আপনি ফুটেছিল ফুল গিয়াছে আপনি ঝরিয়া
প্রকাশিত হয়েছে : ৯ জুলাই ২০২৩, ১:০৩ অপরাহ্ণ
সালাহ্ উদ্দিন ইবনে শিহাব::
নাসির ভাই যে রাতে মারা যান সে রাতে এক সুখস্বপ্নে বিভোর ছিলাম। ঘুমের ঘোরে স্বপ্নে দেখি চেকের এক রঙিন পাঞ্জাবি ওয়ার্ডরবে পড়ে আছে। যেটা কোন দিন পরা হয়নি আমার। এমন একটা সুন্দর পাঞ্জাবি যে আমার আছে সেটাও মনে ছিল না। পুরাতন পাঞ্জাবিগুলোর ভিড়ে নতুন একটি খোঁজে পেয়ে কী যে আনন্দ আমার। স্বপ্নে দেখি ওটা পরিধান করে আমি দূরে কোথাও যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। এই স্বপ্ন দেখতে দেখতেই ঘুম ভাঙে। একটু অন্যরকম ভোর। অভ্যাসমতো একবার ফেইসবুক চেক করি। সেদিন ফেইসবুক অন করেই ছাত্রনেতা রাজন আহমদের মেসেজ দেখে চমকে উঠি। নাসির ভাই (মাওলানা নাসির উদ্দিন) মারা গেছেন। শরীরটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠে। আবার পড়ি। না ঠিকই তো সাব্বির ভাইর ভাই নাসির ভাই ইন্তেকাল করেছেন। চোখ ঝাঁপসা হয়ে উঠে। ভেতরের কান্না সামলাতে পারি না। জল গড়ায়। চোখ ভিজে। সে জলে ভেজে শরীরের কাপড়। এ কী ঘটলো। এমন থই থই বর্ষায় নাসির ভাই কোন অভিমানে আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। আমি ভাতিজা রেদওয়ানকে ফোন দিয়ে বিষয়টি নিশ্চিত হই। কতো আর বয়স হয়েছিল তাঁর। সিক্ত মনে আওড়াই নজরুলের গান…
মুসাফির মোছ রে আঁখি জল
ফিরে চল আপনারে নিয়া
আপনি ফুটেছিল ফুল
গিয়াছে আপনি ঝরিয়া।…
নাসির ভাই এক সুরভিত ফুল ছিলেন। যে ফুল আপন মহিমায় বিকশিত হয়েছিল মেশকের ঘ্রাণ নিয়ে। এ ঘ্রাণে মউ মউ করতো চারপাশ। বুঝি আমার স্বপ্নের রঙিন পাঞ্জাবির মতোই তিনি রঙিন দুনিয়া ছেড়ে দূরে কোথাও যাচ্ছেন। মাওলানা নাসির উদ্দিন ভাই ছিলেন আমার প্রিয় এক অভিভাবক। খুব ছোটবেলা থেকেই তাদের পরিবারের সাথে আমার গভীর সম্পর্ক। প্রায় দেড়যুগ। তাদের সর্বকনিষ্ট ভাই করিমুল ভাই ছিলেন আমার ক্লাসমেট। বয়সে তিনি আমার চেয়ে বড় হলেও আমরা ছিলাম ঘনিষ্ট বন্ধু। সে সুবাধে ২০০২ সাল থেকে তাদের বাড়িতে আসা যাওয়া। এরপর কতবছর।…
মৌলভীবাজার সদর উপজেলার শমসেরগঞ্জের নিভৃতপল্লী দৌলতপুর গ্রামে জন্মেছিলেন মাওলানা নাসির উদ্দিন। এক আল্লাহওয়ালা পরিবারে তাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠা। নিভৃত গ্রামের শ্যামল ছায়ায় তাঁর হৃদয়ভূমি তৈরি হয়েছিল। প্রেম, দয়ামায়া আর পরোপকারের ব্রত তাঁর জীবনকে বহুবর্ণে রঙিন করে তুলেছিল। কি গ্রাম, কি শহর, এলাকার চারপাশ ভেঙে পড়েছিল তার মৃত্যুশোকে। যেন ঘোমট নদী বর্ষার ভারিবর্ষণে দুকূল ছাপিয়ে উপছে পড়ছে জলের খেলায়।
যখন চারপাশজুড়ে কেবল স্বার্থের ললিপপ মাকড়শার জালের মত ঘনিভূত হয়ে আসছে সেখানে নাসির ভাই ছিলেন সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। তার দয়াবতী মন সাগরের ঢেউ হয়ে প্রেম ও ভালবাসার ফল্গুধারা বইয়ে দিয়েছিল। আমরা সে সাগর তীরের মুগ্ধ দর্শক ছিলাম। কত কথা আরা কত আলাপ নাসির ভাইয়ের সাথে সেসব স্মৃতির নিকুঞ্জে জমাট হয়ে আছে।
কে ছিলেন নাসির ভাই? এক আল্লাহওয়ালা, নবীওয়ালা, মানবপ্রেমিক চরিত্রের নাম আলহাজ মাওলানা নাসির উদ্দিন। একজন আদর্শ শিক্ষক। আদর্শ অভিভাবক, আদর্শ বড় ভাই।
