অসমাপ্ত আত্মজীবনী : সমীক্ষা ও সার-সংক্ষেপ ।। মো. সাইফুল ইসলাম
প্রকাশিত হয়েছে : ১৬ মার্চ ২০২২, ১:২২ অপরাহ্ণ
বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীর উপর নাতিদীর্ঘ পর্যালোচনা লিখেছেন মো. সাইফুল ইসলাম, প্রভাষক ও বিভাগীয় প্রধান (ভারপ্রাপ্ত) বাংলা বিভাগ, শ্রীমঙ্গল সরকারি কলেজ। এর আগে এই বই নিয়ে এমন বিস্তর পর্যালোচনা সম্ভবত বাংলাদেশে আর কেউই করেন নি। সাগর সেচে মুক্তা আহরণের মতো লেখক বইয়ের মূল সুর পাঠকের সামনে হাজির করেছেন। অনেকের পক্ষেই হয়তো পুরো বইটি পড়া সম্ভব হয়নি অথবা পড়লেও অনেক কিছুই সেভাবে নাড়া দিতে পারেনি। উভয় শ্রেণীর পাঠকের জন্যই এই পর্যালোচনাটা পড়া জরুরি। শেখ মুজিবুর রহমানের বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠা; তাঁর জীবন ও রাজনীতির বাক ও বিন্যাস সবকিছুই উঠে এসেছে লেখায়। পাঠকের জন্য এই লেখাটি তিন পর্বে প্রকাশ করবে জনপ্রিয় অনলাইন পোর্টাল পূর্বদিকডটকম। আজকে প্রকাশিত হলো ১ম পর্ব। বাকি দুই পর্ব প্রকাশ হবে ১৭ ও ১৮ মার্চ । ধারাবাহিক এই লেখাটি পড়তে চোখ রাখুন পূর্বদিক অনলাইনে। -সহযোগী সম্পাদক
প্রথম পর্ব
`একজন ইতিহাসবিদের রচিত গ্রন্থ পড়ে একটি সময়কে জানা আর একজন রাজনীতিবিদের আত্মজীবনী পড়ে ঐ সময়কে জানার মধ্যে রয়েছে বিস্তর ফারাক। কারণ একজন রাজনীতিবিদ নিজেই সেই ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে থাকেন।’
ভারতবর্ষে শাসকদের আত্মজীবনী রচনার ইতিহাস বেশ প্রাচীন। ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা জহির উদ্দিন মুহম্মদ বাবর লেখেন ‘তুযুক-ই-বাবর’ (বাবরনামা), আরেক মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর ‘তুযুক-ই-জাহাঙ্গীর’ (জাহাঙ্গীরনামা) নামে লেখেন তাঁর আত্মচরিত। আধুনিককালে মহাত্মা গান্ধী ও জওহরলাল নেহেরুও যথাক্রমে `My Story of Experiments with Truth’ ও `An Autobiography toward Freedom’ নামে তাঁদের আত্মজীবনী লেখেন। বিশ্বনেতাদের যারা আত্মজীবনী রচনা করে খ্যাতি অর্জন করেছেন তাঁদের মধ্যে আছেন- দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী কিংবদন্তি নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা (Long Walk to Freedom), সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন (My Life)। এ তালিকা হয়ত আরও দীর্ঘ করা যাবে। তবে প্রাসঙ্গিকতার বিচারে কলেবর আর বিস্তৃত না করাই বোধ হয় সমীচীন হবে। একজন ইতিহাসবিদের রচিত গ্রন্থ পড়ে একটি সময়কে জানা আর একজন রাজনীতিবিদের আত্মজীবনী পরে ঐ সময়কে জানার মধ্যে রয়েছে বিস্তর ফারাক। কারণ একজন রাজনীতিবিদ নিজেই সেই ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে থাকেন। একজন গুণী, ত্যাগী নেতার জীবনের ঘটনা আর ঐ জাতির সমকালীন ঐতিহাসিক ঘটনার মধ্যে সীমারেখা টানা যায় না। জাতীয় জীবনে সংঘটিত নানা ঘটনার সাক্ষ্যই যেন দিয়ে থাকেন একজন মহীয়ান নেতা তাঁর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থে। বাঙালির জাতীয় জীবনে সেই প্রবাদপুরুষ হচ্ছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ৫৫ বছরের জীবৎকালে তিনি রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিলেন মাত্র সাড়ে তিন