জননেতা মফিজ আলীর ১৫-তম মৃত্যুবার্ষিকীতে বক্তারা
শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে মফিজ আলী নতুন প্রজন্মের কাছে প্রেরণা
প্রকাশিত হয়েছে : ১০ অক্টোবর ২০২৩, ৩:২৩ অপরাহ্ণ
নিজস্ব প্রতিবেদক::
বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘ কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সহ-সভাপতি, মৌলভীবাজার জেলা কমিটির সাবেক সভাপতি, জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট-এনডিএফ সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা, সাম্রাজ্যবাদ সামন্তবাদ বিরোধী নেতা, ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক, প্রখ্যাত চা-শ্রমিক নেতা মফিজ আলী-এর ১৫-তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ১০ অক্টোবর বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘ মৌলভীবাজার জেলা কমিটির উদ্যোগে বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে পালন করা হয়।
এদিন সকাল সাড়ে ১০ টার সময় বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘ, জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট, বাংলাদেশ কৃষক সংগ্রাম সমিতি, ধ্রুবতারা সাংস্কৃতিক সংসদ, গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতি, হোটেল শ্রমিক ইউনিয়ন, চা শ্রমিক সংঘ, রিকশা শ্রমিক ইউনিয়ন, হকার্স ইউনিয়নসহ বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তিবর্গের পক্ষ থেকে কমলগঞ্জ উপজেলার শ্রীসূর্য-ধূপাটিলাস্থ প্রয়াত নেতার সমাধিতে পুস্পস্তবক অর্পণ এবং প্রয়াত নেতার অসমাপ্ত কাজকে অগ্রসর করে নিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়ে শপথ গ্রহণ করা হয়। পরে স্থানীয় মাঠে বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘ মৌলভীবাজার জেলা কমিটির উদ্যোগে এক আলোচনা সভা অনুষ্টিত হয়। সংগঠনের জেলা সভাপতি মোঃ নুরুল মোহাইমীনের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক রজত বিশ্বাসের পরিচালনায় অনুষ্টিত আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট মৌলভীবাজার জেলা কমিটির সভাপতি কবি শহীদ সাগ্নিক, বাংলাদেশ কৃষক সংগ্রাম সমিতি মৌলভীবজাার জেলা কমিটির আহবায়ক ডা. অবনী শর্ম্মা, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘ সিলেট জেলা কমিটির যুগ্ম-সম্পাদক শ্রমিকনেতা রমজান আলী পটু, গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতি মৌলভীবাজার জেলা কমিটির সভাপতি দেলোয়ারা বেগম, ধ্রæবতারা সাংস্কৃতিক সংসদ মৌলভীবাজার জেলা কমিটির সম্পাদক অমলেশ শর্ম্মা, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘ মৌলভীবাজার জেলা কমিটির সহ-সভাপতি মোস্তফা কামাল, হোটেল শ্রমিক ইউনিয়নের জেলা সম্পাদক মোঃ শাহিন মিয়া, রিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মোঃ দুলাল মিয়া, চা শ্রমিক সংঘের নেতা হরিনারায়ন হাজরা, এনডিএফ নেতা নিরঞ্জন দাশ প্রমূখ।
সভায় বক্তারা বলেন মফিজ আলী তাঁর জীবনের প্রায় পুরোটা সময় নিজের পরিবার-পরিজন ও আত্মপ্রতিষ্ঠার চিন্তা না করে সাধারণ মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে আন্দোলন সংগ্রাম করেছেন। বিশেষত চা শ্রমিকদের নিয়ে ধারাবাহিক সংগঠন সংগ্রাম তাঁর বিশেষ পরিচিতি তৈরি করে। দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্দ্ধগতির এই সময়ে সরকার দীর্ঘ ১৩ বছরের বেশি সময় পর চা-শ্রমিকদের জন্য ‘এ’ ক্লাস বাগানে দৈনিক ১৭০ টাকা, ‘বি’ ও ‘সি’ ক্লাস বাগানে যথাক্রমে ১৬৯ টাকা ও ১৬৮ টাকা নির্ধারণ করে গেজেট