সমাজচ্যুত থেকে মুক্তি পেল সেই মেয়েটির পরিবার
প্রকাশিত হয়েছে : ২ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ৮:৪৭ অপরাহ্ণ
বিশেষ প্রতিনিধি::
মেয়ের স্বাধীন চলাফেরা ও বিদেশে অন্য সম্প্রদায়ের বন্ধুকে বিয়ে করার অভিযোগ এনে মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় একটি পরিবারকে সমাজচ্যুতের অভিযোগ উঠেছিল। স্থানীয় প্রশাসনের হস্তক্ষেপে সেই পরিবার সমাজচ্যুত থেকে মুক্তি পেয়েছেন।
মঙ্গলবার (১ ফেব্রুয়ারি) রাতে কুলাউড়া উপজেলার ভাটেরা ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে সেই পরিবার ও গ্ৰামের মসজিদ কমিটির সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এটিএম ফরহাদ চৌধুরী।
সেখানে উপস্থিত ছিলেন কুলাউড়া থানার ওসি বিনয় ভূষণ দেব, স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান সৈয়দ নজরুল ইসলাম, সমাজচ্যুতির অভিযোগ তোলা ঝর্ণা চৌধুরীর বাবা আব্দুল হাই চৌধুরী এবং কৃষ্ণপুর গ্রামের মসজিদের সভাপতি মাখন মিয়া ও সম্পাদক আমিন মিয়া।
বৈঠক শেষে ইউএনও এটিএম ফরহাদ চৌধুরী বলেন, এইমাত্র মিটিং শেষ করলাম। দুই পক্ষকে নিয়ে বসেছিলাম। সেখানে মসজিদ কমিটির সভাপতি ও সম্পাদক উপস্থিত ছিলেন। তারা জানান, তারা বয়স্ক মানুষ, তাই ইন্টারনেট চালাতে পারেন না। এলাকায় রটে যায় যে ঝর্ণা একটি হিন্দু ছেলেকে বিয়ে করেছে। তাই তার বাবাকে তারা (মসজিদের সভাপতি ও সম্পাদক) ডাকায়, কিন্তু উনি না আসায় তারা বলেন যে উনি উনার মতো চলুক, আমরা আমাদের মতো চলব।
ইউএনও আরও বলেন, তবে আজ তারা ভুল বুঝতে পেরে দুঃখ প্রকাশ করেছেন ঝর্ণার বাবার কাছে। সেই সঙ্গে লিখিত দিয়েছেন যে ফিউচারে আর এমন কিছু করবেন না। ঝর্ণার পরিবারও খুশি হয়েছেন, তারাও লিখিত দিয়েছেন যে তারা এখন খুশি।
মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার ভাটেরা ইউনিয়নের কৃষ্ণপুর গ্রামে ঘটনা এই ঘটনা ঘটেছে। নুরুননাহার চৌধুরী ঝর্ণা নামের এক মেয়ে সম্প্রতি আইন বিষয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে গেছেন। এরপরও মেয়ের চালচলনে এলাকাবাসীর দৃষ্টি পরলে এই ঘটনা ঘটে। সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন থেকে রক্ষা পেতে ঝর্ণার বাবা হাজি আব্দুল হাই চৌধুরী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর একটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।
অভিযোগপত্র থেকে জানা যায়, ঝর্ণা ২০০৮ সাল থেকে ‘পজিটিভ জেনারেশন অব সোসাইটি বাংলাদেশ’ নামের একটি সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। ২০১৩ সাল থেকে সংগঠনটির প্রধান সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করে আসছেন তিনি। নারী অধিকার, নারী শিক্ষা নিয়ে স্থানীয়ভাবে নানা রকম কর্মসূচি হাতে নিয়ে কাজ শুরু করেছেন তিনি। এসবের জন্য এলাকার কিছু মানুষ তাঁকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখত। ২৬ ডিসেম্বর উচ্চশিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে যান ঝর্ণা। সেখানে তাঁর সংগঠনের চেয়ারম্যান জয়তূর্য চৌধুরীসহ কয়েকজন বিমানবন্দরে তাঁকে রিসিভ করতে আসা ব্যক্তিদের সঙ্গে ছবি তুলে তা ফেসবুকে প্রকাশ করেন। যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে যাওয়া এবং ফেসবুকের এই ছবি নিয়ে স্থানীয় অনেকে নেতিবাচক মন্তব্য করেন।
এ ঘটনার পর আব্দুল হাইয়ের কাছে মেয়ের যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে জয়তূর্য চৌধুরীর সঙ্গে চলাফেরা এবং ছোট কাপড় পরিধানের কারণ জানতে চায় এলাকার পঞ্চায়েতের লোকজন। এ সময় মেয়ের এমন জীবনাচরণের কারণে তাঁকে একঘরে করার হুমকিও দেওয়া হয় বলে অভিযোগ ঝর্ণার বাবার।
এরপর স্থানীয় ভাটেরা বাজার কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি সামছুল ইসলাম মাখন ও সাধারণ সম্পাদক আমিন মিয়া, কৃষ্ণপুর এলাকার বাসিন্দা শেখ টি এম মাছুম, এলাকার প্রবীণ বাবলু মিয়া, পংকি মিয়া, পাখি মিয়াসহ অনেকে ঝর্ণার বিচার করার জন্য চাপ দিয়ে যাচ্ছিলেন। ঝর্ণার বাবাকে পঞ্চায়েত কমিটির সভায় উপস্থিত থাকার জন্য চাপ দিচ্ছিলেন। এমনকি মেয়ের হয়ে তাঁর বাবাকে দোষ স্বীকার করে বক্তব্য দিতে বলা হয়েছিল বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ আছে। তবে অসুস্থ থাকায় সভায় যেতে পারেননি ঝর্ণার বাবা।
ঝর্ণার বাবা আব্দুল হাই চৌধুরী বলেন, আমি অসুস্থ থাকায় বৈঠকে যেতে পারিনি। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে তাঁরা আমাদেরকে সমাজচ্যুত করে একঘরে করার সিদ্ধান্ত নেন। আমরা চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। সামাজিকভাবে আমাদের মর্যাদাহানি হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রে থাকা ঝর্ণা চৌধুরী বলেন, আমি কী পোশাক পরব, কার সঙ্গে ছবি তুলব, কার সঙ্গে চলব সেটা আমার সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত অধিকার। সেটা তো আমাকে এলাকার লোক নির্ধারণ করে দিতে পারে না। মসজিদ কমিটির লোকজন অতি উৎসাহী হয়ে অনধিকার চর্চার মাধ্যমে আমার পরিবারকে একঘরে করে দিয়েছে। এসব নারীবিদ্বেষী, মৌলবাদীদের অনেক আগেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারতাম। তবে অভিযুক্তরা ইউপি চেয়ারম্যানের কাছের লোক হওয়ায় তাঁর কাছে অভিযোগ করেও লাভ হয়নি।