পৃথিমপাশায় আশুরার দিন
প্রকাশিত হয়েছে : ২৫ অক্টোবর ২০১৫, ১২:০২ অপরাহ্ণ
তমাল ফেরদৌস, পৃথিশপাশা থেকে ফিরে ::
শতাধিক ভক্ত তাদের শরীরে একযোগে করছে ছুরি মাতম। আর হায় হোসাইন হায় হোসাইন বলে করছে চিৎকার। কারো পিঠ বেয়ে ঝরছে তাজা রক্ত, কেউ হারাচ্ছেন হুঁশ। আবার তারই পাশাপাশি চলছে আগত পূণ্যার্থীদের শোকের মাতম। হাজারোর্ধ্ব দর্শক সেই দৃশ্যই দেখছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। ভক্তদের উন্মাদনায় শোক শোভাযাত্রা ও পুরো উৎসবটি হয়ে উঠে হৃদয় বিদারক।
বিশ্বাস আর নিজের শরীরের রক্ত ঝরিয়ে ইমাম হোসাইন ভক্তরা শনিবার আশুরার দিনে পালন করলো কারবালার শহীদানের উদ্দেশ্যে তাদের দশ দিনব্যাপী মহররমের শোক অনুষ্ঠান।
অনুষ্ঠানের শুরুটা হয় হাতি শোভাযাত্রা দিয়ে। বিভিন্ন সাজে সজ্জিত হয়ে হাতিগুলোকে নওয়াব বাড়ি থেকে মূল সড়কে নিয়ে আসা হয়। রবিরবাজারের মূল সড়কগুলো ও সড়ক সংলগ্ন কবরস্থানের উপর তখন হাজারো নারী-পুরুষ, শিশুদের কোলাহল। এরপর শুরু হয় বিভিন্ন উপসর্গ নিয়ে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা। শোক শোভায় আসা তরুণেরা হাতে নিয়ে আসে ৫/৬টি ছুরি সহযোগে শিকল দিয়ে নির্মিত বিশেষ ধরনের ছুরির গোছা।
এরপর আসে নিশান আলম, পাঞ্জা, তাজিয়া ইত্যাদি শোভাযাত্রা। বিকেল ৪টা থেকে প্রায় দেড় ঘন্টাব্যাপী চলে ছুরি মাতম। ছুরি মাতমে যারা অংশ নেয় তারা এদিন রোজা পালন করে। শতাধিক তরুণ ও শিশুরা হাতে ছুরির গোছা নিয়ে শুরু করেন ছুরি মাতম। নতুন আসা অনেকেই এদৃশ্য দেখে ভয়ে বিহব্বল হয়ে পড়েন।
ছুরির আঘাতে তরুণদের পিঠ ফেটে তাজা রক্ত ঝরতে থাকে। কয়েকজন আবার ক্ষতস্থানগুলো গোলাপ জল ছিটিয়ে দিচ্ছেন ব্যথা নিরাময়ের জন্য। একসময় সবাই ক্লান্ত অবসন্ন হয়ে পড়লে ছুরি মাতমের অবসান হয়। মূলত কারবালার শহীদদের দুঃখে ভারাক্রান্ত হয়ে এই উৎসবটি তারা করে থাকেন। উৎসবে নওয়াব বাড়ির লোকজন ছাড়াও শিয়া মতাদর্শীরা অংশ নেন।
ছুরি মাতমের পর তাবুতের মধ্যে চুমু খান অনেকেই। আবার অনেকেই মনে মনে দোয়া কামনা করে থাকেন। কারবালার ময়দানে শহীদ শিশুদের উদ্দেশ্যেই এই প্রার্থনা করা হয়।
এরপর মাঠের পাশে অবস্থিত মাজারের ভেতর প্রতীকি লাশ দাফন করেন আয়োজকরা। লাশ দাফনের পর একজন ইমাম একটু দুরে অবস্থিত একটি স্থানে কোরআন শরীফ ও দোয়া পাঠ করে থাকেন। এসময় ছুরি মাতমে অংশ নেয়া তরুণ-যুবক ও শিশুরা বসে থাকেন লাইন ধরে। ইমাম সাহেবের পড়া শেষ হলে দোয়া হয় এবং শরবত পানের মধ্য দিয়ে রোজ ভঙ্গ করেন তারা।
অনুষ্ঠানের শেষে আয়োজকদের প্রতিনিধি নওয়াব আলী আব্বাছ খাঁন উপস্থিত সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলার পৃথিমপাশা সাহেব বাড়িতে চারশ’ বছর ধরে আশুরার দিন এই অনুষ্ঠান পালিত হয়ে আসছে। মহররম মাসের প্রথম দিন থেকেই পৃথিমপাশার নবাব বাড়ি, তরপি বাড়ি, পাল্লাকান্দি সাহেব বাড়ি, মনরাজসহ অন্যান্য স্থানে অবস্থিত ইমামবাড়িগুলোতে মজলিস, মাতম, নোওহা, জারিসহ অন্যান্য শোক অনুষ্ঠান পালিত হয়। এতে হাজার হাজার লোকের সমাগম ঘটে।
এদিকে ঢাকায় শুক্রবার রাতে তাজিয়া মিছিলের প্রাক্কালে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় নেয়া হয় পুরো এলাকা জুড়ে নিশ্চিদ্র নিরাপত্তা। এদিন পুলিশ, আনসার, বিজিবি ও র্যাবের ৫০ সদস্যের টিম সার্বক্ষণিক কাজ করেছে।
মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক মো. কামরুল ইসলাম, ডিবির পুলিশ সুপার খাইরুল ইসলাম, কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ অনেকেই স্বশরীরে উপস্থিত ছিলেন।