আঁস্তাকুড়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ।। মো. সাইফুল ইসলাম
প্রকাশিত হয়েছে : ২৫ মে ২০২৩, ৭:৩৩ অপরাহ্ণ
শ্রীমঙ্গল সরকারি কলেজের ৫ হাজারেরও অধিক শিক্ষার্থীসহ পার্শ্ববর্তী দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের কথা চিন্তা করে পৌর কর্তৃপক্ষের আবারও কোনও বিকল্প উপায়ের সন্ধান করা জরুরি বলে মনে করি। চিন্তা করতে পারেন পরিবেশবান্ধব আধুনিক বর্জ্যব্যবস্থাপনা পদ্ধতির। যার মাধ্যমে বর্জ্য জঞ্জাল থেকে সম্পদে পরিণত হতে পারে।
বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ এই দেশে বর্জ্যব্যবস্থাপনা সত্যিকার অর্থেই একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ডাম্পিং স্টেশন স্থাপন করার মত জনবসতিহীন বিস্তৃত জায়গা এখন দুষ্প্রাপ্য। এর সাথে আছে গণঅসচেতনতা, আছে সংশ্লিষ্ট মহলের ঔদাসীন্য। ফলে বাড়ছে জনস্বাস্থ্যঝুঁকি, বাধাগ্রস্ত হচ্ছে টেকসই উন্নয়ন। এরকমই একটি সংকটের জটিলাবর্তে স্থবির হয়ে আছে শ্রীমঙ্গল সরকারি কলেজের শিক্ষাকার্যক্রম। উপজেলার সর্বোচ্চ এই সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির মূল ফটকের সামনেই এখন শ্রীমঙ্গল পৌরসভার ময়লা-আবর্জনার বিস্তৃৃত স্তুপ। এক সময় ভাগাড়টি সড়ক থেকে কিছুটা দূরে ময়লার গর্তাকারেই (ট্রেঞ্চ) ছিল। ১৯৩৫ সালে প্রতিষ্ঠিত বর্তমানে ‘ক’ শ্রেণিভুক্ত পৌরসভাটিতে রয়েছে চার হাজারেরও বেশি পরিবার, বাজারের প্রসারতাও নেহাৎ কম নয়। ফলে এক সময়ের ক্ষুদ্র ট্রেঞ্চ গ্রাউন্ডটি প্রসারিত হতে হতে আজ রোডে এসে ঠেকেছে। তার অপরপাশেই কলেজের মূল প্রবেশপথ। পাশেই রয়েছে গাউছিয়া শফিকিয়া সুন্নিয়া দাখিল মাদ্রাসা ও দি বাডস্ রেসিডেনসিয়্যাল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ নামে দুটি স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এসব ময়লা-আবর্জনার পাশ দিয়েই শিক্ষার্থীদের নাকে হাত দিয়ে প্রতিদিন স্কুল-কলেজে আসা-যাওয়া করতে হয়। বাতাসে ছড়িয়ে পড়া দুর্গন্ধ আর রোগ-জীবাণু শিক্ষার্থীদের সুস্থতার জন্য রীতিমত হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুকনার দিনে রোদে শুকানো প্লাস্টিক ব্যাগ, নোংরা কাপড় গার্বেজ থেকে বাতাসে উড়ে গেইটের সামনে গিয়ে আটকে থাকে, এগুলোর কিছু কিছু গেইটের পাল্লার নিচ দিয়ে ভেতরে গিয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে। আর বৃষ্টির দিনে কটূ দুর্গন্ধের কারনে তো শিক্ষার্থীরা কলেজেই আসতে চায় না। ময়লার ভাগাড়ে খাবারের সন্ধানে আসা ক্ষুধার্ত কুকুরগুলোর উৎপাত শিক্ষার্থীদের জন্য আরেক আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনই একটা পরিবেশে আমাদের শিক্ষার্থীরা শিক্ষালাভ করছে।
জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ এ শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হিসেবে বলা হয়েছে শিক্ষার্থীদের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনসহ প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিবেশসচেতনতা এবং তদ্সংক্রান্ত বিষয়ে দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টি করা। শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন ব্যবস্থাগ্রহণ করাও আমাদের জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ এ শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হিসেবে উল্লেখিত হয়েছে। জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (সাসটেইনঅ্যাবল ডেভেলপমেন্ট গোলস্-এসডিজিস) অর্জনে আমরা সাফল্য দেখিয়েছি। এতে যে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে তার পূর্বশর্ত নিশ্চয় মানসম্মত পরিবেশ। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার তৎপরতায় দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে অবকাঠামোগত উন্নয়ন আজ চোখে পড়ার মতো। কোনও অস্বাস্থ্যকর দূষিত পরিবেশের কারণে তা ম্লান হোক তা নিশ্চয় আামরা কেউ চাই না।
এ নিয়ে সংক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন সময়ে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা বন্ধ ও অপসারণের দাবিতে সোচ্চার হয়েছে। স্থানীয় সংসদ সদস্য ও পৌর মেয়রের কাছে লিখিত আবেদন করেছে। সর্বশেষ গত ১১.০৫.২০২৩ তারিখে ভুক্তভোগী সাধারণ শিক্ষার্থীরা শ্রীমঙ্গল শহরের চৌমোহনায় শান্তিপূর্ণ অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছে। কোনও মহল থেকে ইতিবাচক কোনও সাড়া না পেয়ে গত ১৬.০৫.২০২৩ তারিখে কলেজের মূল ফটক তথা বিস্তৃত আবর্জনাস্তুপের সামনেই মানববন্ধন করে এবং সকল ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জন করার মত আত্মঘাতী ঘোষণা দেয়। দেশে তথাকথিত ছাত্ররাজনীতির বাইরে ছাত্রনেতৃত্ব আজ বিরল। সাধারণ শিক্ষার্থীদের মাঝ থেকে প্রয়োজনের তাগিদে বের হয়ে আসা এমন নেতৃত্বের মধ্যে এক সময়ের কলেজ ছাত্রসংসদের নির্বাচিত মেধাবী ছাত্রনেতৃত্বের ঝলকানি দেখতে পেলাম। নেতৃত্ব দানকারী ছেলে-মেয়েগুলোকে ক্লাসে মনোযোগী মেধাবী শিক্ষার্থী হিসেবেই চিনতাম। আজ তাদের এমন সংঘবদ্ধ প্রতিবাদী চেতনার পরিচয় পেয়ে সত্যি কিছুটা হতবাক হলাম। আজকাল আমরাতো সবকিছুকে এক রকম মেনে নিয়েই চলছি। যাই হোক, কলেজের অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ মহোদয় বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের বুঝিয়ে এরূপ আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে আহবান করে ব্যর্থ হন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এসে বিষয়টি নিয়ে ঊর্ধ্বতন মহলে আলোচনা করবেন বলে আশ্বস্ত করেন। কিন্তু বিক্ষুব্ধ সাধারণ শিক্ষার্থীদের এরকম আশ্বাসের অতীত ইতিহাস জানা থাকায় তারা কোন পদক্ষেপ দৃশ্যমান না হওয়া পর্যন্ত ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জনের সিদ্ধান্তে অটল থাকে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে যে কোন ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার আশংকা করে অধ্যক্ষ মহোদয় ২১.০৫.২০২৩ তারিখ রাতে একাডেমিক কাউন্সিলের এক জরুরি বৈঠক আহবান করেন। বৈঠকে উপস্থিত অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের সদস্যবৃন্দের সাথে পরামর্শ করে ২২.০৫.২০২৩ তারিখ থেকে অনুষ্ঠিতব্য একাদশ শ্রেণির সাময়িক পরীক্ষা স্থগিত করে দেন। বিভিন্ন শ্রেণির অভ্যন্তরীণ পরীক্ষা, নানা ধরনের ছুটি, বিভিন্ন দিবস পালনের সাথে বর্তমানে যুক্ত হয়েছে দুই দিন সাপ্তাহিক ছুটি। সব মিলিয়ে এমনিতেই ক্লাসের পরিমাণ অনেক কমে গেছে। তার উপর আছে করোনার (কোভিড ১৯) কারণে সৃষ্ট এলোমেলো শিক্ষাবর্ষ। এখন আবার ক্লাশ বর্জন চললে তা মরার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়াবে।
