দাবদাহ রোধে সবুজায়নের বিকল্প কি আছে?
প্রকাশিত হয়েছে : ২১ এপ্রিল ২০২৪, ৯:৩৫ অপরাহ্ণ
ড. মিহির লাল সাহা::
সবুজ পাতার ফাঁকে দোয়েল-শ্যামার মিষ্টি সুরে যেমন মনটা ভরে যায় ঠিক তেমনই তীব্র গরমে ছায়া সুশীতল বাতাসের পরশে শরীরকে শীতল করার কোনো বিকল্প নেই। একদিকে সবুজ বিপ্লব মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা দিয়েছে অন্যদিকে শিল্পবিপ্লব জলবায়ু পরিবর্তন ঘটিয়ে তীব্র গরমে মানুষের জীবনযাত্রাকে কঠিন করে তুলেছে।
শিল্পবিপ্লব এবং নৃতাত্ত্বিক কার্যকলাপ প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে জলবায়ু পরিবর্তনে প্রভাব ফেলেছে। আর জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই প্রতিবছর গ্রীষ্ম মৌসুমে আমাদের মোকাবিলা করতে হচ্ছে নাভিশ্বাস ওঠা দাবদাহকে। শুধু মানুষই নয় পুরো জীবজগতকেই এক কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হচ্ছে।
এই দাবদাহ বা হিট ওয়েভ মোকাবিলার জন্য দরকার দীর্ঘমেয়াদি সবুজ পরিকল্পনা। না করার চেয়ে দেরিতে করাটাও এখন সময়ের দাবি। এই পরিকল্পনায় সরকার থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততা থাকতে হবে।
আমরা সবাই জানি যে, দেশের পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষার জন্য কমপক্ষে ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা প্রয়োজন। উন্নয়নের মহাসড়কে অবস্থানরত বাংলাদেশের মোট বনভূমি এখন ১০ শতাংশেরও কম বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। একইভাবে ইট-সুরকির শহরে প্রতিনিয়ত কমছে সবুজের অংশ।
সভ্যতার রথে চড়ে আমরা যেন সৃষ্টিকর্তার সৃষ্ট প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সবুজ আলপনাকে সজ্ঞানে নষ্ট করে চলেছি। সৃষ্টিকর্তার সৃষ্ট প্রকৃতিও তার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে আমাদের প্রতি বিরূপ হয়ে উঠছে। লেখাটা লেখার সময় স্বামী বিবেকানন্দের অমর বাণী—‘জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর’ মনে পড়ে গেল। প্রকৃতির প্রতি প্রেম বৃদ্ধি করতে হবে।
হিট ওয়েভে আক্রান্ত বাংলাদেশকে এখনই পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মাধ্যমে ১০ শতাংশ বনভূমিকে সঠিকভাবে বনায়ন এবং পুনরায় বনায়নের মাধ্যমে কমপক্ষে ২০ শতাংশ বনভূমিতে উন্নীত করার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে কাজ করতে হবে। বনায়ন হলো পতিত ভূমি বা অব্যবহৃত স্থানে একটি বন তৈরি করা।
অন্যদিকে পুনঃবনায়ন হলো প্রাকৃতিক দুর্যোগ, আগুন, ঝড় ইত্যাদির কারণে নষ্ট হয়ে যাওয়া বনকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। এছাড়া সামাজিক বনায়ন, উপকূলীয় বনায়ন, কৃষি বনায়ন এবং নাগরিক বনায়নকে প্রণোদনা দিয়ে উৎসাহিত করতে হবে। পাশাপাশি বিদ্যমান বনভূমিকে সংরক্ষণ এবং পরিচর্যার মাধ্যমে জীবন্ত সবুজ আচ্ছাদনের বনভূমিতে পরিণত করতে হবে।
বনায়নের নানা সুবিধা রয়েছে। যেমন—বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কার্বন সিকোস্ট্রেশন (Carbon Sequestration)-এর মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমনের জন্য বন প্রধান ভূমিকা রাখতে পারে। ১৯৪০-এর দশকের শুরুতে, গ্রিস, ইসরায়েল, ইতালি, স্পেন এবং উত্তর আফ্রিকার মাগরিব দেশগুলো অতীতের অপব্যবহারের দ্বারা খালি ঢালে বন পুনরুদ্ধার করার জন্য বিশাল ভূমি পুনরুদ্ধার করেছিল।
