লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান
ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে বনের জমি দখল, রক্ষক হয়ে ভক্ষকে পরিণত হলেন এমপি আব্দুস শহীদ
প্রকাশিত হয়েছে : ২৩ জানুয়ারি ২০২২, ৯:৪৯ অপরাহ্ণ
মোঃ হাসান আহমদ ঃঃ
১৯৯৭ সালে লাউয়াছড়াকে সংরক্ষিত বন হিসেবে ঘোষণার পর এই বনের প্রতি পর্যটকদের আগ্রহ যেমন বেড়েছে তেমনি বেড়েছে দখলও। মৌলভীবাজার-৪ সংসদীয় আসনের মধ্যেই লাউয়াছড়ার অবস্থান। সংসদ সদস্য হিসেবে লাউয়াছড়া রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব এমপি আব্দুস শহীদের উপর। কিন্তু তিনি নিজে রক্ষক হয়ে ভক্ষকে পরিণত হয়েছেন। স্থানীয় সংসদ সদস্য, জনপ্রতিনিধিরা বাগান করার নামে দখল করছেন সংরক্ষিত এই বনের জমি। সব জেনেও চাকুরি হারানোর ভয়ে চুপ থাকতে বাধ্য হচ্ছে বন বিভাগ। এতে বন হারাচ্ছে বৈচিত্র্য। হুমকির মুখে পড়েছে বন্যপ্রাণী ও স্থানীয় বনজীবীরা। বনের জমি উদ্ধার করার জন্য স্থানীয় পরিবেশবাদীরা একাধিকবার দাবি করে আসলেও কর্ণপাত করেনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। সাপ্তাহিক পূর্বদিকের ১৫ দিনের অনুসন্ধানে এমন চিত্র ফুটে উঠে। দেশ বিদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতিদিন শত শত পর্যটক লাউয়াছড়াকে একনজর দেখার জন্য আসেন। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায়িত্বহীনতায় ধ্বংসের পথে ঐতিহ্যবাহী এই বন। যার ফলে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়বে পরিবেশ।
১শ’ বছর ধরে গড়ে উঠেছে মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া বন। বনরক্ষী সুরমান মিয়া বলেন, বন আর আগের মতো নাই। এখন অনেক সতর্ক থাকতে হয়। কখন কী হয়ে যায় বলা মুশকিল।
বনরক্ষীদের সাথে প্রতিবেদকের কথা হলে তারা বলেন, আগের চেয়ে এখন বন পাহারা দেয়া কঠিন হয়ে যাচ্ছে? তাদের সঙ্গে কথা হচ্ছিলো বনের পূর্বদিকটায়, শ্রীমঙ্গল-ভানুগাছ সড়কের পাশে। রাস্তার ওপাড়ে বন থাকলেও সেদিকটা আমাদের নিয়ে যেতে ভয় পান বনরক্ষীরা। তারা বলেন, ওই চা বাগানের দিকে যেতে পারবো না। সমস্যা আছে। কী সমস্যা জানতে চাইলে বলেন, এ ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন স্যারেরা বলতে পারবে।
সরেজমিন লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে গেলে দেখা যায় চতুর্দিকের সীমানা অরক্ষিত। সীমানা না থাকায় বোঝা কঠিন, কোনটি বনের জমি, আর কোনটি চা-বাগানের। প্রতিবেদককে দেখে ছুটে আসেন ‘সাবারি ট্রি প্লানটেশন’ চা বাগানের ম্যানেজার দেলোয়ার। তিনি জানান, স্থানীয় সংসদ সদস্য আব্দুস শহীদের চা বাগান এটি। সাড়ে সাত একর জমিতে বাগান করা হয়েছে বলে জানান তিনি। জায়গা এতটুকুই কিনা জানতে চাইলে বলেন, আরেকটু বড় হতে পারে। একটি পিলার দেখিয়ে