ইমাম মাহমুদের কাফেলা
নাশকতার পরিকল্পনা ছিল জঙ্গিদের, আস্তানা থেকে গ্রেপ্তার ১০
প্রকাশিত হয়েছে : ১৩ আগস্ট ২০২৩, ৫:৪৬ অপরাহ্ণ
নিজস্ব প্রতিবেদক::
মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার পাহাড়ঘেরা গহিন অরণ্যে সন্ধান পাওয়া নতুন উগ্রবাদী সংগঠন ‘ইমাম মাহমুদের কাফেলা’র সদস্য কারা, কী তাদের আদর্শ, তাদের উদ্দেশ্যই বা কী—তা নিয়ে কৌতূহলের সৃষ্টি হয়েছে। দেশে জঙ্গি দমনে যুক্ত ইউনিটগুলোর একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, ওই সংগঠনের সদস্যরা নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের (আগের এবিটি) আদর্শ অনুসরণ করে পরিচালিত হচ্ছিল।
অবশ্য অনলাইন সার্চ করে দেখা গেছে, বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপ, ইউটিউব ও ব্লগে ইমাম মাহমুদের অনুসারীরা সক্রিয় রয়েছে। এসব মাধ্যমে তাদের দাবি, ‘গাজওয়াতুল হিন্দ’ বা হিন্দের যুদ্ধ তাদের লক্ষ্য। হিন্দ হচ্ছে ভারতীয় উপমহাদেশ বা এই অঞ্চল। অনুসারীরা মনে করে, ওই যুদ্ধে ইমাম মাহমুদ নেতৃত্ব দেবেন। যদিও অন্য এক গ্রুপ মনে করে, গাজওয়াতুল হিন্দের নেতৃত্ব দেবেন ইমাম মাহাদী।
জঙ্গি দমনে যুক্ত কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট গতকাল শনিবার কুলাউড়ার সীমান্তবর্তী পূর্ব টাট্টিউলির গহিন অরণ্যে ইমাম মাহমুদের কাফেলার আস্তানার সন্ধান পায়। এরপর সেখানে সোয়াট টিম অভিযান চালিয়ে নারী ও পুরুষসহ ১০ জনকে গ্রেপ্তার করে। ওই আস্তানা থেকে বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক ও ডেটনেটর জব্দ করা হয়। আস্তানাটিতে বিস্ফোরকের প্রশিক্ষণের আলামতও মেলে।
সিটিটিসির এক কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, তারা দীর্ঘদিন ধরেই তথ্য পাচ্ছিলেন উগ্রবাদীরা দেশে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে হামলা চালানোর চেষ্টায় রয়েছে। নতুন এই সংগঠনটির এমন পরিকল্পনা থাকতে পারে হয়তো। বিষয়টি নিয়ে গ্রেপ্তারদের বিস্তারিত জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। তবে প্রাথমিকভাবে বিস্ফোরকের মজুত দেখে মনে হয়েছে, তারা দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য নাশকতার প্রস্তুতি নিচ্ছিল।
নদীভাঙা লোক পরিচয়ে টিলায় জায়গা কেনে তারা: স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কুলাউড়ার পূর্ব টাট্টিউলি গ্রামে বেশকিছু পাহাড়ি সরকারি খাসজমি রয়েছে। এলাকাটি একেবারে নির্জন। এর মধ্যে বেশ কিছু জমি রফিক মিয়া নামের দুবাই প্রবাসী স্থানীয় এক বাসিন্দার দখলে রয়েছে। গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিরা প্রায় দুই মাস আগে রফিক মিয়ার কাছ থেকে ৭ লাখ টাকায় ৫০ শতক জমি কিনে বসতি স্থাপন করে। রফিক মিয়া দেড় থেকে দুই মাস আগে দুবাইয়ে চলে গেছেন।
স্থানীয়রা বলছেন, জমিটি কিনতে ওই এলাকার হারুন মিয়া ও রফিক মিয়া নামে দুজন সহযোগিতা করেন। ওই টিলায় তিনটি টিনের ঘর তৈরি করে বসবাস শুরু করে শিশু-নারীসহ ১৫ থেকে ১৬ জন সদস্যের পরিবার। প্রয়োজন ছাড়া ওই টিলা থেকে তারা নামত না।
স্থানীয় এক দোকানি জানান, টিলার নতুন বাসিন্দাদের চলাফেরা নিয়ে তাদের সন্দেহ হয়েছিল। জিজ্ঞেস করলে তারা দাবি করেছিল, বগুড়ায় নদীতে নিজেদের বাড়ি বিলীন হয়ে যাওয়ায় এখানে জমি কিনেছে।
স্থানীয় ইয়াকুব আলী জানান, প্রায় এক মাস আগে ওই টিলায় প্রায় ১২ বহিরাগত লোক বসবাস শুরু করে। তারা এই এলাকায় অপরিচিত। বাড়িতে নারী-পুরুষসহ ২৫ থেকে ২৬ জন থাকত। এরা যে জঙ্গি, তা তারা বুঝতে পারেননি।
স্থানীয় কর্মধা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুহিবুল ইসলাম বলেন, ওই টিলার নতুন বাসিন্দারা স্থানীয় লোকজনকে বলত, নদীভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে এখানে এসেছে। তবে তারা প্রায়ই গভীর জঙ্গলে ঢুকত। সেখানে কী করত, এলাকার কেউ সেটি জানতেন না।’
সিটিটিসির প্রধান মো. আসাদুজ্জামান জানান, উগ্রবাদী সংগঠনটি যে জমি কিনেছে, সেটি ৫০ শতক। তাদের কাছ থেকে দলিলটি উদ্ধার করা হয়েছে। তবে জমির দাম যেটি দলিলে লেখা, সেটি সঠিক কি না ও কী পরিমাণ অর্থ এখানে ব্যয় হয়েছে, সে বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ এবং তদন্ত করে জানা যাবে।
‘হিজরতে’ কৌশল পরিবর্তন উগ্রবাদীদের: সিটিটিসি কর্মকর্তারা বলছেন, বিভিন্ন সময় জঙ্গি দলে ভিড়তে অনেক তরুণ একা ঘর ছেড়েছিল। তাদের ভাষায় যা হিজরত। পরে এরা জঙ্গি আস্তানায় চলে যায়। কিন্তু ইমাম মাহমুদের কাফেলার সদস্যদের ভিন্ন রূপ দেখা গেছে। তারা পরিবারের সবাইকে নিয়ে কথিত হিজরত করেছে। এজন্য পরিবারের অন্য সদস্যরা তাদের সন্ধান চেয়ে থানায় জিডিও করেনি। ফলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও ছিল অন্ধকারে।
একজন কর্মকর্তা জানান, ওই আস্তানা থেকে গ্রেপ্তার ১০ জনের মধ্যে পাবনা জেলার আটঘরিয়ার আব্দুস ছাত্তারের স্ত্রী শাপলা বেগম, নাটোর সদরের সোহেল তানজীমের স্ত্রী মাইশা ইসলাম, বগুড়া জেলার সারিয়াকান্দির সানজিদা খাতুন (১৮) এবং সাতক্ষীরার শফিকুল ইসলামের স্ত্রী আমিনা বেগম (৪০) এবং তার মেয়েকে পাওয়া গেছে। পুরুষদের পাওয়া যায়নি। তারা হয়তো অভিযানের আগে সটকে পড়ে বা অন্য কোনো আস্তানায় থাকতে পারে। পুরো বিষয়টি তদন্ত চলছে।