প্রকাশ করে। চা-শিল্পের ১৬৯ বছর পরেও শ্রমিকদের মজুরি মাত্র ১৬৮ টাকা। চা-শিল্পে মজুরি বৃদ্ধির প্রথা অনুযায়ী মজুরি বোর্ড নির্ধারিত মজুরি ২০২১-২০২২ বছরের মেয়াদেই শেষ হয়ে গেছে। চা-শ্রমিকরা যেখানে নতুন মজুরি নির্ধারণের জন্য দাবি জানিয়ে আসছেন সেখানে মজুরি বোর্ড আগামী ৫ বছরের জন্য পূর্বেই মজুরিকে নির্ধারণ করে মালিকদের স্বার্থে নির্লজ্জ পক্ষপাতিত্ব করেছে। চা-শ্রমিক সংঘের পক্ষ থেকে বাজারদর, শ্রমিকদের জীবনমান, মালিকদের সক্ষমতা ইত্যাদি বিচার বিশ্লেষণ করে বাজারদরের সাথে সংগতিপূর্ণভাবে নি¤œতম মজুরি দৈনিক ৬৭০ টাকা নির্ধারণসহ ১১ দফা দাবি জানানো হয়। পরবর্তীতে মজুরি বোর্ড ঘোষিত খসড়া সুপারিশের প্রেক্ষিতে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আপত্তি জানিয়ে ১২ টি বিষয়ে সুনির্দ্দিষ্ট প্রস্তাবণা পেশ করে। কিন্তু মজুরি বোর্ড কোন কিছুকেই আমলে না নিয়ে মালিকদের স্বার্থ রক্ষায় ভ‚মিকা নিয়েছে। মজুরি বোর্ড ঘোষিত ৪২ টি শিল্প সেক্টরের নি¤œতম মজুরি মধ্যে চা-শ্রমিকদের জন্য সর্বনি¤œ মজুরি ঘোষণা করা হয়েছে । সরকার কথায় কথায় বিভিন্ন অর্থনৈতিক সূচকে প্রতিবেশিদের থেকে বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে থাকার কথা বললেও প্রতিবেশি ভারত, শ্রীলঙ্কায়, নেপালসহ শীর্ষ চা উৎপাদনকারী দেশ চীন ও কেনিয়ার চেয়ে আমাদের দেশের চা-শ্রমিকদের মজুরি ও সুযোগ-সুবিধা অনেক কম। বর্তমানে একটি সাধারণমানের হোটেলে দৈনিক তিন বেলা অতি সাধারণভাবে আহারের জন্য ২৫০ (১০০+১০০+৫০) টাকা দিলেও পেট ভরে না। একজন শ্রমিকের দৈনিক পরিশ্রমের পর পরবর্তি দিন কাজে যোগদানের জন্য শক্তি সঞ্চয়ের প্রয়োজনে পারিবারিকভাবে স্ত্রী পুত্র কন্যাসহ মা-বাবাকে নিয়ে ৬ সদস্যের এক পরিবারের জন্য দৈনিক ন্যূনতম ৮০০/১০০০ টাকা দরকার। অথচ শ্রমিকদের এই জীবন্ত দাবিকে অস্বীকার করে চা-শ্রমিক ইউনিয়নের উভয়পক্ষের নেতারা কিভাবে লেবার হাউজে বসে নিজেদের আখের গোছাবে তা নিয়ে ব্যস্ত। চা-শ্রমিক ইউনিয়নের নির্বাচনে ব্যয় নির্বাহের জন্য তারা শ্রমিকদের নিকট থেকে চাঁদা কাটার চেষ্ঠা চালানোর পাশাপাশি মালিকদের নিকট চিঠি দিয়ে টাকা চেয়ে তাদের দালালির চরিত্র উন্মচিত করেছে। একই সময়ে চা-শ্রমিক দরদী সেজে বিভিন্ন পক্ষ চা-শ্রমিক ইউনিয়নের নির্বাচনে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে যেমন নির্বাচনের বৈধতা দিচ্ছে তেমনি এনজিওদের সাহায্য নিয়ে তৎপরতা চালিয়ে শ্রমিকদের বিভ্রান্ত করার পাশাপাশি পরোক্ষভাবে চা-শ্রমিক ইউনিয়নকে প্রতিষ্ঠিত করার মালিক-সরকারের ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের সাথে লিপ্ত রয়েছে। এই সময়ে চা শ্রমিকরা বেশি উপলব্ধি করেছে মফিজ আলীর সংগঠন ও সংগ্রামকে। শ্রমিক আন্দোলনকে সফল করতে হলে অপরিহার্য হচ্ছে সৎ, সংগ্রামী, আপোসহীন, শ্রেণি সচেতন সংগঠন ও নেতৃত্ব। আমাদের দেশে চা-শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে শ্রমিকনেতা মফিজ আলীর নেতৃত্বে চা-শ্রমিকদের আপোসহীন আন্দোলন আজও স্মরণীয়। তাই মফিজ আলীর হাতে গড়া চা-শ্রমিক সংঘের পতাকাতলে সমবেত হয়ে চা-শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরিসহ অধিকার আদায়ে সংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ হয়ে বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলার বিকল্প নেই। বক্তারা আরও বলেন বাংলাদেশ একটি নয়াউপনিবেশিক আধাসামন্ততান্ত্রিক দেশ। এদেশের শাসন ক্ষমতায় এযাবত অধিষ্টিত সকল সরকারই কোন না কোন সাম্রাজ্যবাদের দালাল সরকার। