জেনে নিন কে ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার মেজর খালেদুর
প্রকাশিত হয়েছে : ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:১৮ পূর্বাহ্ণ
বাংলাদেশের একজন উজ্জল নক্ষত্র চলে গেলেন নীরবে। মৌলভীবাজার জেলার অত্যন্ত সুপরিচিত একটি গ্রাম বাহার মর্দান এর কৃতি সন্তান ইঞ্জিনিয়ার মেজর খালেদুর রহমান।১৯৫৯ সনে এসএসসি পাস করেন তিনি।১৯৬১ সনে এইচএসসি পাস করে তৎকালিন ঢাকা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ( বর্তমানে বুয়েট) এ ভর্তি হন।সেখান থেকে ইন্জিনিয়ারিং পাশ করেন।
পরবর্তীতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইন্জিনিয়ারিং কোরে যোগদান করেন।পৃথিবীর সবচাইতে ভয়ঙ্কর রাস্তার একটি পাকিস্তানের “কারাকোরাম হাইওয়ে”।রাস্তাটি পাকিস্তান থেকে চীনের উইঘর জিনজিয়াং প্রদেশে গিয়েছে।পর্বতের উপর দিয়ে নির্মিত এই রাস্তাটির সর্বচ্চো উচ্চতা ১৫০০০ হাজার ফুট স্হানীয় অনেকে এই রাস্তাটিকে পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য বলে থাকে।সেই রাস্তা নির্মাণের ইন্জিনীয়ারদের অন্যতমএকজন ছিলেন আমাদের গর্ব মেজর খালেদ।তাঁর এই অবদানের স্বীকৃতি স্বরুপ সেই রাস্তার একটি ব্রীজের নামকরন হয়েছে ক্যাপ্টেন খালেদ ব্রীজ।তখন তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ক্যাপ্টেন হিসাবে কর্মরত ছিলেন।মৌলভীবাজার শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া মনুনদী অত্যন্ত খরস্রোতা।সেই নদীটির সংস্কারের কাজে ও তিনি ছিলেন।এখন শহর ও আর আগের মত বন্যাকবলিত হয়না।
মৌলভীবাজার সদর উপজেলার প্রথম নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি।উপজেলা চেয়ারান হিসাবে তিনি সততা ও নিস্টার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। দ্বিতীয় মেয়াদে আর তিনি নির্বাচন করেননি। নিয়মনীতি বহির্ভুত কোন কাজ কোনদিন তিনি করেননি। এমনকি ব্যক্তিগত এবং অফিসিয়াল কাজ তিনি কোন সময় একসাথে করেননি। পুরো সকাল তিনি বাড়ির সকল কাজ নিজ হাতে করতেন তারপর সময়মত উপজেলা অফিসে যেতেন অফিস থেকে এসে আবার নিজের কাজ করতেন। একটি ঘটনা বললে উনার সম্পর্কে ধারনা পাবেন। উনি উপজেলা চেয়ারম্যান থাকাকালীন আমরা “ বাহার মর্দান সমাজকল্যাণ সমিতির” পক্ষ থেকে একটি স্বরনিকা প্রকাশ করি। উনার একটা বানী সেখানে দেওয়ার জন্য উনাকে আমরা অনুরোধ করেছিলাম এবং রাজি হয়ে বলেছিলেন তোমরা লিখে নিয়ে এস আমি দেখে সাক্ষর করে দেব। মোটকথা অফিসিয়াল হতে হবে। আমরা বেশ যত্ন সহকারে উনার বানীটি তৈরী করি। যেহেতু উনার বাড়িও আমাদের বাড়ির পাশেই তাই ভাবলাম এত দুরে অফিসে যাওয়ার দরকার কি , কয়েকজন মিলে সকাল বেলা উনার সাক্ষর আনতে উনার বাডিত চলে গেলাম গিয়ে দেখি উনি ক্ষেতের ধান শুকাতে দিচ্ছেন নিজ হাতে, এরই ফাকে আমাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন কি জন্য এসেছি। আমরা যখন বললাম উনার সাক্ষরের জন্য এসেছি ধমকের সুরে বললেন তোমরা জান আমি অফিসের কাজ বাসায় করি না এবং অফিসের কোন সিলও আমার বাসায় নাই সুতরাং অফিস টাইমে অর্থাৎ সকাল ৮ থেকে বিকাল ৩ টার মধ্যে অফিসে যেতে হবে কারন ৩টার পর উনি বিভিন্ন প্রজেক্ট ঘুরে ঘুরে দেখেন। উনার কথায় সেদিন আমি সহ আমরা উপস্হিত সবাই অনেক রাগ করেছিলাম , সামান্য একটা সাক্ষর উনি দিয়ে দিলেইতো পারতেন। পরবর্তী সময়ে বড় হয়ে বুজলাম সেদিন তিনি আমাদেরকে অনেক কিছু শিক্ষা দিয়েছেন। স্যালুট এই মহান মানুষকে।
আমার আব্বার সাথে মেজর সাহেবের বেশ ভাল সম্পর্ক ছিল। অনেকবার উনাকে দেখেছি আব্বার ঘরে বসে দীর্ঘক্ষন আলাপ আলোচনা করতে। আমাকেও বেশ স্নেহ করতেন । মাঝে মাঝে পায়ে হেটে কলেজে যাওয়ার সময় উনি প্রায়ই উনার গাড়িতে উঠিয়ে নিতেন। উনার সাথে সর্বশেষ আমার দেখা হয় ২০০৬ সালে আব্বার মৃত্যুর সময় । উনি কতটুকু আন্তরিক ভাবে আমাদেরকে স্নেহ করতেন একটি ঘটনাই তার প্রমান। আব্বার মৃত্যুর ১০/১৫ দিন পর বাড়িতে আমরা একটা মিলাদের ব্যবস্হা করি সেখানে আগের রাত্রে অসুস্হ ছেলেকে বাডীতে রেখে নিজের অসুস্হ শরীর নিয়ে দীর্ঘক্ষন খাবার দাবার কিভাবে রান্না বান্না হবে তা তদারকি করেন । মিলাদের দিন সকাল বেলা আবার চলে আসেন এবং সবকিছু নিজ দায়িত্বে তদারকি করেন। সবকিছু যখন সুন্দর ভাবে চলছিল ঠিক সেই সময় খবর আসে উনার অসুস্হ ছেলেটির শরীর আরও খারাপ করেছে। খবরটা শুনে উনার মনটা খুব খারাপ হয়ে যায় তারপরও সবাই কে কাজ বুঝিয়ে দিয় উনি বাড়িতে চলে যান। সেদিন উনার ছেলেকে হাসপাতালে নিয়ে যান কিন্তু উনাকে সুখ সাগরে বাসিয়ে দু তিন দিন পর উনার যুবক ছেলেটি ইন্তেকাল করে। দোয়া করি মহান আল্লাহ তায়ালা যেন উনাকে এবং উনার স্ত্রী সন্তান সহ সবাইকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করেন। আমিন।
(মরহুম মেজর অবসরপ্রাপ্ত খালিদুর রহমান সাহেব শুধুমাত্র তার পরিবার নয় বরং তিনি বাহারমর্দান,মৌলভীবাজার, সিলেট বিভাগ এবং সারা বাংলাদেশের জন্য গর্বের।।
১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে যাতে তিনি অংশগ্রহণ করতে না পারেন সে জন্য বাংলাদেশের অনেক সেনাবাহিনীর কমকর্তাদের সাথে উনাকে ও পাকিস্তানের জেলে বন্দি করে রাখা হয় স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশে ফিরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন এবং পরবর্তিতে মেজর পদে উন্নীত হন এবং মেজর থাকা অবস্হায়ই স্বেচ্ছা অবসরে চলে আসেন। অকুতোভয় এই সুর্য সন্তানকে কে জানাজার নামাজের পর রাষ্ট্রীয় সামরিক সম্মাননা প্রদর্শন করছেন সেনাবাহিনীর গর্বিত সৈনিকেরা।)
লেখক: আহমেদ জিলু
কানেকটিকাট, ইউএসএ।