স্মৃতিতে আমার মেজ চাচা
প্রকাশিত হয়েছে : ২৮ জুলাই ২০২০, ১২:৪০ অপরাহ্ণ
রেদওয়ানুল ইসলাম
আমার মেজ চাচা (মাওলানা মো. নাসির উদ্দিন) আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন এ কথা যখন মনে আসে তখন আর নিজেকে স্থির রাখতে পারি না। এক অজানা শূন্যতা অনুভব করি; যা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। তিনি মারা গেছেন এখনও মনে হয় না। মনে হয় এটা নিছক স্বপ্ন। হয়তো চাচা আবার আমাকে ফোন দিয়ে বলবেন- ‘বাবাজান কেমন আছো, বাড়িতে কবে আসবে’। কিছুদিন পার হওয়ার পর বাড়িতে না গেলে ঠিক এভাবেই আমাকে বলতেন। এইতো চলে যাওয়ার কিছুদিন আগেও বলেছিলেন ‘বাড়িতে আসছো না কেন? বাড়ির আম কে খাবে তুমি না আসলে’ ইন্তেকালের পর জানতে পারি যে ওইদিন আমার জন্য আম পাড়িয়ে রেখেছিলেন। এটা আমার প্রতি তাঁর স্নেহের ছোট্ট একটা উদাহরণ মাত্র। এরকম অজস্র স্নেহের প্রতিচ্ছবি পদে পদে অনুভব করি।
পরিবারে তার অবস্থানটা ছিল ঠিক একজন মানুষের শরীরে তাঁর মেরুদন্ডের মত। পরিবারের প্রত্যেকের সুখ-দুঃখ বলার সাথী কেবল তিনিই ছিলেন। বাবা থেকে শুরু করে আমার ছোট ফুফু, আমরা সকল ভাই-বোনও তার কাছে অকপটে যেকোন বিষয় আলোচনা করতে পারতাম। তাঁর মৃত্যুতে সবাই মুষড়ে পড়েন। একে অন্যকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করা হলেও সকলের বুক ভেঙে পড়েছিল তার মৃত্যুশোকে। আমার লাল চাচা (সাব্বির চাচা) মেজ চাচা মারা যাবার পর আমাকে সান্ত¡না দিয়ে ধৈর্য্য ধরতে ও মন শক্ত রাখতে বলেছেন। কিন্তু সেই তিনিই পরিচিতজনের সাথে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। লন্ডনে থাকেন আমার এক মামা, আম্মার কাছে ফোনে বলেছেন, ‘সাব্বিরকে ফোন দিয়েছিলাম কিন্তু সে এত বেশি কান্না করছে যে আমার সাথে কথাই বলতে পারেনি’। বাস্তবে এ অবস্থা ছিল সকলেরই। এখনও পরিবারের কেউ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যেতে পারছেন না। এই ব্যথার দাগ মুছে ফেলা যে অনেক কঠিন। পরিবারের জন্য তিনি যে ভূমিকা রেখেছেন একই ভূমিকা বাড়ির প্রতি, নিজ গ্রামের প্রতি এবং স্কুলের প্রতি রেখেছেন। তিনি ধোবারহাট বাজার উচ্চ বিদ্যালয়ের হেড মাওলানা হিসাবে শিক্ষকতা করেছেন। প্রায় ২৫ বছরের দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবন তাঁর। হাজার হাজার ছাত্রের আপন অভিভাবক ছিলেন চাচা। রমজান মাসে আমাদের বাড়িতে দারুল কিরাতের (কুরআন শিক্ষা শাখা) নাজিম ও প্রধান কারীর দায়িত্ব পালন করেছেন প্রায় তেরো বছর। এর আগে বিভিন্ন জায়গায় ২০/২২ বছর দায়িত্ব পালন করেছেন।
দ্বীনের একজন একনিষ্ট খাদিম হিসাবে চাচা নিজের জীবনকে অতিবাহিত করেছেন একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। বাড়িতে আমাদের সকল ভাই-বোনরা তাঁকে মোল্লা চাচা বলে ডাকতাম। সবার প্রতি তার একই রকম খেয়াল ছিল। ছোটবেলা থেকে তাঁর শাসনেই আমাদের বেড়ে উঠা। আযান হওয়ার সাথে সাথে সবার মসজিদে থাকা ছিল বাধ্যতামূলক। কেউ তাঁর নজর এড়াতে পারতো না। যদি বিনা কারণে কেউ নামায মিস করতো তাহলে তার জবাবদিহি ছিল নিশ্চিত। বাড়িতে পড়ার সময় পড়ার টেবিলে সবাই আছে কিনা সেটিও লক্ষ রাখতেন। তাঁর শাসন কতটা জরুরী ছিল তা এখন আমরা হারে হারে টের পাই। আমাদের বোনদের মধ্যে যাদের বিয়ে হয়েছে তাদের সবার সাথেই তিনি যোগাযোগ রাখতেন। তার মৃত্যুর পর স্মৃতিচারণ করে আমার এক বোন চাচীকে (চাচার স্ত্রী) বলেন ‘চাচী আল্লাহর কাছে বলেছি আল্লাহ আমার চাচাকে তুমি কোন সন্তান দাও নি কিন্তু তিনি আমাকে তাঁর সন্তানের মত ভালোবেসেছেন। আমরা তার সন্তান হিসাবেই আছি। আল্লাহ যেন তা কবুল করেন’। আমরা ভাই বোনদের হৃদয়ে তিনি শুধু চাচা নন পিতা হিসাবে আছেন।
