একজন নির্মল মনের মানুষ ।। রাজন আহমদ
প্রকাশিত হয়েছে : ২৮ জুলাই ২০২০, ২:৫৪ অপরাহ্ণ
গত ৭ জুলাই রাত প্রায় বারোটার কাছাকাছি, ঠিক এমন সময়ই মরহুম মাওলানা মো. নাসির উদ্দিন ভাই এর ভাতিজা রেদওয়ান ফোন করে বললÑ হঠাৎ করে নাসির ভাইয়ের বুকে ব্যথা করছে- তাই উনাকে সিলেট হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে। বিস্তারিত কোন কিছু জানতে না পেরে মনের মাঝে একটি দুশ্চিন্তার আবহে কিছু প্রিয়জনকে ফোন দিয়ে দোয়া চাই। এর মধ্যেই রাত একটা পার হয়ে গেছে। আবার রেদওয়ান এর ফোন। এবার কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললো ‘আমার চাচা নাই রেবা’। রেদওয়ান এর কান্না আসাটাই স্বাভাবিক। এমন চাচার জন্য কার না কান্না আসবে! আমার ছোট্ট জীবনে অনেক চাচা- ভাতিজার সম্পর্ক দেখেছি কিন্তু কোন ভাতিজার জন্যে একজন চাচার এত্ত মায়া আমার চোখ অবলোকন করেনি। দুঃসংবাদটি শুনে আমার হৃৎপিন্ড মুহূর্তেই কেঁপে উঠল। নাসির ভাইয়ের মত প্রিয়জন আকস্মিকভাবে পৃথিবী ছেড়ে বিদায় নেবেন, এর জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না!
চরম অস্তিরতায় ফোনে ফোনে নির্ঘুম রাত কাটিয়ে সকাল পর্যন্তই এভাবে ব্যস্ত থাকতে হয়েছে। সবাই নাসির ভাই এর সাথে বিভিন্ন স্মৃতি, মায়া-মমতা আর উনার আন্তরিকতা নিয়েই কথা বলছিলেন। যে রাতে নাসির ভাই ইন্তেকাল করেছেন, এর আগের দিনই রেদোয়ান এর সাথে তাদের বাড়িতে গিয়েছিলাম। নাসির ভাই তখন ঘুমে ছিলেন। রেদওয়ান গিয়ে ডাক দিতেই তিনি উঠে আসলেন। ইদানিং আমি কারো সাথে দেখা হলে একটু শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে চেষ্টা করি, কারণ আমার দোকানে প্রতিদিন অনেক লোকজন আসা-যাওয়া করেন। তাই নাসির ভাইকে দূর থেকে সালাম দিয়েই বসতে যাই কিন্তু চোখ ফেরাতে না ফেরাতেই তাঁর চিরাচরিত নিয়ম অনুযায়ী আমাকে বুকে জড়িয়ে নিয়েছেন। এরপর দীর্ঘ সময় আমরা গল্প করেছি, চা- নাস্তা খেয়েছি। করোনার জন্য কয়েক মাস পর ভাইয়ের সাথে দেখা হওয়ায় আমাদের গল্প যেন শেষ হচ্ছিল না! এর মাঝে বারবার আফসোস করে বলছিলেন- এবার কেন আম খেতে গেলাম না। যে কোন মানুষের সাথে নাসির ভাই এর আন্তরিকতা ছিল সন্দেহাতীত। তাঁর সাথে যাদেরই দেখা সাক্ষাৎ হয়েছে তারা এটা স্বীকার করতে বাধ্য। তিনি অল্প সময়েই সবাইকে কাছে টেনে নিতে পারতেন। যে কোন মানুষকে আপন করে নেওয়ার সম্মোহনী শক্তি তাঁর মাঝে বিদ্যমান ছিল। আমাদের মতো অনুজরা তাঁর কাছে গেলে যে মায়া-মমতা পেতাম, তা কখনো ভুলতে পারবো না। তাঁদের বাড়িতে যখনই কোন অনুষ্ঠানে গিয়েছি, আসার পরে আবার ফোন দিয়ে খবর নিতেন। তাঁর মতো নিরহংকারী, নির্লোভ, নিঃস্বার্থ ব্যক্তি বর্তমান সময়ে খুব কমই পাওয়া যাবে।
আল্লাহ তায়ালা নাসির ভাইকে এমন একটি মায়াবী কণ্ঠ দান করেছিলেন, যে কণ্ঠটি আমাদের কর্ণকুহরে সদা বাজবে। ২০১৪ সালে লতিফিয়া কারি সোসাইটি মৌলভীবাজার সদর উপজেলা কমিটি গঠনের দিন স্বয়ং হযরত বড় ছাহেব কিবলাহ ফুলতলী নাসির ভাইকে সভাপতি করতে চেয়েছিলেন; তখন নাসির ভাই পরম বিনয়ের সাথে নিজের অপারগতা প্রকাশ করেছিলেন। পদ-পদবী থেকে সবসময় নিজেকে গুটিয়ে রাখা নাসির ভাই ছিলেন স্বার্থক জীবনের অধিকারী। চলমান করোনা ভাইরাসের আতঙ্কিত সময়ে বৃষ্টি ভেজা দিনেও তাঁর জানাজার নামাজে হাজার, হাজার মানুষের উপস্থিতিই সেটা প্রমাণ করেছে। এমন কতো মানুষকে কাঁদতে দেখেছি; যাদের সাথে নাসির ভাই এর আত্মীয়তা বা রক্তের কোন সম্পর্ক নেই। নাসির ভাইয়ের জীবনের স্বার্থকথা ওখানেই নিহিত।
আমাদের সবাইকেই একদিন দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে চলে যেতে হবে। কিন্তু হঠাৎ করে কারো চলে যাওয়া আমাদেরকে ধাক্কা দেয়। পীড়া দেয়। এলোমেলো করে দেয় আমাদের চলমান জীবনের স্বাভাবিকতাকে। নাসির ভাইয়ের এই চলে যাওয়াতে তাঁর পরিবার হারালো পরিবারের প্রিয় মানুষটাকে, সহকর্মী আর বন্ধুরা হারালেন তাঁদের প্রিয় সহযোদ্ধাকে। ছাত্ররা হারালো তাদের পিতৃতুল্য শিক্ষককে। এলাকাবাসী হারালেন তাঁদের প্রিয় কৃতি সন্তানকে আর আমার মতো অনুজরা হারালো প্রিয় একজন অভিভাবককে।
নির্মল মনের মানুষ বলতে যা বুঝায় আমার কাছে নাসির ভাই তেমনি ছিলেন। আপন-পর সবাইকে বুকে জড়িয়ে নেওয়া সবার পক্ষে সম্ভব হয় না। এর জন্য যে একটি বিশাল হৃদয় প্রয়োজন তা কিন্তু নাসির ভাইয়ের ছিল। নাসির ভাইয়ের সাথে গল্প করে কাটানো সময়গুলো আজ শুধুই স্মৃতি। মহান আল্লাহর দরবারে হৃদয় নিংড়ানো ফরিয়াদ নাসির ভাইয়ের সকল খেদমত কবুল করে তাঁকে যেন জান্নাতুল ফেরদৌস দান করেন। আমিন।
রাজন আহমদ : সাধারণ সম্পাদক ইটা ইসলামি সমাজ কল্যাণ সংস্থা