বলেন, সে পর্যন্ত আমাদের জায়গা। এরপর ফরেস্টের জায়গা। বাগানের জমি কতটুকু তা জানতে প্রতিবেদক বাগানের মালিক, মৌলভীবাজার-৪ আসনের সংসদ সদস্য ও সরকারি অনুমিত হিসাব সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি উপাধ্যক্ষ ড. আব্দুস শহীদের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, সাত নয়, দশ একরের মতো জমি আছে সেখানে। জমিটি কীভাবে পেলেন জানতে চাইলে এমপি বলেন, এগুলো আমার কেনা জমি। একজন বেঁচেছিলো আমার কাছে। পরবর্তীতে শখের বশে চা বাগান করে রেখেছি। সাড়ে সাত নাকি দশ একর- বাগানের কেনা জমি আসলে কতটুকু? দুই ধরনের তথ্যে বিভ্রান্ত হয়ে ছুটে যাই কমলগঞ্জ সাব রেজিস্ট্রি অফিসে। দাগ নম্বর ধরে চা বাগানের দলিলটি খুঁজে বের করি। দলিলটি চার বছর আগের। জমির মালিক ছিলেন নাজমুর রহমান শাহীন। মাত্র সাড়ে এগারো লাখ টাকায় জমিটি নিজ নামে কিনে নেন উপাধ্যক্ষ আব্দুস শহীদ। দেখে আশ্চর্য হতে হয়, এখানে জমির পরিমান চার একরের কিছু বেশি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, দশ একর জমি তিনি পেলেন কোথায়?
এরপর আমরা যাই কমলগঞ্জ ভূমি অফিস। সংসদ সদস্যের কেনা জমিটির দাগ নম্বর ধরে আশেপাশের জমির মালিকের খোঁজ করি। নামানো হয় রেকর্ড বুক। কমলগঞ্জ ভূমি অফিসের সার্ভেয়ার শামসুল হুদা জানান, এমপির জমির একপাশে খেতের জমি আর দু’পাশে রিজার্ভ ফরেস্টের জমি। অর্থাৎ সংসদ সদস্য চার একরের বাইরে কোনো জমি কেনেননি; তিনি বনের জমি দখল করেছেন। বিষয়টি আরো পরিস্কার হয়, স্যাটেলাইটের ছবি দিয়ে। ২০১৮ সালের সেই চা বাগানের ছবি আর চার বছর পর বর্তমান ছবির তুলনা করে স্পষ্ট দেখা গেছে সংসদ সদস্যের বাগানের পেটে কীভাবে বন ঢুকে গেছে।
বনবিভাগ কি এটি জানেনা কিংবা দেখেনি? বনবিভাগ অফিস থেকে লাউয়াছড়া বন দখলদারদের একটি তালিকা পাই। এই তালিকায় সংসদ সদস্যের নাম নেই। নেই অন্যকোনো প্রভাবশালীর নামও। আছে দখলদার হিসেবে কিছু নিরিহ গ্রামবাসীর নাম।
এবিষয়ে বিস্তারিত জানতে মৌলভীবাজার বনবিভাগের অফিসে বিভাগীয় বন কর্মকর্তা রেজাউল করিম চৌধুরী’র সাথে কথা হলে তিনি বলেন, দুই বছরের কিছু বেশি সময় ধরে তিনি লাউয়াছড়ার পুরো বনটির দায়িত্বে আছেন। সংসদ সদস্যের চা বাগানের জমি নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বিব্রত হন। কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
এবিষয়ে মৌলভীবাজার-৪ আসনের সংসদ সদস্য আব্দুস শহীদ বলেন, কমি বেশি প্রভাবশালী সবারই দখলে বনের জমি রয়েছে। বনের জমি দখল করে মেয়রের ভাই লেমন গার্ডেন নামে একটি রিসোর্ট করছে। এরকম অনেকেই নামে বেনামে দখল করে রেখেছে।
এভাবে বন শুধু জমি হারাচ্ছে না, হারিয়ে যাচ্ছে জীব-বৈচিত্র্যও। বন ঘিরে যাদের জীবন, বনকে যারা মায়ের মতো ভালোবাসেন, সেই বনে বাস করা আদিবাসীরাও এখন শঙ্কিত।