চাচা প্রায় সময়ই পুকুরের পাকা ঘাটের বেঞ্চে বসে থাকতেন। তার মৃত্যুর পর গ্রামের কয়েকজন আমাকে বলছেন- শুধু চাচার সাথে একটু কথা বলার জন্য তারা মূল সড়ক দিয়ে না গিয়ে আমাদের পুকুরপাড় হয়ে বাজারে যেতেন। চাচার সাথে গ্রামের ছোটবড় সকলেরই ছিল শ্রদ্ধা ও স্নেহের সম্পর্ক। কারো কোন প্রয়োজন চাচার খোঁজে এই পুকুরে পাড়ে লোকজন আসতো। তিনি তাদের প্রয়োজন মেটানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করতেন । যাকে তাঁর চোখে পড়তো তাকে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করেন নি এমনটা খুব কমই হয়েছে।
পরিবার এবং গ্রামের মত স্কুলেরও এক অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিলেন তিনি। শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবকের ভরসার পাত্র ছিলেন। যখনই কোন ছাত্রদের মাঝে ঝগড়া-বিবাদ হতো অথবা ছাত্রছাত্রীদের যেকোন বিষয়ে বিচারের প্রয়োজন দেখা দিতো তখন সে দায়িত্বটা সকল শিক্ষকরা তার উপর ন্যস্ত করতেন। কখনই এমনটা শুনিনি যে চাচার বিচারে কোন অভিভাবক অসন্তুষ্ট হয়ে স্কুলে এসেছেন। তাঁর ইন্তেকালের দিন তো একজন শিক্ষক কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন ‘আমাদের স্কুল এখন কিভাবে চলবে, আমরাতো সকল দায়িত্ব মাওলানা সাবকে দিয়ে দিয়েছিলাম’। স্কুলের বর্তমান সাবেক ছাত্রছাত্রীদের আহাজারি দেখে মনে মনে ভাবছিলাম হয়তো আল্লাহ আমার চাচাকে সন্তান না দিয়ে যে পরীক্ষা করেছিলেন তিনি সে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। একছাত্র কান্নাভেজা কণ্ঠে বলছিল ‘আমি ১০ম শ্রেণীর টেস্ট পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়েছিলাম কিন্তু স্যার কমিটির সাথে চ্যালেঞ্জ করে আমাকে এসএসসি পরীক্ষায় সুযোগ করে দিয়েছিলেন আমি এসএসসি, এইচএসসি, অনার্স পাশ করে এখন মাস্টার্স করছি, আমার সকল সফলতার একমাত্র দাবিদার স্যার’। এই ছাত্র তার ফেইসবুক পোস্টে লিখেন ‘আমি এতটাই অপয়া যে স্বপ্ন ছিল চাকুরি করে প্রথম বেতনের টাকা দিয়ে আমার মা বাবার ন্যায় স্যারকে নতুন জামা নিজ হাতে পড়িয়ে দিবো, কিন্তু সে স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেল।’ এরকম অনেক ছাত্রের জীবনে অনুপ্রেরণার প্রতীক ছিলেন তিনি। গরীব ছাত্রছাত্রীর উপবৃত্তির দাবি নিয়ে অভিভাবকরা দেখতাম তাঁর কাছেই আসতেন। তাঁর ইন্তেকালের দিন আরো বেশি অশ্রুসিক্ত হয়েছিলাম হিন্দু ধর্মালম্বী লোকদের কান্না দেখে। চাচার একজন শিক্ষক ঠিকভাবে হাঁটতে পারেন না তিনি চাচার মৃত্যুর সংবাদ শুনে তাঁর ছেলেকে বললেন ‘নাসির আমাকে রেখে কেন চলে গেল সেটা জানতে আমাকে যেতেই হবে’, তাঁর ছেলে আমাকে বলছিলেন ‘আমি অসুস্থতার জন্য বাবাকে কোথাও বের হতে দেই না কিন্তু নাসির সাবের মৃত্যুর পর তাঁর কথা শুনে তাঁকে আটকিয়ে রাখার মতো সাহস আমার ছিলো না। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আমাদের আশপাশের কয়েকটি গ্রামের সকল শ্রেণী-পেশার মানুষের হৃদয়ে তিনি ভালবাসার সতেজ বীজ বপন করে গিয়েছিলেন। আমাদের ঘরের কাজের সহযোগী বাবুল কাকার হাউমাউ কান্নার দৃশ্য জীবনে কখনো ভুলতে পারবো না।
রেদওয়ানুল ইসলাম : সহকারী সম্পাদক সাপ্তাহিক পূর্বদিক