বীর মুক্তিযোদ্ধা ওয়াহাব চৌধুরীর মুক্তিযুদ্ধকালীন সাক্ষাৎকার
প্রকাশিত হয়েছে : ৮ ডিসেম্বর ২০১৫, ৬:৫১ অপরাহ্ণ
তমাল ফেরদৌস ::
বীর মুক্তিযোদ্ধা, বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্ট (মুজিব বাহিনী) এর সদস্য, ১৯৭০ এর পূর্ব পাকিস্থান ছাত্রলীগের মৌলভীবাজার মহকুমা শাখার সভাপতি, ভারতের উত্তর প্রদেশের দ্রেরাদ্রুনে স্বাধীনতার প্রথম ব্যাচের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সৈনিক দেওয়ান আব্দুল ওয়াহাব চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো নিয়ে ২০১১ সালের ১লা ডিসেম্বর একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। যা পূর্বদিকের পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো-
দেওয়ান আব্দুল ওয়াহাব চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রশিক্ষণ গ্রহণ, যুদ্ধকালীন সময় এবং তৎকালীন মৌলভীবাজার জেলার মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট নিয়ে বলেন, ১৯৭০-৭১ সালে আমি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্থান ছাত্রলীগের মৌলভীবাজার মহকুমা শাখার সভাপতি থাকায় আমার দায়-দায়িত্ব ছিল অনেক। ১৯৭১ সালের ২৩শে মার্চ থেকে মূলত: স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। আমি মৌলভীবাজার শহরের চৌমোহনা চত্বরে পাকিস্থানী পতাকা নামিয়ে আগুন ধরিয়ে দেই। এসময় উপস্থিত সহযোগীরা ‘আমার সোনার বাংলা’ জাতীয় সংগীত গাইতে থাকি। আমার সাথে ছিলেন তখন সুজাউল করিম, মাহমুদুর রহমান (বর্তমানে আয়কর উকিল), মোহাইমিন সালেহ (জুড়ী), আব্দুল মুকিত প্রমুখ।
তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশকে ৪টি এলাকায় ভাগ করে চারজন সেক্টর কমান্ডার শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খাঁন, আব্দুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমদকে দায়িত্ব প্রদান করা হয়। এসময় আমি ও আমার সহযোগীরা ইন্দিরা গান্ধির সহযোগিতায় সামরিক বোয়িং বিমানে ভারতের উত্তর প্রদেশের দ্রেরাদ্রুনে প্রশিক্ষণের জন্য চলে যাই।
চার নম্বর সেক্টর কমান্ডারের অধীনে তখন সারা বাংলাদেশের ৭শ’ জন মুক্তিযোদ্ধা অংশগ্রহণ করেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেন, হাসানুল হক ইনু, নুরে আলম জিকু, আনোয়ার ইকবাল ও মো: শাহজাহান। আমাদের প্রশিক্ষণের ইনচার্জ ছিলেন লেফট্যানেন্ট জেনারেল উবান। তবে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন মেজর মালহোত্রা। ১৯৭১ সালের মে মাস থেকে প্রশিক্ষণ শুরু করি এবং জুলাই মাসের শেষের দিকে আসামবাড়ি, আগরতলা হয়ে ৬/৭ জনের দলে বিভক্ত হয়ে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ি। এর আগে হাফলং এর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা এবং আমরা ভারতের রাতাছড়ায় একত্রিত হই।
ভারতের দ্রেরাদ্রুনে প্রথম ব্যাচে সিলেট বিভাগের মধ্যে আমরা ১৬ জন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। তখন সিলেটের মিছবাহউদ্দিন আহমেদ ছিলেন আমাদের গ্রুপের স্কোয়াড্রন লিডার এবং আমি ছিলাম ডেপুটি স্কোয়াড্রন লিডার। মৌলভীবাজারের প্রশিক্ষণপ্রাপ্তরা হলেন, মৌলভীবাজারের মরহুম আব্দুল মুকিত, শ্রীমঙ্গলের মোহন সোম ও শিশির সোম, জুড়ীর সালেহ আহমেদ, রাজনগরের রফিকউদ্দিন রানা, ড্রিগেডিয়ার আব্দুস সালাম।