বছর, বাকি জীবনের বড় একটা অংশ কেটেছে কারাগারের নির্জন প্রকোষ্ঠে। জেল-ই যেন অলস সময় কাজে লাগানোর মোক্ষম সুযোগ। তাই জওহরলাল নেহেরুর মত জেলে বসেই শুরু করেন জীবনগাথা রচনা। যা আজ আমাদের জন্য এক মহামূল্যবান রাষ্ট্রিক দলিল হয়ে উঠেছে। সেই সাথে জানান দিয়েছে নতুন এক বঙ্গবন্ধুকে। ১৯৬৬-১৯৬৯ সালে কেন্দ্রীয় কারাগারে রাজবন্দি থাকাকালে বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবনের ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত সময়ের ঘটনাগুলো ধারাবাহিকভাবে লিপিবদ্ধ করেন। যা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ নামে ২০১২ সালে প্রথম গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। মোট চারটি খাতায় আত্মজীবনীর মত করে লেখা এ গ্রন্থের পা-ুলিপি হাতে আসাও ছিল রীতিমত এক অপ্রত্যাশিত ঘটনা। বইটির ভূমিকা অংশে বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তা ব্যক্ত করেছেন। এখানে উল্লেখ করতে হয় যে, কারাবন্দি জীবনে বসে লেখা বঙ্গবন্ধুর এ আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থটির ভূমিকা লেখার সময় শেখ হাসিনাও ছিলেন কারাবন্দি। বিষয়টি কাকতালীয় হলেও তাৎপর্যপূর্ণ।
‘ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ছোট্ট কোঠায় বসে বসে জানালা দিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে চেয়ে ভাবছি, সোহরাওয়ার্দী সাহেবের কথা। কেমন করে তাঁর সাথে আমার পরিচয় হল। কেমন করে তাঁর সান্নিধ্য আমি পেয়েছিলাম। কিভাবে তিনি আমাকে কাজ করতে শিখিয়েছিলেন এবং কেমন করে তাঁর স্নেহ আমি পেয়েছিলাম।”
বন্ধুবান্ধব ও সহধর্মিনী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছার পরামর্শে বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবনী লেখতে অনুপ্রাণিত হন। আর তাঁর ভাবনা-চিন্তার মধ্যে সর্বাধিক প্রভাব বিস্তারকারী ব্যক্তি অবিভক্ত বাংলার শেষ মুখ্যমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর কথা রয়েছে গ্রন্থটির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। গ্রন্থটির শুরুতেই বঙ্গবন্ধুর এক আবেগঘন বিবৃতি- ‘ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ছোট্ট কোঠায় বসে বসে জানালা দিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে চেয়ে ভাবছি, সোহরাওয়ার্দী সাহেবের কথা। কেমন করে তাঁর সাথে আমার পরিচয় হল। কেমন করে তাঁর সান্নিধ্য আমি পেয়েছিলাম। কিভাবে তিনি আমাকে কাজ করতে শিখিয়েছিলেন এবং কেমন করে তাঁর স্নেহ আমি পেয়েছিলাম।’ বস্তুত এ বইটি যদি একটি উপন্যাস হয় তাহলে এর নায়ক বঙ্গবন্ধু না হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী তা নিয়ে বিস্তর বিতর্ক হতে পারে। বঙ্গবন্ধুর একটি কথাই তাঁর উদারতা সম্পর্কে জানতে যথেষ্ট- ‘মুসলিম লীগের ফান্ড ও অর্থ মানে শহীদ সাহেবের পকেট।’ দলে পদ-পদবি পেতে আজকাল অর্থের ব্যাপক ছড়াছড়ি লক্ষ করা যায়। অথচ টাকা খরচ করে নেতা হওয়ার প্রস্তাবকে ঘৃণা ভরে প্রত্যাখান করেছিলেন সোহরাওয়ার্দী। লেখক শেখ মুজিবুর রহমান তা তাঁর প্রত্যক্ষ উক্তিতে তুলে ধরেছেনÑ ‘টাকা আমি কাউকেও দেব না, এই অসাধু পন্থা অবলম্বন করে নেতা আমি হতে চাই না।’ নির্মোহ মহৎ এই নেতা সম্পর্কে মুজিব বলেন, ‘ইচ্ছা করলে কারফিউ জারি করে নির্বাচন কয়েকদিনের জন্য বন্ধ করে দিতে পারতেন। কারণ, তখনও তিনি প্রধানমন্ত্রী আছেন। পদের লোভ যে তাঁর ছিল না, এটাই তার প্রমাণ। কোনোমতে পদ আঁকড়িয়ে থাকতে হবে, এটা তিনি কোনোদিন চাইতেন না। ষড়যন্ত্রের রাজনীতিতে বিশ্বাস করতেন না।’ দীর্ঘদিন অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। অথচ দেশভাগের পর তাঁকে অনেকটা নিঃস্ব অবস্থায় কলকাতা ছাড়তে হয়। বঙ্গবন্ধুর কথা- ‘অনেকে শুনে আশ্চর্য হবেন, শহীদ সাহেবের কলকাতায় নিজের বাড়ি ছিল না। ৪০ নম্বর থিয়েটার রোডের বাড়ি, ভাড়া করা বাড়ি। তিনি করাচিতে তাঁর ভাইয়ের কাছে উঠলেন, কারণ তাঁর খাবার পয়সাও ছিল না।’ নিঃস্বার্থ ত্যাগী এই নেতাই ছিলেন বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দীক্ষাগুরু ও মডেল।
মধুমতী নদীর তীরঘেঁষা গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে শেখ বংশের পত্তন। পূর্বপুরুষের জৌলুশ, আর্থিক প্রতিপত্তিতে এক সময় ভাটা পড়ে। মামলা-মকদ্দমায় পড়ে ব্যবসা, জমিদারি হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয় শেখ পরিবার। শুধু পারিবারিক ঐতিহ্য আর আভিজাত্যটুকুই বজায় ছিল। বঙ্গবন্ধুর দাদার আকস্মিক মৃত্যুতে তাঁর বাবাকেই সংসারের হাল ধরতে হয়। একই বংশের লোকদের মধ্যে বিয়ে-শাদি যেন শেখ পরিবারের এক রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর বাবা তাঁর বাবার মত চাচাতো বোনকে বিয়ে করেন। বঙ্গবন্ধুও বিয়ে করেন তাঁর চাচাতো বোনকে। মাত্র ১৩ বছর বয়সে পারিবারিক সিদ্ধান্তে সংঘটিত নিজের বিয়ে সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি শুনলাম আমার বিবাহ হয়েছে। তখন কিছুই বুঝতাম না, রেণুর (বেগম ফজিলাতুন্নেছা) বয়স তখন বোধহয় তিন বছর হবে।’ বঙ্গবন্ধুর দাদা খান সাহেব শেখ আব্দুর রশিদ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত সেই অঞ্চলের একমাত্র ইংরেজি স্কুল এম ই স্কুলে তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার হাতেখড়ি। বাবার গোপালগঞ্জ দেওয়ানি আদালতে চাকরির সুবাদে গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯৩৪ সালে সেই স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে পড়াকালীন বঙ্গবন্ধু বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত হলে তাঁর হৃদযন্ত্র দুর্বল হয়ে পড়ে। চিকিৎসার জন্য কলকাতায় যাওয়া-আসা ও অবস্থান করে তাঁর শিক্ষাজীবন থেকে প্রায় দুটি বছর ঝড়ে পড়ে। এর মধ্যে ১৯৩৬ সালে বাবা সেরেস্তাদার হয়ে মাদারীপুর মহকুমায় বদলি হন। তাই মাদারীপুর হাইস্কুলে আবার তাঁকে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হতে হয়। রোগবালাই যেন তাঁর পিছু ছাড়ছে না। ১৯৩৬ সালে আবার গ্লুকোমা রোগে আক্রান্ত হয়ে চোখ খারাপ হয়ে যায়। চিকিৎসকের পরামর্শে তখন থেকেই সাথী হয় কালো ফ্রেমের সেই চিরচেনা চশমা। আদুভাই হয়ে আবার একই স্কুলের একই ক্লাসে ভর্তি হতে বালক মুজিবের কোথায় যেন বাধল। ১৯৩৭ সালে তাই গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে ভর্তি হয়ে পুনরায় লেখাপড়া শুরু করেন। বাবাও পুনরায় গোপালগঞ্জে ফিরে আসেন। এবার ছেলের জন্য একজন গৃহশিক্ষক রাখলেন। সেই গৃহশিক্ষকের সংস্পর্শে এসে মুজিব পেলেন সেবার প্রথম দীক্ষা। অনগ্রসর মুসলমান সামাজে শিক্ষাবিস্তার ঘটাতে ও শিক্ষা সহায়তা দিতে গৃহশিক্ষক গঠন করেন ‘মুসলিম সেবা সমিতি।’ গৃহশিক্ষকের মৃত্যুতে কিশোর মুজিব সেই সমিতির ভার নিলেন, হলেন সমিতির সম্পাদক। ১৯৩৮ সালে একটি ঘটনার মাধ্যমে বাংলায় হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কে দলীয় রাজনীতির প্রভাব বঙ্গবন্ধুর মনে গভীর রেখাপাত করে। বাংলার প্রধান দুই নেতা শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক (বাংলার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী) ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর (তৎকালীন শ্রমমন্ত্রী) গোপালগঞ্জে আসার আয়োজন চলছে। কংগ্রেসের নির্দেশে হিন্দু ছাত্ররা এর বিরোধিতা করে। মুসলীম লীগের সাথে ফজলুল হকের মন্ত্রিসভা গঠন এর মূল কারণ। বঙ্গবন্ধু এতে হতাশ হলেও মুসলিম ছেলেদের নিয়ে স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করে যান। তাঁর সাথে পরিচয় ঘটে জনপ্রিয় নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর। রতনে রতন চিনে। সোহরাওয়ার্দীও সেদিন এক তেজোদ্দীপ্ত নির্ভীক ভবিষ্যৎ নেতার আভাস পেলেন তাঁর মাঝে। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বিখ্যাত সংবাদিক ফজলে লোহানীর মন্তব্যটি উল্লেখ করা যেতে পারে- ‘গোপালগঞ্জের মিশন স্কুলে সেই অপরাহ্ণের আশ্চর্য আলোয় একজন অভিজ্ঞ কামার খুঁজে পেলেন একটা ছোট্ট লোহার খন্ড। একে প্রত্যক্ষ রাজনীতির আগুনে তাঁতিয়ে শাণিত অস্ত্রে পরিণত করতে হবে। সোহরাওয়ার্দী এই প্রথম তাঁর একলব্যকে খোঁজে পেয়েছেন। একে ছাড়া যাবে না কখনও।’ (জয় বাংলা সাক্ষাৎকার ১৯৭০-১৯৭৫, সংগ্রহ ও সম্পাদনা : নুরুল ইসলাম নাহিদ ও পিয়াস মজিদ, পৃষ্ঠা ৩৭) উভয়ের মধ্যে চলে চিঠি চালাচালি। এরই মধ্যে দুই নেতার আগমনের জের ধরে হিন্দুদের বাড়াবাড়িতে রীতিমত সংঘর্ষ বাধে। বঙ্গবন্ধুকে জীবনে প্রথমবারের মত জেল হাজতে থাকার অ্যাসিড টেস্ট নিতে হয়। সাত দিন পর জামিনে মুক্ত হন, কিন্তু যুক্ত হতে থাকেন বিকাশমান সমকালীন রাজনীতির স্রোতধারার সাথে। ১৯৩৯ সালে কলকাতায় বেড়াতে এসে দেখা করেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাথে। ফিরে গিয়ে গঠন করেন মুসলিম ছাত্রলীগ। তিনি হন সংগঠনটির সম্পাদক। মুসলিম লীগ ডিফেন্স কমিটিরও সম্পাদক হলেন তিনি। এভাবেই মুসলিম লীগের রাজনীতিতে তাঁর অনুপ্রবেশ ঘটে। ১৯৪১ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা দিয়ে আবার কলকাতা ছুটেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর স্নেহপরশ তাঁকে রাজনীতেতে টেনে নিয়ে যায়। দ্বিতীয় বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষা পাস করে ভর্তি হন কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে, থাকেন বেকার হোস্টেলে। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে সক্রিয় হয়ে উঠেন মুসলিম লীগের রাজনীতিতে। বাংলাদেশের মাটিতে মুসলিম লীগের জন্ম হলেও বাংলার আপামর জনসাধারণের সাথে দলটির কোনও সম্পৃক্ততা ছিল না। দলটি নিয়ে তাই তরুণ মুজিবের ভাবনা- ‘শহীদ সাহেবের নেতৃত্বে আমরা বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোকেরা মুসলিম লীগকে জনগণের লীগে পরিণত করতে চাই। মুসলিম লীগ তখন পর্যন্ত জনগণের প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয় নাই। জমিদার, জোতদার ও খান বাহাদুর নবাবদের প্রতিষ্ঠান ছিল। কাউকেও লীগে আসতে দিত না। জেলায় জেলায় খান বাহাদুরের দলেরাই লীগকে পকেটে করে রেখেছিল।’
