কুলাউড়ায় জীবন যুদ্ধে সংগ্রামী দুই প্রতিবন্ধী যুবক!
প্রকাশিত হয়েছে : ২০ আগস্ট ২০২০, ৪:৩৩ অপরাহ্ণ
মো. নাজমুল ইসলাম, কুলাউড়া ::
জীবনযুদ্ধে লড়ে নিজ পায়ে দাঁড়িয়ে জয়ী হতে চায় সংগ্রামী দুই প্রতিবন্ধী যুবক। তারা পরনির্ভরশীলতা ছেড়ে স্বউদ্যোগে প্রতিবন্ধীর প্রতিবন্ধকতা ছাড়িয়ে মুখরিত কর্মময় জীবনে এগিয়ে যেতে চায় বহুদূর। একজন জন্ম থেকে প্রতিবন্ধী আর আরেকজন জন্মের এক বছর পর পোলিও রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রতিবন্ধী হয়ে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। তাদের উপার্জনে স্ব স্ব পরিবার এখন অনেক সাবলম্বী।
সরেজমিন তাদের সাথে আলাপ করলে উঠে আসে তাদের জীবনের সাফল্য ও সংগ্রামের অনেক গল্প। প্রতিবন্ধী ফখর উদ্দিন (৩২), বরমচাল ইউনিয়নের খাদিমপাড়া গ্রামের ছনর উদ্দিন ও সাহারা বেগমের পুত্র। টানাপোড়নের সংসারে ৪ বোন ও ৩ ভাইয়ের মধ্যে সে ৫ম। ফখর উদ্দিন জন্মের সময় সুস্থ্য-সবল থাকলে জন্মের এক বছর পর সে পোলিও রোগে আক্রান্ত হয়ে শরীরে টাইফয়েড হয়ে যায়। এরপর বা পায়ের রগ টান দিলে তখনই অবস হয়ে যায়। কার্যত সে সময় থেকেই তিনি প্রতিবন্ধী হয়ে পড়ে। তৎকালীন ভালো কোনো ডাক্তারের চিকিৎসা নিতে না পারায় সে আর সুস্থ্যভাবে ভালো হয়ে উঠতে পারেনি। লেখাপড়ার প্রতি প্রবল মনযোগ থাকলেও পরিবারের নানা অসুবিধায় হাইস্কুলের গন্ডি পেরোনো হয়নি তার। বরমচাল স্কুল অ্যান্ড কলেজে মাত্র ১০ম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করে শিক্ষা জীবনের যবনিকা ঘটে। এরপর নিজে কখনো পরিবারের বোঝা হয়ে থাকতে চান নি। প্রতিবন্ধীকতাকে পেছনে ফেলে চ্যালেঞ্জিং নিয়ে শুরু করেন নতুন জীবন সংগ্রাম। প্রায় ১০ বছর আগে সিলেট করিমউল্লাহ মার্কেটে মোবাইল ইঞ্জিনিয়ারিং এর উপর হাতে কলমে শিক্ষা নেন। এরপর নিজে ব্রাহ্মণবাজার লিবার্টি মার্কেটে এ ওয়ান টেলিকম নামে একটি দোকান খোলে বসেন। এরপর থেকে আর পিছনে ফিরে থাকাতে হয়নি ফখরুদ্দীনকে। মোবাইল ইঞ্জিনিয়ারিং এর পাশাপাশি নতুন পুরাতন মোবাইল ক্রয় বিক্রয় করে সে এখন আপমদস্তক একজন ব্যবসায়ী।
ফখরুদ্দীন জানান, প্রতিবন্ধী হওয়ায় এক সময় নিজেকে পরিবারের বুঝা ও খুব অসহায় মনে হতো। কিন্তু নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলায় আজ খুব খুশি লাগছে। প্রতি মাসে তার এই দোকান থেকে ৩০-৩৫ হাজার টাকা আয় হচ্ছে বলে সে জানায়। আর এই আয়ের ফলে বর্তমানে তাদের পরিবার অনেকটা স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছেন। সে প্রতিবন্ধী হিসেবে এই সংগ্রাম চালিয়ে গেলেও সরকারিভাবে প্রতিবন্ধীর তালিকায় এখনো নাম উঠেনি তার। তবে প্রথমবারের মতো গত বছরের ডিসম্বরে একটি সংস্থা থেকে ইউনিয়নের মাধ্যমে ১১ হাজার টাকা পেয়েছিলেন। ফখরুদ্দীন বলেন, সরকারিভাবে যদি কোনো সহযোগীতা পাওয়া যায় তাহলে তার এই ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আরো বড় পরিসরে গড়ে তুলার স্বপ্ন রয়েছে।