যতদূর জানতে পেরেছি, সময়ের ব্যবধানে গড়ে ওঠা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও আশেপাশের এলাকাবাসীর ভোগান্তির কথা চিন্তা করে পৌর কর্তৃপক্ষ অন্যত্র জায়গা নিয়ে ডাম্পিং স্টেশন স্থাপনের চেষ্টা চালায়। ২০১৭ সালে শহরের জেটি রোডে পৌরসভা কর্তৃক জমিক্রয় ও অধিগ্রহণ করা হয়। কিন্তু জনৈক ব্যক্তির রিট পিটিশন, মহামান্য উচ্চ আদালত কর্তৃক স্থগিতাদেশ, স্থগিতাদেশ খারিজের পর আবার স্থানীয় লোকজনের বাধা এরূপ নানাবিধ সমস্যার কারণে সেখানে ডাম্পিং স্টেশন করার কাজটি মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে। যে কারণে পৌর কর্তৃপক্ষ আবর্জনার ভাগাড়টি এখান থেকে সরাতে চেয়েছিল, একই কারণে সেখানকার লোকেরা তাতে বাধা দেওয়াটাই স্বাভাবিক। আবার উপযুক্ত স্থানাভাবের কারণে ভাগাড়টি না সরালে তা উল্লিখিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষাকার্যক্রমকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করবে। যে শহরবাসীর ময়লা-আবর্জনা এখানে ফেলা হয়, সে শহরবাসীর সন্তানেরাইতো এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশুনা করে। তাদের সন্তানেরাই আজ তা সরানোর দাবি তুেলছে। দাবিটিও নিশ্চয় অযৌক্তিক অন্যায্য নয়। সমস্যা, সংকট যতই জটিল হোক, এর সমাধান নিশ্চয় আছে। প্রয়োজন উদারতা, আন্তরিকতা আর পারস্পরিক সহযোগিতার। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, গবেষক পরমেশ আচার্য তাঁর ‘বাঙালির শিক্ষাচিন্তা’ গ্রন্থের মুখবন্ধে বলেন, “শিক্ষা, রাজনীতি বা রাজনৈতিক মতাদর্শের ঊর্ধ্বে স্বতন্ত্র এক স্বাধীন ও সর্বজনীন বিষয়।” শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে আঁস্তাকুড়ে রেখে কাদা ছোড়াছুড়ি করা চরম মানসিক দৈন্য আর সংকীর্ণতার পরিচয়। টেকসই সামাজিক উন্নয়নে সবচেয়ে বড় বাধা।
শ্রীমঙ্গল সরকারি কলেজের ৫ হাজারেরও অধিক শিক্ষার্থীসহ পার্শ্ববর্তী দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের কথা চিন্তা করে পৌর কর্তৃপক্ষের আবারও কোনও বিকল্প উপায়ের সন্ধান করা জরুরি বলে মনে করি। চিন্তা করতে পারেন পরিবেশবান্ধব আধুনিক বর্জ্যব্যবস্থাপনা পদ্ধতির। যার মাধ্যমে বর্জ্য জঞ্জাল থেকে সম্পদে পরিণত হতে পারে। হতে পারে কর্মসংস্থান ও আয়ের উৎসও। উন্নত বিশ্বে বিজ্ঞানসম্মত বর্জ্যব্যবস্থাপনায় ইনসিনারেশন, পাইরোলাইসিস, গ্যাসিফিকেশন, কম্পোস্টিং, স্যালভেজিং ইত্যাদি প্রযুক্তির ব্যবহার হচ্ছে। থ্রি আর (রিডিউস, রিসাইকেল, রিইউজ) এর পরিবর্তে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে ফাইভ আর (রিকভারি, রিফিউজ, রিডিউস, রিসাইকেল, রিইউজ) এর উপর। সম্প্রতি এসব ময়লা-আবর্জনা খেয়ে বেঁচে থাকা এক জাতীয় পোকার চাষাবাদ করা হচ্ছে দেশে। পোকাগুলো হাঁস-মুরগি, মাছের খাবার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এগুলো বাজারে চড়া দামে বিক্রি হওয়া ফিডের চেয়েও উপাদেয় বলে বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত। বিশ্বের অন্যতম জনবহুল এই দেশে পরিবেশ, প্রতিবেশকে সুরক্ষিত রাখতে তাই বর্জ্যরে এরূপ পুনর্ব্যবহার নিয়ে আমাদের ভাবা জরুরি।
মো. সাইফুল ইসলাম : প্রভাষক, বাংলা বিভাগ, শ্রীমঙ্গল সরকারি কলেজ