পিতামাতার ১০ সন্তানের মধ্যে মাওলানা নাসির উদ্দিন ছিলেন দ্বিতীয়। তাদের শ্রদ্ধেয় বাবা মর্দে মুজাহিদ, নবীপ্রেমি, ফুলতলী মসলকপ্রেমি মরহুম ডা. কুতুব উদ্দিন সাহেব তাঁর সন্তানদের নিজের অনুপম আদর্শে গড়ে তুলেছিলেন। নাসির ভাই একদিন স্মৃতিচারণ করে বলেন- বাবার নির্দেশে তিনি এলাকার ধোবারহাট উচ্চবিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। সেই থেকে তিনি ইন্তেকালের পূর্ব-পর্যন্ত স্কুলে হেড মাওলানার দায়িত্ব পালন করে গেছেন। শিক্ষক হিসাবে তার নিজ এলাকার গন্ডি পেরিয়ে আশপাশ গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে তার সুখ্যাতির সুঘ্রাণ। জানাযার পূর্বে এর ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠে। আশপাশের সকল গ্রাম ও মহল্লা থেকে তার ছাত্র, প্রিয়জন, শিক্ষকগণ জড়ো হতে থাকেন। জানাযার ময়দান কানায় কানায় ভরে উঠে তার প্রশংসা ও স্মৃতিচারণে।
মরহুম মাওলানা নাসির উদ্দিন ফুলতলী মসলকের এক নিভৃতচারী মুজাহিদ ছিলেন। মৌলভীবাজার সদরের পশ্চিম অঞ্চলে কুরআনের খেদমতকে তিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন। দারুল কেরাত মজিদিয়া ফুলতলী ট্রাস্টের মাধ্যমে আশপাশ গ্রামে শত শত ক্বারী তৈরি করেছেন। ছিলেন যুগের হাতেম তাঈ, কোটি মানুষের নয়নমনি আল্লামা বড় ছাহেব কিবলাহ ফুলতলীর প্রিয়ভাজন। তিনি বড় আদর করে ডাক দিতেন মাওলানা ‘নাসির উদ্দিন’। হাজার হাজার ছাত্রের উস্তাদ মাওলানা নাসির উদ্দিনের মৃত্যুতে তার ছাত্রদের আকুল কান্না ভেজা চোখ আমি সেই জানাযায় দেখেছি। একজন আদর্শ শিক্ষকের মৃত্যুতে এলাকাবাসীর শোক আমাকে ভাবিয়েছে।
সবশেষে মানুষকে একদিন ঠিকটাক চলে যেতেই হয়। পেছনে পড়ে থাকে কতো কীর্তি। স্থির হয়ে যায় সকল কর্ম। বিপুল বাসনা। তখন সে একান্তই করুণাপ্রার্থী। রবীন্দ্রনাথ সম্ভবত একথাটিই বলেছেন-
‘জীবন যখন শুকায়ে যায়, করুণাধারায় এসো
সকল মাধুরি লুকায়ে যায়, গীতসুধারসে এসো।’
জীবন শেষে জীবনের হৃদয়ভাঙা প্রবল আকুতি আমরা রবীন্দ্রনাথে করুণভাবে পাই। তিনি যখন ‘ওহে পবিত্র, ওহে অনিদ্র’ বলে রুদ্র আলোয় প্রাণনাথকে আসার আহবান জানান তখন তার শান্তচরণে সমর্থিত হওয়ার বড় সাধ জাগে। কিন্তু মানুষ কেন এতো বহুবর্নিল। কেন এতো সীমাহীন স্বপ্নচারী। জগতকে তছনছ করে জগতের সন্ধান পেতে কেন সে এতো মরিয়া। হয়তো রহস্যের সন্ধানই তাকে বাঁচিয়ে রাখে; সচল রাখে বলে। আড়ালে তাকে নিয়ে খেলছেন স্বয়ং বিধাতা।
নাসির ভাইয়ের পুরো জীবন ছিল অনুভূতিপ্রবণ। তার প্রাণ ও বাকশক্তি সম্পন্ন জীবনে ছিল বৈচিত্র। এই প্রেম- এই অনুভূতি বলেই জীবন শত রঙে রঙিন হয়ে উঠেছিল। ভয়, রোগ, ক্ষুধাকে জয় করে আনন্দ ও প্রাপ্তিতেই তিনি ছিলেন তৃপ্ত। মানুষ তো বেঁচে তাঁর কর্মময় জীবনেই। সেটাই স্মৃতির পাপড়ি হয়ে সুবাস বিলায়। সেখানে লুকিয়ে থাকে স্পর্শের পুলক, সুরের আনন্দ, মুগ্ধতা, মনের অপার তৃষ্ণা। কিন্তু এসব কিছুই আপেক্ষিক। ব্যক্তিবোধে এর প্রকাশ ভিন্ন ভিন্ন। সময় ও স্থান ভেদে তার সংস্কৃতি আলাদা। কিন্তু জগতজুড়ে সাদা-কালো এই মানুষের হাসিকান্না, জন্মমৃত্যুর রঙ এক।
মানুষ স্রষ্টার মহাকারিগরি নিদর্শন। সে কোন পাথর-গ্যাসের বিবর্তন বা সাপ-বিচ্ছুর বংশধর নয়। সে পরমের ভালবাসায় সিক্ত। আবার ক্রোধে নিপতিত। এক মহান জীবনবোধ দিয়ে তাকে এই গ্রহে প্রেরণ করা হয়েছে। আদম-হাওয়া মানবমানবীর যৌথ মিলনের ফসল সে। স্বর্গের সাবেক অধিবাসী এই মানবকূল।
সালাহ্ উদ্দিন ইবনে শিহাব: সাংবাদিক ও শিক্ষক