১৯৪৩ এর দুর্ভিক্ষের এক মর্মন্তুদ বর্ণনা উঠে এসেছে এ গ্রন্থে- ‘খাবার নাই, কাপড় নাই। ইংরেজ যুদ্ধের জন্য (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ) সমস্ত নৌকা বাজেয়াপ্ত করে নিয়েছে। ধান, চাল সৈন্যদের খাওয়াবার জন্য গুদাম জব্দ করেছে। যা কিছু ছিল ব্যবসায়ীরা গুদামজাত করেছে। ফলে এক ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ব্যবসায়ীরা দশ টাকা মণের চাউল চল্লিশ-পঞ্চাশ টাকায় বিক্রি করছে। এমন দিন নাই রাস্তায় লোকে মরে পড়ে থাকতে দেখা যায় না।’ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম মিত্রশক্তি ব্রিটেন প্রবল অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে তার উপনিবেশগুলোর শক্তি-সম্পদ যুদ্ধে ব্যয় করতে থাকে। বঙ্গবন্ধুর ভাষ্য, ‘ইংরেজের কথা হল, বাংলার মানুষ যদি মরে তো মরুক, যুদ্ধের সাহায্য আগে। যুদ্ধের সরঞ্জাম প্রথম স্থান পাবে। ট্রেনে অস্ত্র যাবে, তারপর যদি জায়গা থাকে তবে রিলিফের খাবার যাবে। যুদ্ধ করে ইংরেজ, আর না খেয়ে মরে বাঙালি; যে বাঙালির কোনো কিছুরই অভাব ছিল না।’ এক্ষেত্রে কংগ্রেসের দৃষ্টিভঙ্গিও ছিলও অনুরূপ- ‘এই যুদ্ধে ভারতের সম্পদ ব্যবহার করাকে কংগ্রেস এ দেশের জনগণের প্রতি এক ধরনের প্রকাশ্য অপমান হিসেবে মনে করে, যা কোনো আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন ও স্বাধীনতাপ্রিয় জাতি গ্রহণ বা সহ্য করতে পারে না।’ (লেখক : মওলানা আবুল কালাম আজাদ, গ্রন্থ: ইন্ডিয়া উইনস ফ্রিডম)
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পাকিস্তান আন্দোলন জোরালো হতে থাকে। শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক ঘোষিত ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের মূলকথা মুজিব এ গ্রন্থে স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেছেন, ‘পাকিস্তান দুইটা হবে, লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে। একটা বাংলা ও আসাম নিয়ে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র; আর একটা পশ্চিম পাকিস্তান স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হবে- পাঞ্জাব, বেলুচিস্তান, সীমান্ত ও সিন্ধু প্রদেশ নিয়ে। অন্যটা হবে হিন্দুস্তান।’ আবুল মনসুর আহমদ তাঁর ‘শেরে বাংলা হইতে বঙ্গবন্ধু’ গ্রন্থেও একই কথাই বলেন, ‘লাহোর প্রস্তাবের মর্ম এই যে ভারতবর্ষের উত্তর-পূর্ব ও উত্তর-পশ্চিম কোণে দুইটি স্বাধীন মুসলিম-মেজরিটি রাষ্ট্র গঠিত হইবে। এর ফলে গোটা ভারতবর্ষ তিনটি স্বাধীন রাষ্ট্রে বিভক্ত হইবে। দুই পাশের দুইটি ক্ষুদ্রতর রাষ্ট্র হইবে মুসলিম-মেজরিটি রাষ্ট্র, আর মধ্যেকার বৃহত্তর অংশ হইবে হিন্দু মেজরিটি রাষ্ট্র।’ কিন্তু কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের গোয়ার্তুমির কারণে তা বাস্তবায়িত করা সম্ভব হয়নি। তবে ১৯৭১ সালে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা লাহোর প্রস্তাবের নির্ভুলতাই প্রমাণ করে। মাঝখানের ২৩/২৪ বছর বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে পাকিস্তানের নব্য ঔপনিবেশিক অপশাসনের এক কলঙ্কিত অধ্যায়। যা থেকে উত্তরণের জন্য এক চড়া মূল্য দিতে হয়েছে বাঙালিকে। আবুল মনসুর আহমদ বলেন, ‘শেরে বাংলা ফজলুল হক ১৯৪০ সালে লাহোরে যা শুরু করিয়াছিলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালে তা সমাপ্ত করিয়াছেন।’ (শেরে বাংলা হইতে বঙ্গবন্ধু, পৃষ্ঠা ১১) জিন্নাহের সাথে মতাদর্শগত দ্বন্দ্ব থাকলেও কেবল পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার স্বার্থে বাংলার জনপ্রিয় নেতারা মুসলিম লীগের রাজনীতি করেন। তবে বাংলার খান সাহেব-নবাব বংশের লোকেরা যে মুসলিম লীগ করতেন তাতে ছিল জিন্নাহের তাবেদারি আর ক্ষমতালিপ্সা। কলকাতা কেন্দ্রিক বাংলার মুসলিম লীগের রাজনীতি তখন দুটি পক্ষে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এক পক্ষের নেতৃত্বে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আরেক পক্ষের নেতৃত্বে খাজা নাজিমুদ্দীন। এক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধরু এই মন্তব্য প্রণিধানযোগ্যÑ ‘মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠান পূর্বে ছিল খান সাহেব, খান বাহাদুর ও ব্রিটিশ খেতাবধারীদের হাতে, আর এদের সাথে ছিল জমিদার, জোতদার শ্রেণীর লোকেরা। এদের দ্বারা কোনোদিন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হত না। শহীদ সাহেব ও হাশিম সাহেব যদি বাংলার যুবক ও ছাত্রদের মধ্যে মুসলিম লীগকে জনপ্রিয় না করতে পারতেন এবং বুদ্ধিজীবী শ্রেণীকে টেনে আনতে না পারতেন, তাহলে কোনোদিনও পাকিস্তান আন্দোলন বাংলার কৃষকদের মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করতে পারত না।’ এ কথার সমর্থন পাওয়া যায় আবুল মনসুর আহমদের ‘শেরেবাংলা হইতে বঙ্গবন্ধু’ গ্রন্থে, ‘কায়েদে-আযম যেমন পাকিস্তান রাষ্ট্রের পিতা, শহীদ সোহরাওয়ার্দী তেমনি পাকিস্তানী জাতির পিতা।’
বঙ্গবন্ধু এ গ্রন্থে কংগ্রেস নেতাদের ভারত বিভাগের বিরোধিতার কারণ উল্লেখ করে বলেন, ‘তাঁদের (কংগ্রেস নেতাদের) বক্তব্য ছিল যে, ভারতবর্ষ এক থাকলে দশ কোটি মুসলমানের উপর হিন্দুরা অত্যাচার করতে সাহস পাবে না। তাছাড়া কতগুলো প্রদেশে মুসলমান সংখ্যাগুরু আছে। আর যদি পাকিস্তান ও হিন্দুস্থান দুইটা রাষ্ট্র হয়, তবে হিন্দুস্থানে যে সমস্ত মুসলমানরা থাকবে তাদের অস্তিত্ব থাকবে না।’ কংগ্রেস নেতা মওলানা আবুল কালাম আজাদ তাঁর ‘ইন্ডিয়া উইনস ফ্রিডম’ গ্রন্থে অখ- ভারত সমর্থনের একই যৌক্তিকতার কথা বলেছেন, ‘যদি বাস্তবে কখনো দেশ বিভাগ হয়, তবে তারা (ভারতীয় মুসলমান) একদিন জেগে উঠে দেখবে যে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান পাকিস্তানে চলে যাওয়ার পর তারা ভারতে একটি ক্ষুদ্র ও গুরুত্বহীন সংখ্যালঘু হিসেবে বিরাজ করছে।’ পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু এর বিপরীতে মুসলিম লীগের বক্তব্যও তুলে ধরেছেন, ‘অন্যদিকে মুসলিম লীগের বক্তব্য পরিষ্কার, পাকিস্তানের হিন্দুরাও সমান নাগরিক অধিকার পাবে। আর হিন্দুস্থানের মুসলমানরা সমান নাগরিক অধিকার পাবে। লাহোর প্রস্তাবে একথা পরিষ্কার করে লেখা আছে।’ একই কথা সোহরাওয়ার্দীর উদ্ধৃতি দিয়ে আবুল মনসুর আহমদ তাঁর ‘শেরেবাংলা হইতে বঙ্গবন্ধু’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘আমাদের মনে রাখিতে হইবে, দেশের ভূখন্ডই ভাগ হইয়াছে; দেশের বাসিন্দা ভাগ হয় নাই। লোক স্থানান্তরিত হইবে না, এই শর্তেই দেশ ভাগ হইয়াছে।’ বঙ্গবন্ধ নির্দ্বিধায় আমাদের জাতীয় চরিত্রের নেতিবাচক দিকগুলোও চিহ্নিত করেছেন। পরশ্রীকাতরতা, অন্ধ বিশ্বাস, কুসংস্কারচ্ছন্নতাকে তিনি বাঙালির পরাধিনতা ও দুঃখ-দুর্দশার কারণ হিসেবে দেখেছেন।
১৯৪৩ সালে দুর্ভিক্ষকালীন বাস্তবতায় খাজা নাজিমুদ্দীনের নেতৃত্বাধীন প্রাদেশিক মুসলিম লীগ সরকারের পতন ঘটে। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের বিশেষ ক্ষমতাবলে গভর্নর শাসনক্ষমতা নিজ হাতে তুলে নেন। তারপর ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে বাংলার প্রাদেশিক মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দের মধ্যে বিভক্তির সৃষ্টি হয়। যার একপাশে ছিলেন খাজা নাজিমুদ্দীন ও অন্যপাশে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। অবশেষে অবিভক্ত বাংলার তৃতীয় ও শেষ মন্ত্রিসভা গঠিত হয় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে। ভারতবর্ষের ১১টি প্রদেশের মধ্যে মুসলিম অধ্যুষিত চারটি প্রদেশ- বাংলা, সিন্ধু, পাঞ্জাব ও সীমান্ত প্রদেশ। তার মধ্যে কেবল বাংলায়ই মুসলিম লীগ এককভাবে সরকার গঠন করে। জিন্নাহ ঘোষিত ১৯৪৬ সালে ৭, ৮ ও ৯ এপ্রিল নিখিল ভারত মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের কনভেনশনে যোগদান করতে বঙ্গবন্ধু দিল্লী যান। এ সময় তিনি আজমির শরিফে উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ সুফি সাধক খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি র. এর মাজার, লাল কেল্লা, কুতুব মিনার, জামে মসজিদ, আগ্রাদুর্গ, তাজমহল প্রভৃতি ঐতিহাসিক স্থান দর্শন করেন। এক সময় দিল্লিকেন্দ্রিক মুসলিম শাসনের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস বঙ্গবন্ধুকে আবেগাপ্লুত ও ব্যথিত করে। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘শত শত বৎসর মুসলমানরা দিল্লি থেকে সমস্ত ভারতবর্ষ শাসন করেছে। তখন কি জানতাম, এই দিল্লির উপর আমাদের কোনো অধিকার থাকবে না।’
১৯৪৬ সালের আগস্টে কলকাতায় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার প্রত্যক্ষদর্শী লেখক শেখ মুজিবুর রহমান। উভয় সম্প্রদায়ের দাঙ্গাবাজ লোকদের আক্রমন থেকে সাধারণ হিন্দু-মুসলমানদের বাঁচাতে তাঁদের প্রাণপাত চেষ্টা চলে। বঙ্গবন্ধুর মনে হয়েছে মানুষ তার মানবতা হারিয়ে পশুতে পরিণত হয়েছে। দাঙ্গার প্রত্যক্ষ বর্ণনা, ‘কলকাতা শহরে শুধু মরা মানুষের লাশ বিক্ষিপ্তভাবে পড়ে আছে। মহল্লার পর মহল্লা আগুনে পুড়ে গিয়েছে। এক ভয়াবহ দৃশ্য! মানুষ মানুষকে এইভাবে হত্যা করতে পারে, চিন্তা করতেও ভয় হয়!” দাঙ্গা দমনে মুসলিম লীগ কর্মী হিসেবে বিহারে ছুটে যান। বাংলায় সোহরাওয়ার্দী সরকার যে কোন সাহায্য দিতে প্রস্তুত ছিলেন। পাটনা থেকে অসুস্থ শরীর নিয়ে কলকাতায় ফিরেন বঙ্গবন্ধু। ১৫ দিন হাসপাতালে থেকে হোস্টেলে ফিরেন। বিএ পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে বইপত্র নিয়ে চলে যান হাওড়ার এক বন্ধুর বাসায়। পরীক্ষার পূর্বে কলকাতায় এসে পার্ক সার্কাসে ছোট বোনের বাসায় উঠেন। বিএ পরীক্ষায় পাসও করেন।