প্রতিবন্ধী জুয়েল মিয়া (১৯) ব্রাহ্মণবাজার ইউনিয়নের গুড়াভুই গ্রামের দরিদ্র কুদ্দুস মিয়া ও মিরিজা বেগমের পুত্র সে। ১ ভাই ও ১ বোনের সংসারে সে বড়। জন্মের পর থেকে সে প্রতিবন্ধী হয়ে আছে। তার ডান পা জন্মগতভাবে অচল। অভাবের সংসার থাকায় জুয়েলকে ভালো কোনো ডাক্তার আজ পর্যন্ত দেখাতে পারেন নি তার দরিদ্র মা- বাবা। যার কারণে সেই ছোট বেলা থেকে সে হুইল চেয়ারে করে ভিক্ষাবৃত্তি পেশায় নেমে পড়ে। বিভিন্ন জায়গার মানুষের কাছ থেকে ভিক্ষা ও সাহায্য নিয়ে কোনো রকম তার অভাবের সংসার চালিয়ে থাকলেও বর্তমানে আগের মতো ভিক্ষাবৃত্তি পেশায় তেমন আর উপার্জন নেই। এছাড়াও মানুষের নানা কথা শুনে সে মনে মনে জিদ নেয় আর ভিক্ষা বৃত্তি করে অন্যের সাহায্যর দিকে চেয়ে থাকবেন না। এরপর তিনি সিদ্ধান্ত নেন পরিশ্রম করে তার অভাবের সংসারের হাল ধরবে। প্রতিবন্ধী থাকার পরেও জীবন যুদ্ধে ঠিকে থাকার লক্ষ্যো শুরু করে তার নতুন সংগ্রাম। ভিক্ষাবৃত্তি ছেড়ে ধরে রিকশার হাতল। প্রতিবন্ধী থাকায় রিকশা চালাতে কষ্ট হলেও নিজ উদোগে টাকা উপার্জন করায় এখন প্রতিবন্ধী জুয়েল বেশ আনন্দিত। ভাড়ায় রিকশা চালিয়ে ইতোমধ্যে আয়ের টাকা দিয়ে তার বোনকে বিয়েও দিয়েছে। কষ্ট করে রিকশা চালাতে দেখে স্থানীয় সামিনা বারী হেলথ সংস্থার কর্নধার আবুল কালাম প্রতিবন্ধী জুয়েলকে একটি ব্যাটারিচালিত অটো রিকশা ক্রয় করে দেন। এরপর থেকে তার অভাবের জীবন পাল্টে যেতে থাকে।
জুয়েল জানান, এক সময় ভিক্ষাবৃত্তি করে অনেক কষ্টে তাদের মানবেতর জীবনযাপন করতে হয়েছে। সাহায্যর জন্য মানুষের কাছে গেলে নানান কথা শুনতে হতো কিন্তু এখন নিজে পরিশ্রম করে টাকা আয় করতে পারায় অনেক খুশি লাগে। প্রতিদিন ৫০০-৭০০ টাকা সে আয় করে থাকে। এছাড়াও প্রতিবন্ধী হিসেবে সরকারিভাবে প্রথমে কোনো টাকা না পেলেও কয়েক বছর থেকে প্রতি ৩ মাস পর পর ২১শত টাকা পায় বলে সে জানায়। দুই প্রতিবন্ধী যুবকের হার না মানা অভাবনীয় সাফল্য দেখে এলাকার অনেকেই আজ বিস্মিত।
এ ব্যাপারে কুলাউড়া উপজেলা সমাজসেবা অফিসার ইব্রাহীম জানান, যার প্রতিবন্ধী হিসেবে আমাদের তালিকায় রয়েছে তাদেরকে অবশ্যই সরকারিভাবে সহযোগীতা করা হবে। আমাদের কাছে যতোটুকু বরাদ্দ আসে সেগুলো শতভাগ আমরা প্রতিবন্ধীদের মাঝে বিলিয়ে দেই। এছাড়াও এখনো যারা প্রতিবন্ধী হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়নি তাদেরকে আমরা তালিকাভুক্ত করার জন্য কাজ করছি। তাদের তালিকা হয়ে গেলে আশা করা যাচ্ছে চলতি বছরের মধ্যে সকল প্রতিবন্ধীদের শতভাগ ভাতা নিশ্চিত করা হবে।