সিলেটের শ্রেষ্ঠ হাসপাতাল যখন নিজেই রোগাক্রান্ত
প্রকাশিত হয়েছে : ৯ আগস্ট ২০২৩, ৯:১৩ অপরাহ্ণ
অতিথি প্রতিবেদক::
সিলেট বিভাগের চার জেলার মধ্যে মাতৃস্বাস্থ্য সেবায় চলতি বছর শ্রেষ্ঠ হয়েছে মৌলভীবাজার ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতাল। এই হাসপাতালে চিকিৎসকসহ নানাবিধ সঙ্কটে স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন জেলার প্রায় ২২ লাখ মানুষ। দীর্ঘদিন যাবৎ সার্জারি, অ্যানেস্থেসিয়া, চক্ষু, গাইনি, শিশু, অর্থোপেডিক্স, কার্ডিওলজিসহ ১৬ টি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকসহ ৪৪ টি পদ শূন্য রয়েছে।
এটিই জেলার সব মানুষের চিকিৎসার ভরসাস্থল। অথচ চিকিৎসক ও টেকনোলজিস্ট সঙ্কট, রোগ নির্ণয়ের মেশিনগুলো নষ্ট হওয়ায় ব্যহত হচ্ছে চিকিৎসা সেবা। আলট্রাসনোগ্রাম, ইসিজি ও রক্তের ৪/৫টি পরীক্ষা ছাড়া অন্য পরীক্ষা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন রোগী, এতে উদ্বিগ্ন তাদের স্বজনেরা।
জানা গেছে, মৌলভীবাজার ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে ৫৩টি চিকিৎসক পদের ১৬টি রয়েছে শূণ্য। এছাড়াও নার্সিং কর্মকর্তার ৪টি, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির ১৬টি এবং চতুর্থশ্রেণির কর্মচারী ৮টি পদ আছে শূন্য। সব মিলিয়ে ৪৪ টি পদ রয়েছে শূণ্য।
হাসপাতালটিতে ৫৩ জনের জায়গায় চিকিৎসক রয়েছেন মাত্র ৩৭ জন। হাসপাতালে রোগীদের পাশাপাশি বর্হিবিভাগের রোগীদেরও চাপ সামলাতে হয় তাদের। ফলে প্রত্যাশিত চিকিৎসা পায়না রোগীরা। তবে এখানে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা অভিযোগ করে বলেন, হাসপাতালের বেশিরভাগ চিকিৎসক স্থানীয় ক্লিনিকের সাথে জড়িত থাকায় হাসপাতালের সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন তারা। তাই বাধ্য হয়ে বাড়তি টাকা খরচ করে স্থানীয় বিভিন্ন ক্লিনিকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হচ্ছে। এছাড়া, দালালদের দৌরাত্ম্য আর অপরিচ্ছন্নতার জন্য পরিবেশ অস্বাস্থ্যকর বলেও অভিযোগ রয়েছে রোগীদের।
জানা যায়, হাসপাতালে এক্সরে মেশিন নষ্ট, প্যাথলজি রিএজেন্টের অভাব এবং রোগ নির্ণয়ের অন্যান্য মেশিনগুলো দীর্ঘদিন চালু না থাকায় বাকি সব যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। ফলে এই অবস্থায় সাধারণ রোগীদের অধিক টাকায় অন্যত্র এমনকি সিলেট কিংবা ঢাকায় পরীক্ষাসহ চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করতে হয়। এছাড়াও রোগীদের উঠানামার একমাত্র লিফট নষ্ট হয়ে টানা এক সপ্তাহ বন্ধ ছিলো, মেরামত হলেও প্রায়ই লিফট বন্ধ থাকে। এতে চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে রোগী ও তাদের স্বজনদের।
সদর উপজেলার জগৎসী এলাকার মজিদ খাঁ জানান, গত কয়েকদিন আগে আমার বাবাকে নিয়ে হাসপাতালে আসি। লিফট নষ্ট থাকায় আমি ও আমার বোন জামাই অসুস্থ বাবাকে কোলে করে দোতলায় উঠানো নামানো করি।