১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষভাগ সম্পর্কিত অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উঠে এসেছে তাঁর লেখায়। বাংলার মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ পাকিস্তান চেয়েছিলেন সেই পাকিস্তানের সাথেই চেয়েছিলেন অখ- অর্থাৎ সমগ্র বাংলাকে। শুধু বাংলা নয়, আসামকেও পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করা হবে বলে তাঁদের ধারণা ছিল। বঙ্গবন্ধুর কথা, ‘বাংলাদেশ যে ভাগ হবে, বাংলাদেশের নেতারা তা জানতেন না। সমগ্র বাংলা ও আসাম পাকিস্তানে আসবে এটাই ছিল আমাদের ধারণা।’ কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা দিল্লীতে বসে মেনে নেন ভারত বিভাজনের অন্যায্য ফর্মুলা। ভারত ভাগ বিষয়ে বেঙ্গল মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটির এক ফর্মুলা ছিল অনেক যৌক্তিক ও ন্যায্য। সেখানে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশ হবে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। জনগণের ভোটে নির্বাচিত গণপরিষদ নির্ধারণ করবে বাংলাদেশ কার সাথে থাকবে, পাশাপাশি আরেকটি বিকল্প পছন্দ থাকতে পারে স্বাধীন থাকার। এই প্রস্তাব নিয়ে বাংলার মুসলিম লীগ নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও কংগ্রেস নেতা শরৎ বসু দিল্লিতে দুই দলের শীর্ষ নেতা জিন্নাহ ও গান্ধীজীর সাথে দেখা করতে যান। বঙ্গবন্ধু এ গ্রন্থটিতে শরৎ বসুর উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন জিন্নাহ সেই প্রস্তাবে রাজি হয়েছিলেন কংগ্রস সম্মত হওয়ার শর্তে। কিন্তু দুঃখের বিষয় মহাত্মা গান্ধী ও পন্ডিত জহরলাল নেহেরু এ প্রস্তাবে নিরব থাকলেও সরদার বল্লভ ভাই প্যাটেল রীতিমত ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। তিনি শরৎ বসুকে উদ্দেশ্য করে বলেন ‘শরৎ বাবু পাগলামি ছাড়েন, কলকাতা আমাদের চাই।’ অর্থাৎ বাংলা ভাগ হয়েই হোক, আর অখ- থেকেই হোক কলকাতা তাদের লাগবেই। অথচ খাজা নাজিমুদ্দীন ১৯৪৭ সালের ২২ এপ্রিল ঘোষণা করেছিলেন যে, যুক্ত বাংলা থাকলে হিন্দু-মুসলমানের মঙ্গলই হবে। প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি হিসেবে মাওলানা আকরাম খাঁ বলেছিলেন যে, তাঁর রক্তের উপর দিয়ে বাংলাদেশ ভাগ হবে। তাঁর জীবন থাকতে বাংলাদেশ ভাগ করতে দেবেন না। সমস্ত বাংলাদেশই পাকিস্তানে যাবে। অথচ বাংলা ভাগের জন্য অনেকেই মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দকে একতরফাভাবে দায়ী করেন। তবে কলকাতা পশ্চিমবঙ্গের সাথে স্বেচ্ছায় ছেড়ে দেওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধু কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ নেতাদের দুরভিসন্ধিকে দায়ী করেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্যও করেছেন- “নেতারা যদি নেতৃত্ব দিতে ভুল করে, জনগণকে তার খেসারত দিতে হয়।’
লেখক : মো. সাইফুল ইসলাম : প্রভাষক (বাংলা), শ্রীমঙ্গল সরকারি কলেজ।