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে একক পরাশক্তি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদীদের এবং প্রতিপক্ষ সাম্রাজ্যবাদী রাশিয়া ও বৃহত সাম্রাজ্যবাদী শক্তিতে পরিণত হওয়ার লক্ষ্যে অগ্রসরমান পুঁজিবাদী চীনের ব্যাপক তৎপরতা, প্রতিযোগিতা, প্রতিদ্ব›িদ্বতা তীব্রতর হয়ে সামনে আসে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীরা গণতন্ত্র, মানবাধিকার বিষয়ে প্রশ্ন তুলে নিষেধাজ্ঞার ধারাবাহিকতায় ভিসা নিষেধজ্ঞা কার্যকর করে চাপ প্রয়োগ কৌশলে অগ্রসর হচ্ছে। অপর দিকে চীন রাশিয়া পশ্চিমাদের এই তৎপরতাকে বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে ‘নগ্ন হস্তক্ষেপ’ ‘নব্য উপনিবেশবাদ’ আখ্যায়িত করে আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে বাংলাদেশ সরকারের অবস্থানকে সমর্থন করে কৌশলে তৎপরতা চালাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীও মুখে মার্কিনের বিরুদ্ধে বিষদগার করে বলেছেন সেন্ট মার্টিন দ্বীপ মার্কিনের হাতে তুলে দিলে তার ক্ষমতায় থাকার নিশ্চয়তা হয়ে যায়। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ যে একটি নয়াউপনিবেশিক দেশ তার প্রমাণ হয়। তাই আগামীতে কে ক্ষমতায় আসবে বা কি উপায়ে নির্বাচন হবে তা নির্ধারিত হবে সাম্রাজ্যবাদীদেশগুলো প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্ব›িদ্বতার মধ্য দিয়ে। সাম্রাজ্যবাদী উভয়পক্ষের চাওয়া হচ্ছে স্ব স্ব লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সবচেয়ে উপযোগী দালাল দল ও শক্তিকে ক্ষমতায় আনা। তাই যে দল বা জোট অথবা অন্য কোন শক্তি ক্ষমতাসীন হলেও এদেশের জনগণের কোন লাভ হবে না। বাংলাদেশের ৫২ বছরের ইতিহাসে অনেক সরকারই জনগণ দেখেছে। তাই এক সাম্রাজ্যবাদের পরিবর্তে আরেক সাম্রাজ্যবাদ নয়, এক দালালের পরিবর্তে আরেক দালাল নয়, সকল সাম্রাজ্যবাদ ও তার দালালদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম তীব্রতর করে শ্রমিক-কৃষক-জনগণের রাষ্ট্র, সরকার ও সংবিধান প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দূর্বার আন্দোলন-সংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে।
বক্তারা মফিজ আলীর জীবনের উপর আলোচনা করতে গিয়ে বলেন মফিজ আলী ছাত্র জীবন থেকে প্রগতিশীল রাজনীতির ধারায় সম্পৃক্ত হয়ে ছাত্রআন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ‚্যত্থান, কৃষক আন্দোলন, শ্রমিক আন্দোলনে আতœনিয়োগ করে তাঁর জীবনের প্রায় পুরোটা সময় নিজের পরিবার-পরিজন ও আত্মপ্রতিষ্ঠার চিন্তা না করে সাধারণ মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে আন্দোলন সংগ্রাম করেছেন। ৬০-এর দশকে সংশোধনবাদী তিন শান্তির তত্ত¡ নিয়ে বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনে মহাবিতর্ক শুরু হলে আমাদের দেশে কমরেড আবদুল হক, কমরেড অজয় ভট্টাচার্য্য প্রমূখ নেতৃবৃন্দ মার্কসবাদ-লেনিনবাদের পতাকা উর্দ্ধে তুলে ধরে মতাদর্শগত লড়াই চালান। ফলশ্রæতিতে ১৯৬৫ সালে পার্টি বিভক্ত হয়ে গেলে মফিজ আলী মার্কসবাদ-লেনিনবাদের পক্ষে অবস্থান নেন। তিনি মাঠের কর্মী হিসেবে, জননেতা হিসেবে শোষিত নির্যাতিত শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে যেমন নিরলস সংগ্রাম করে গেছেন, তেমনি তাঁর ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে সংশোধনবাদ-সুবিধাবাদীদের মুখোশ উন্মোচন করেছেন। দীর্ঘ ৬০ বছরের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনে তিনি ৭ বার কারবরণ করেন। ২০০৮ সালে ১০ অক্টোবর সংগ্রামী এই জননেতা ৮১ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।