিষ্ঠিত হইবে সমগ্র সিরিয়া জুড়িয়া।’
এইজন্য তিনি মি’রাজের রাত্রিতে ভ্রমণকালে সিরিয়ার বায়তুল মাকদিস-এ সফর করিয়াছিলেন। সায়্যিদিনা ইব্রাহীম (আ)-ও সিরিয়াতে হিজরত করিয়াছিলেন এবং হযরত ‘ঈসা (আ) সিরিয়ার মাটিতেই নাযিল হইবেন। আর ইহাই হইবে হাশরের ময়দান (মুহাম্মাদ ইবন ‘আবদুল ওয়াহ্হাব, মুখতাসারু সীরাতুর রাসূল, পৃ. ১৯)। রাসূলুল্লাহ (স.)-এর ভূমিষ্ঠকালীন সময়ের বিচ্ছুরিত আলোক রশ্মিতে সিরিয়ার রাজমহল দৃষ্ট হওয়ার আরো একটি সূক্ষ্ম কারণ।
সূত্রঃ
সীরাত বিশ্বকোষ ৪র্থ খন্ড থেকে নেওয়া
হযরত মুহাম্মদ (সা.)
পৃষ্ঠা : ১৯৯-২০১