ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান
মাহে রমজানে ইনজিল অবতরণ
প্রকাশিত হয়েছে : ১ জুলাই ২০১৫, ৩:৪৫ পূর্বাহ্ণ
রমজান মাসের ১৩ তারিখে হজরত ঈসা (আ.)-এর কাছে জর্ডান নদীর তীরে আসমানি কিতাব ‘ইঞ্জিল’ নাজিল করা হয়। তাঁর আবির্ভাবকালীন সারা বিশ্বে অত্যাচার, উৎপীড়ন ও মূর্খতার তাণ্ডবলীলা চলছিল। সমাজে বিভিন্ন পাপাচার ও অপকর্মে লোকেরা লিপ্ত ছিল। পাপ-পঙ্কিলতার আবর্ত থেকে মানবতাকে মুক্তি দিতে হজরত ঈসা (আ.) তৎকালীন জেরুজালেম বর্তমান ফিলিস্তিনের বেথলেহেম নগরে জন্মগ্রহণ করেন। আল্লাহর কুদরতের অপূর্ব নিদর্শনরূপে তিনি মানুষের জন্মের সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রমধারায় পিতা ছাড়া ইমরান-তনয়া কুমারী মাতা মরিয়মের গর্ভে আবির্ভূত হন। সৃষ্টিকর্তার অপার মহিমায় সেখান থেকেই বিচ্ছুরিত হয় জ্ঞান ও গরিমার এমন জ্যোতি, যা সমগ্র পৃথিবীকে আলোক উদ্ভাসিত করেছে। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘মরিয়ম-তনয় মসিহ তো কেবল একজন রাসুল, তার আগে বহু রাসুল গত হয়েছে এবং তার মাতা সত্যনিষ্ঠ ছিল।’ (সূরা আল-মায়িদা, আয়াত: ৭৫)
আল্লাহর বিশেষ রহমতে শিশুনবী হজরত ঈসা (আ.) দোলনায় থাকাকালে বাকশক্তি লাভ করেন। আল্লাহ পাক তাঁকে মুজিজাস্বরূপ মৃতকে জীবিত করা, জন্মান্ধকে চক্ষুষ্মান করা, শ্বেত ও কুষ্ঠ রোগীকে আরোগ্য করার অলৌকিক শক্তি প্রদান করেছিলেন। তিনি ছিলেন দয়া, পরোপকারিতা, মানবতা ও শালীনতার দিশারি। তাঁর জন্ম কল্যাণ ও খোদাভীরুতার নির্দেশক, রক্তপাত বন্ধের সংবাদবাহক এবং শান্তি ও ক্ষমার নবযুগের সূচনাকারী। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘সে (ঈসা) বলল, “আমি তো আল্লাহর বান্দা। তিনি আমাকে কিতাব দিয়েছেন, আমাকে নবী করেছেন, যেখানেই আমি থাকি না কেন, তিনি আমাকে বরকতময় করেছেন। তিনি আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন যত দিন জীবিত থাকি, তত দিন সালাত ও জাকাত আদায় করতে। আর আমাকে আমার মাতার প্রতি অনুগত করেছেন এবং তিনি আমাকে উদ্ধত ও হতভাগ্য করেননি। আমার প্রতি শান্তি যেদিন আমি জন্মলাভ করেছি, যেদিন আমার মৃত্যু হবে এবং যেদিন জীবিত অবস্থায় আমি পুনরুত্থিত হব।”’ (সূরা আল-মার্য়াম, আয়াত: ৩০-৩৩)
হজরত ঈসা (আ.) যখন তাঁর ধর্মের প্রচারকাজ পরিচালনা করতে থাকেন, ইহুদিরা তাঁর প্রচারণা প্রতিহত করার আপ্রাণ চেষ্টা চালায়। তিনি আল্লাহ প্রদত্ত ঐশী শক্তিতে বলীয়ান হয়ে লোকজনকে হেদায়েত করার জন্য বহু মুজিজা প্রদর্শন করেন, তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে; কাদা-মাটি দিয়ে তৈরি পুতুলকে জীবন্ত পাখি করা, জন্মান্ধকে দৃষ্টি দান করা, কুষ্ঠ ব্যাধিগ্রস্তকে
হাত বুলিয়ে রোগমুক্ত করা, খাঞ্চাভর্তি আসমানি খাবার আনয়ন করা প্রভৃতি। প্রচারকাজের শুরুতে তিনি কয়েকজন জেলেকে সত্যপথে আসার জন্য আহ্বান জানান, তাঁরা ডাকে সাড়া দিয়ে তাঁর অনুগামী হন। এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘যখন ঈসা তাদের অবিশ্বাস অনুধাবন করল তখন সে বলল, “আল্লাহর পথে কারা আমার সাহায্যকারী?” হাওয়ারিগণ (তাঁর বিশ্বস্ত অনুসারীরা) বলল, “আমরাই আল্লাহর পথে সাহায্যকারী।”’ (সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ৫২)
মানুষকে পাপমুক্ত করতেই তিনি এ পৃথিবীতে এসেছিলেন; আর নিঃশর্ত ক্ষমা করতে না পারার কারণেই এ জগতে এখনো এত অশান্তি, হতাশা, বিপর্যয় ও যুদ্ধবিগ্রহ। তিনি পাপীদের ক্ষমা করেছেন; পাপীকে নয় বরং পাপকে ঘৃণা করার শিক্ষা দিয়েছেন; প্রতিবেশীকে সাহায্য করার গুরুত্ব তুলে ধরেছেন; আজীবন অভাবী মানুষকে প্রয়োজনীয় সাহায্য করেছেন এবং শ্রমিকদের সততা, ন্যায্যতা, দক্ষতা, পরিশ্রম ও দায়িত্বশীলতার কাজ করতে উপদেশ দিয়েছেন। ব্যবহারিক জীবনে প্রয়োজনীয় যেসব ধর্মীয় অনুশাসনের কথা তাঁর মুখে শোনা যায় যেমন: চুরি কোরো না, হত্যা কোরো না, ব্যভিচার কোরো না প্রভৃতি। যিশু বলেছেন, ‘যদি কেউ লালসার দৃষ্টিতে কোনো মেয়ের দিকে তাকায়, তাহলে সে অন্তরে ব্যভিচারী হলো।’ (মথি) নিষ্পাপ শিশুদের স্নেহ-ভালোবাসাপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিতকরণে তিনি ঘোষণা করেন, ‘শিশুদের ন্যায় সরলপ্রাণ মানুষেরাই সর্বাগ্রে স্বর্গরাজ্যে প্রবেশ করবে।’
যদি আল্লাহ তাআলা নবী-রাসুলদের মাতৃভাষায় মাহে রমজানে আসমানি কিতাব প্রেরণ না করতেন, তাহলে
দেশবাসী ঐশী ধর্মগ্রন্থের হেদায়েত ও সর্বাঙ্গীণ কল্যাণলাভে বঞ্চিত হতো। হজরত ঈসা (আ.)-এর জাতির মাতৃভাষা ছিল সুরিয়ানি, এ ভাষায় তাঁর প্রতি ‘ইঞ্জিল’ নাজিল করা হয়। কিন্তু পরবর্তীকালে তা ‘বাইবেল’ নামে গ্রিক ভাষায় অনূদিত হয়। হজরত ঈসা (আ.) তাঁর বনি ইসরাইল সম্প্রদায়কে ‘আহমাদ’ নামে একজন রাসুলের আগমনের সুসংবাদ দিয়েছিলেন। বাইবেলে উল্লেখ আছে যে যিশু শিষ্যদের বলেছিলেন, ‘এখনো তোমাদের কাছে আমার অনেক কথা বলার ছিল। যাহোক, যখন সেই সত্য আত্মা আসবেন, তিনি তোমাদের তাবৎ সত্যের দিকে পরিচালিত করবেন। কেননা, তিনি নিজের থেকে কিছু বলবেন না, তিনি যা শুনবেন, কেবল সেটাই বলবেন।’ (জোহন: ১৬, ১৩) এটা যে সর্বশেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কথাই বলা হয়েছে, তা পবিত্র কোরআনের একটি আয়াত দ্বারা সুস্পষ্ট প্রতীয়মান হয়, ইরশাদ হয়েছে, ‘এবং সে মনগড়া কথাও বলে না, এটা তো ওহি, যা তার প্রতি প্রত্যাদেশ হয়।’ (সূরা আন-নাজম, আয়াত: ৩-৪)
হজরত ঈসা (আ.)-এর সমকালে এবং তাঁর জন্মের আগেও রোজার প্রমাণ পাওয়া যায়। পবিত্র কোরআনে উল্লেখ আছে যে হজরত ঈসা (আ.)-এর যখন জন্ম হয়, তখন লোকেরা তাঁর মাতা মরিয়মকে তাঁর জন্ম সম্পর্কে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘আমি করুণাময়ের উদ্দেশ্যে মানতের রোজা রেখেছি। সুতরাং আজ আমি কিছুতেই কোনো মানুষের সঙ্গে বাক্যালাপ করব না।’ (সূরা মার্য়াম,আয়াত: ২৬) হজরত ঈসা (আ.) তাঁর ধর্ম প্রচার শুরুতে ইঞ্জিল পাওয়ার আগে জঙ্গলে এক নাগাড়ে ৪০ দিন সিয়াম সাধনা করেছিলেন। তিনি বলেছেন, ‘উপবাস পালনকালে মুখ মলিন করবে না, বরং মাথায় তেল মেখে পবিত্রতা অর্জন করবে এবং মুখমণ্ডল ধৌত করবে।’ হজরত ঈসা (আ.)-এর অনুসারী সম্প্রদায়ও রোজা রাখতেন। একদিন হজরত ঈসা (আ.)-কে তাঁর বিশ্বস্ত অনুসারীরা জিজ্ঞেস করেন যে, ‘আমরা অপবিত্র আত্মাকে কী করে বের করব?’ জবাবে তিনি বলেন, ‘তা দোয়া ও রোজা ছাড়া অন্য কোনো উপায়ে বের হতে পারে না।’ (মথি ৭-৬৬, সিরাতুন নবী, পঞ্চম খণ্ড, পৃ. ২৮৭-২৮৮) পবিত্র বাইবেলে রোজাব্রত পালনের মাধ্যমেই আত্মশুদ্ধি ও কঠোর সংযম সাধনার সন্ধান পাওয়া যায়।
[ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: গবেষক ও কলাম লেখক।]