ওয়ার্ড ও কেবিনে চিকিৎসায় নার্স ও স্টাফদের বিরুদ্ধে রয়েছে আগত রোগী ও রোগীর স্বজনদের অভিযোগ। এই অবস্থায় রোগীরা হাসপাতালে এসে যথাযথ চিকিৎসা সেবা না পেয়ে ক্ষুব্ধ।
রাজানগর উপজেলার টেংরা গ্রামে আব্দুল মোতালিব বলেন, এই হাসপাতালের কয়েকজন নার্স ও স্টাফের অবহেলা, দুর্ব্যবহারে রোগীরা প্রকৃত স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন প্রতিনিয়ত।
হাসপাতালে একজন সুস্থ মানুষ আসলে নিজেই রোগাক্রান্ত হওয়ার ভয় রয়েছে। হাসপাতালের ভেতরে বাইরে রয়েছে অস্বাস্থ্যকর ও নোংরা পরিবেশ। রোগী থাকার ওয়ার্ডগুলোতে আছে বিশ্রী দূর্গন্ধ, জানান স্বাস্থ্যসেবা নিতে আসা কুলাউড়া উপজেলা হাজিপুর এলাকার মোবারক মিয়া।
রোগীদের অভিযোগ, ভর্তি রোগীদের ওয়ার্ড ঠিকমতো পরিস্কার করা হয় না। পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের ডাক দিলে বাজে ব্যবহার করেন। নিয়মিত পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করা হয় না বলে জানান তারা।
রোগী পারভীন বলেন, মাঝেমধ্যে আয়ার দেখা মেলে। তবে বেশিরভাগ সময় টয়লেট ও কক্ষগুলো অপরিস্কার থাকে। এখানে এসে আরও অসুস্থ হয়ে পড়ছি।
মেডিকেল টেকনোলজিস্ট বীরেন্দ্র চন্দ্র জানান, হাসপাতালের ডিজিটাল এক্সরে মেশিন নষ্ট হওয়ায় কোনো ডিজিটাল এক্সরে হচ্ছে না। রোগিরা অন্যত্র থেকে এক্সরে করাচ্ছেন।
মৌলভীবাজার ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের আরএমও ডা. আহমদ ফয়সাল জামান বলেন, বহির্বিভাগের জনবল ও ডাক্তারের সংখ্যা বৃদ্ধি করে খালি পোষ্টগুলো পূরণ হয়ে গেলে আশাকরি সামনে আরও বহির্বিভাগে সেবা দিতে পারবো। পাশাপাশি হাসপাতালে কিছু বেসিক পরীক্ষা হচ্ছে, কিছু স্পেশাল পরীক্ষা রিএজেন্ট ও বাজেট স্বল্পতার কারণে করতে পারছিনা। আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। আশা করছি, বাজেট পেলে পূর্বের ন্যায় পরীক্ষাগুলো চালু করতে পারবো।
চিকিৎসক ও জনবল সংকটের কথা স্বীকার করে হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত তত্বাবধায়ক ড. বিনেন্দু ভৌমিক বলেন, আমরা সেবা দিয়ে যাওয়ার জন্য বদ্ধপরিকর। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ আমাদের সাথে আছে, জেলা জনপ্রতিনিধিদের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রয়েছে। তারাও সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন। আমরাও হাসপাতালের উন্নয়নে যতটুকু করার তা করে যাচ্ছি। তবে হাসপাতালে সেবা দিতে কিছুটা সংকট রয়েছে। লজেস্টিক, জনবল ও বিভিন্ন জিনিসপত্রের চাহিদার অপ্রতুলতা রয়েছে। চেষ্টা করছি তা সমাধানের।
জেলার এতো বিশাল জনসংখ্যা এই হাসপাতালের উপর নির্ভরশীল। রোগি ও রোগির স্বজনদের প্রত্যাশা, উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করে মানুষের চিকিৎসা সেবা দেওয়ার উপযোগী করতে কর্তৃপক্ষ দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।