অর্থনীতির শীর্ষে থাকা চীনে যেখানে বনভূমি একসময় ৩০ শতাংশেরও বেশি জমিতে বিস্তৃত ছিল। নানাবিধ কারণে এটি প্রায় ৭ শতাংশে নেমে এসেছিল। সেই চীনে জলাধার নির্মাণ এবং একটি বিশাল বন রোপণ কর্মসূচিসহ ভূমির সঠিক ব্যবহারের বড় পদক্ষেপের মাধ্যমে ২০১৫ সালের মধ্যে বনভূমির পরিমাণ ২০ শতাংশে উন্নীত করেছে। আমরাও এই মডেল অনুসরণ করতে পারি। বনায়নের ক্ষেত্রে মাটি, পরিবেশ এবং বনের উপযোগী দ্রুত বর্ধনশীল দেশীয় গাছ নির্বাচনে গুরুত্ব দিতে হবে।
দালানকোঠার শহরের ফাঁকা স্থানগুলো গাছের আবরণের প্রভাব অনস্বীকার্য। একটি জরিপে বলা হয়েছে যে, ৩০ শতাংশ গাছের সবুজ আচ্ছাদন প্রায় ০.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস পারদের লেভেল কমিয়ে আনতে পারে। এখনই নগর পরিকল্পনাবিদদের সবুজ অবকাঠামো সৃষ্টিতে ফোকাসসহ নগর পরিকল্পনা গ্রহণের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।
ইট-সুরকির শহরগুলো সবুজ করার পাশাপাশি বিদ্যমান গাছগুলো সুস্থ সবল এবং দীর্ঘজীবী করার দিকে বিশেষভাবে নজর দিতে হবে। গাছ লাগানোর নির্ধারিত স্থান বনাম একটি প্রাপ্তবয়স্ক গাছের জন্য প্রয়োজনীয় বায়বীয় স্থানটি গাছের প্রজাতি নির্বাচন করার জন্য একটি মৌলিক মানদণ্ড বিবেচনায় রাখতে হবে। যেমন দেবদারু (Polyalthia longifolia) বৃদ্ধির প্রকৃতি হলো স্তম্ভাকার, অন্যদিকে অশ্বত্থ (Ficus religiosa) ছাতার মতো বিস্তৃত কিন্তু ততটা লম্বা নয়।
বকুল (Mimusops elengi) একটি সুন্দর গোলাকার আকৃতির কিন্তু খুব একটা বড় হয় না। তাই বকুল চওড়া রাস্তার জন্য ভালো গাছ হবে না। অপরদিকে বহেড়া (Terminalia bellirica) একটি বড় গাছ, ছোট রাস্তার পাশে মানানসই হবে না। এসব বিবেচনায় শহরে সবুজায়নের ক্ষেত্রে স্থান, ভৌত পরিবেশ এবং জননিরাপত্তার বিষয়টি অবশ্যই বিবেচনায় নিয়ে দেশীয় গাছ নির্বাচন করতে হবে।
সেই ক্ষেত্রে গাছগুলো যেমন শোভাবর্ধন করবে, ফুল-ফল দেবে তেমনি সবুজ আচ্ছাদনের মাধ্যমে শীতল পরিবেশ তৈরি করবে। সেই বিবেচনায় রাস্তার পাশের গাছ হিসেবে নিম (Azadirachta indica), অশোক (Saraca asoca), বকুল (Mimusops elengi), অশ্বত্থ (Ficus religiosa), সোনালু (Cassia fistula), ছাতিম (Alstonia scholaris), তেঁতুল (Tamarindus indica) ইত্যাদি দেশীয় গাছ রোপণের পরিকল্পনা নিতে হবে। এতে দেশীয় জীববৈচিত্র্যও রক্ষা হবে।
সবুজ গাছপালা যেমন ছায়া দিয়ে আমাদের স্বস্তি দেয় তেমনই তাদের জৈবিক কাজের অংশ হিসেবে বাষ্পীভবনের মাধ্যমে শীতল বাতাস দেয়, যাকে ইভাপোট্রান্সপিরেশন (Evapotranspiration) বা বাষ্পীয়-প্রস্বেদন বলা হয়। প্রস্বেদন এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে গাছ এবং গাছপালা তাদের শিকড় দ্বারা শোষিত পানি সবুজ পাতার মাধ্যমে জলীয় বাষ্প বাতাসে ছেড়ে দিয়ে পরিবেশকে শীতল রাখে। একই সাথে ছেড়ে দেওয়া জলীয় বাষ্প ঘনীভূত হয়ে বৃষ্টিপাত ঘটিয়ে পৃথিবীকে শীতল রাখে। তাই সবুজ গাছপালা বৃদ্ধি করে ইভাপোট্রান্সপিরেশনের মাধ্যমে বায়ুমণ্ডলের তাপ শোষণ করে বাতাসকে ঠান্ডা রাখা।
যত বেশি গাছ তত বেশি বাষ্পীভবন। ফলশ্রুতিতে শহর এলাকায় বায়ুর তাপমাত্রা সহনীয় পর্যায়ে রাখা সম্ভব হবে। বৃক্ষ এবং গাছপালা একটি তাপ প্রশমন কৌশল হিসেবে সবচেয়ে বেশি উপযোগী যখন ভবনের আশেপাশে কৌশলগত স্থানে তা রোপণ করা হয়। পার্কিং স্থানে এবং রাস্তায় পায়ে হেঁটে চলার পথগুলো ছায়া প্রদানের জন্য গুল্মজাতীয় গাছ কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