দুঃখের কথা হলো: সাতগাঁও হয়ে দিনারপুরে আসার পথে মুকিত, রানু, শহীদ, শিশির সোম গেরিলা যুদ্ধে শহীদ হন। এসময় আমাদের এক মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মুমিন (খালিশপুরের) পাক বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে আমাদের অবস্থান ও আমার সম্বন্ধে পাকবাহিনীকে জানিয়ে দেয়। পাকবাহিনী আমাকে দিনারপুর পাহাড়ে চতুর্দিক থেকে ঘেরাও করে ফেলে। আমি তখন নবীগঞ্জের দিকে চলে যাই।
এসময় পাকবাহিনী আমার মা ফয়জুন্নেছা খানম চৌধুরীকে ধরে নিয়ে প্রথমে গজনাইপুর ও পরে শ্রীমঙ্গলে পিস কমিটির সভাপতি দেওয়ান রশীদের বাসায় রাখে। আমাকে ধরার জন্য আমার মাকে দেওয়ান রশীদের বাসায় প্রায় ১ মাস আটকে রাখে। সেপ্টেম্বর মাসের দিকে জগন্নাথপুরে গেরিলা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার সময় জানতে পারি মাকে তারা ধরে নিয়ে গেছে।
তখন হঠাৎ করে পাকবাহিনীর কাছে খবর এলো মাধবপুর বাগানে আমার (দেওয়ান আব্দুল ওয়াহাব চৌধুরী)র লাশ পাওয়া গেছে। পাকবাহিনী বাগানে গিয়ে একটি মুখম-ল বিকৃত মরদেহ পেলো। তারা তখন এটা আমার মরদেহ মনে করে স্কট করে নিয়ে এসে মরদেহটির দাফন সম্পন্ন করে। দাফন সম্পন্ন করার পর আমার মায়ের কাছে এসে সান্তনা দিতে থাকে। এবং অক্টোবরের প্রথমদিকে আমার মা আথানগিরির বাড়িতে ফিরে আসেন।
আমি মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে সাতগাঁওয়ের বোঙ্গেশ বাড়ির টিলায় ও সাতহালের টেকই গ্রামের আজিম মিয়ার বাড়িতে থাকি। তারপর দিনারপুর পাহাড়ে অবস্থান নেই। এসময় আমাদের খাবার দাবার থেকে শুরু করে সবকিছু দেখাশুনা করেন আথানগিরি গ্রামের আমার বন্ধু মরহুম চেরাগ আলী, পানিউন্দা গ্রামের মোমিন মেম্বার ও ধনাই মিয়া।
৮ ডিসেম্বর মৌলভীবাজার মুক্ত হয়। আমি তখন নবীগঞ্জের কুর্শী থেকে বাড়িতে এসে রাজাকারদের ধরে এনে আথানগিরি ফরেস্ট অফিসের সামনে দাঁড় করিয়ে রাখি। তারপর গ্রামের অনেক মুক্তিযোদ্ধা, আত্মীয়স্বজন ও মুরব্বীদের অনুরোধে এদেরকে ছেড়ে দেই। ১৯৭২ সালের জানুয়ারী মাসে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মোহাম্মদ মৌলভী ও গন্নাসকে ধরে এনে মৌলভীবাজার কারাগারে প্রেরণ করি। আথানগিরি গ্রামের রাজাকাররা হলো- পিস কমিটির চেয়ারম্যান মাওলানা ইসমাইল হোসেন, মোহাম্মদ মৌলভী, রইস মিয়া, আমজদ মিয়া, আব্দুল মুকিত।
আমি ১১দফা আন্দোলন, ১৯৭০ সালের নির্বাচনের সভা-সমাবেশে বক্তব্য প্রদান ও ছাত্রলীগের সভাপতি দায়িত্বরত থাকায় সরকারের গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যসহ হাবিব দারোগা এবং সিআইডির হেকিম আমার সভা-সমাবেশের ছবি, বক্তব্যের অংশ বিশেষ এবং তথ্য সংগ্রহ করে রেখেছিল। তাই মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পাকিস্থানীদের টার্গেট ছিলাম আমি।
১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমরা যারা বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্ট (মুজিব বাহিনী) ও বঙ্গবন্ধুর সৈনিক হিসেবে মিছবাহউদ্দিন, আলতাব ভাই, মাহমুদসহ সব মুক্তিযোদ্ধারা রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসের সপ্তাহ খানেকের ভেতরে বঙ্গবন্ধুর কাছে অস্ত্র জমা দেই।
তারপর আমি ১৯৭৮ সালে ৪ সেপ্টেম্বর পলিটিক্যাল এসাইলাম নিয়ে হলান্ড চলে যাই। এসময়ও আমার সাথে ঢাকা পর্যন্ত সার্বক্ষনিক বন্ধু ছিল মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের একান্ত সহচর আথানগিরি গ্রামের মরহুম চেরাগ আলী। তারপর ১৯৯২ সালে আমি হলান্ড থেকে লন্ডন চলে যাই। বর্তমানে আমি স্বাধীন দেশে আমার মাতৃভূমিতে মৌলভীবাজারের আরামবাগের বাসায় বসবাস করছি। #