গাড়িকে ঠান্ডা স্থানে রাখলে গাড়ি যেমন ঠান্ডা থাকবে তেমনই এসির ব্যবহার কম হবে। এর ফলে কিছুটা হলেও গাড়ি থেকে কম তাপ নির্গত হবে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে, পশ্চিম দিকে চিরহরিৎ জাতীয় গাছ বা লতা জাতীয় গাছ লাগিয়ে ভবনকে ঠান্ডা রাখার জন্য একটি কার্যকর পদ্ধতি। বিশেষ করে গাছগুলো জানালা এবং ভবনের ছাদের অংশে ছায়া দিয়ে বাসস্থলকে ঠান্ডা রাখে।
শহরাঞ্চলে তাপপ্রবাহের প্রভাব কমাতে বৃক্ষ এবং সবুজ প্রযুক্তির ব্যবহার এখন সময়ের দাবি। সেই বিবেচনায় ছায়া প্রদানকারী গাছ নির্বাচন করে দ্রুত সবুজায়ন করা। সড়ক দ্বীপগুলোয় গুল্মজাতীয় গাছ লাগিয়ে সবুজায়ন করা। উন্মুক্ত স্থানগুলোয় কার্পেট ঘাস বা কার্পেট জাতীয় লতানো গাছ দিয়ে মাটিকে ঢেকে দিয়ে মাটিকে উত্তপ্ত হওয়া থেকে রক্ষা করা।
তিন দশকে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে সম্পর্কিত যন্ত্রপাতি বিশেষ করে এসি বা শীততাপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্রের ব্যবহার ঘরে এবং যানবাহনে আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। যা পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। সূর্যরশ্মির সাথে পাল্লা দিয়ে বায়ুমণ্ডলকে উত্তপ্ত করছে। যে পরিমাণ এসি লাগানো হয়েছে সেই পরিমাণ গাছ লাগানো হয়নি। তাই ব্যবহৃত এসির সংখ্যার তুলনায় সবুজায়নের সম্পর্ক খুবই ঋণাত্মক।
এই কারণে ঘরের অভ্যন্তরে শীততাপ যন্ত্র ব্যবহারের পরিবর্তে ছায়া পছন্দকারী গাছ ব্যবহারের মাধ্যমে ঘরকে শীতল রাখার বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় নিতে হবে। ঘরের বাইরে সবুজ ছাদের ব্যবস্থা করা। সবুজ ছাদ হলো এমন ছাদ যা গাছপালা দিয়ে আচ্ছাদিত রেখে ভবনগুলো ঠান্ডা রাখতে সাহায্য করতে পারে। বৃক্ষ রোপণ এবং সবুজ প্রযুক্তি ব্যবহার করে শহরাঞ্চলকে হিট ওয়েভ বা দাবদাহের হাত থেকে রক্ষা পেতে বাস্তবিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবি।
সবুজ গাছপালার সাথে শহরাঞ্চলে জলাধারের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। পরিবেশকে ঠান্ডা রাখতে গাছপালার পাশাপাশি পর্যাপ্ত পরিমাণ জলাধার বা জলাভূমির গুরুত্ব রয়েছে। ১৯ এপ্রিল ২০২৪ প্রতিদিনের বাংলাদেশ এর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, একটি বাসযোগ্য শহরে কমপক্ষে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ জলাশয় থাকা দরকার হলেও ঢাকার তা আশঙ্কাজনকভাবে কমছে। রাজধানীর জলাধারগুলো নির্বিচার দখলের শিকার।
ড্যাপ (ঢাকা বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা), নগর উন্নয়ন আইন, জলাধার সংরক্ষণ আইন ও পরিবেশসংক্রান্ত আইনকে অমান্য করে পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়ার ডিআইটি পুকুর দখলসহ এই নগরীর আরও বিভিন্ন পুকুর-জলাধার দখল ও ভরাট হচ্ছে, যা খুবই উদ্বেগের বলে উল্লেখ করেছেন পরিবেশবাদী ও সংরক্ষণকর্মীরা।
দাবদাহের কথা আসলেই জলাধারের বিষয়টি উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ নেই। তাই দাবদাহ বা হিট ওয়েভের কথা মাথায় রেখে সার্বিক বিবেচনায় ঢাকা শহরকে একটি বাসযোগ্য শহর করতে হলে দেরি না করে জলাধার সংরক্ষণ এবং দ্রুত সবুজায়নের দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। আসুন আমরা সকলে মিলে আমাদের জন্য এবং আগামী প্রজন্মের জন্য একটি সবুজ শীতল দেশ গড়ে তুলি।
ড. মিহির লাল সাহা ।। অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
sahaml@du.ac.bd
সৌজন্যে: ঢাকা পোস্ট ডটকম।