১০ ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি পোল্ট্রি খাত
প্রকাশিত হয়েছে : ১৬ জুন ২০১৫, ৭:০৯ পূর্বাহ্ণ
পূর্বদিক ডেস্ক ::
মাত্র সাতদিন আগেও একদিন বয়সী ব্রয়লার মুরগির বাচ্চা ৫৩/৫৪ টাকায় বিক্রি হয়েছে। যার দাম গতকাল ছিল ৭২/৭৪ টাকা। ৭ দিনের ব্যবধানে বাচ্চাপ্রতি দাম বেড়েছে ১৯ টাকা। আসন্ন রমজান ও ঈদকে কেন্দ্র করে একদিনের বাচ্চার লাগাম ছাড়া দাম।
প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র খামারি এবং হ্যাচারি সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একদিনের একটি ব্রয়লার বাচ্চা উৎপাদনের খরচ কোনোভাবেই ২৮ টাকার বেশি নয়। অথচ আদায় করা হচ্ছে দ্বিগুণেরও বেশি দাম। তাদের দাবি, ২০১০ সালের ২০ অক্টোবর সব ধরনের ব্যয় সমন্বয় করে একদিনের বাচ্চার উৎপাদন মূল্য ২২ টাকা নির্ধারণ করে সরকার। ওই সময় ‘লাভ’ ধরে ৩০ টাকায় বাচ্চা বিক্রির প্রতিশ্রুতি দেয় বাচ্চা উৎপাদনকারী ব্যবসায়ীরা। নির্ধারিত দামে ২ দিন বিক্রির পরই হাইকোর্টে রিট করে নিজেদের পক্ষে রায় নেয় ব্যবসায়ীরা। তারা সরকারের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা এবং নিজেদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে খেয়ালমতো দাম আদায় করতে থাকে।
খামার মালিক ও সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, বাচ্চা উৎপাদনকারী ১০ ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে দেশের পোল্ট্রি শিল্প। তাদের কারসাজিতেই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে মুরগির বাচ্চার দাম। তারা জানান, চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন ঘাটতি (সপ্তাহে একদিনের বাচ্চার চাহিদা ১ কোটি ১০ লাখ, উৎপাদন ১ কোটি ৮ লাখ) তেমন না থাকলেও দাম অস্বাভাবিকহারে বাড়ছেই। খামারিদের দাবি, এখনো একদিনের বাচ্চা উৎপাদনের খরচ কোনোভাবেই ২৬ টাকার বেশি নয়। সরকারের তদারকি ও জবাবদিহিতা থাকলে পোল্ট্রি খাত এতোটা অরক্ষিত হতো না।
পোল্ট্রি খামার রক্ষা জাতীয় পরিষদের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ও গাজীপুরস্থ ইউনাইটেড এগ্রো কমপ্লেক্সের স্বত্বাধিকারী খন্দকার মোহাম্মদ মহসীন জানান, একদিনের ব্রয়লার মুরগির বাচ্চা গতকাল ৭২ থেকে ৭৪ টাকায় বিক্রি করা হয়েছে। উচ্চদামের ফাঁদে ফেলে পরিকল্পিতভাবে প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র খামারিদের ধ্বংস করা হচ্ছে।’
তিনি আরও জানান, ঈদকে সামনে রেখে ব্যবসায়িকভাবে লাভবান হওয়ার বহু আকাঙ্ক্ষা করে খামারিরা। কিন্তু প্রতিবারই তাদের আশায় আগুন ধরিয়ে ধ্বংস করে দিচ্ছে একশ্রেণির বাচ্চা উৎপাদনকারী। বাচ্চার অস্বাভাবিক মূল্যের কারণে পুঁজি হারানোর হুমকিতে পড়েছে দেশের ৮৮ হাজার খামারি, একইসঙ্গে কর্মসংস্থান হারানোর আশঙ্কা করছেন কর্মরত ৪৭ লাখ কর্মী। বড় ধরনের বিপাকে পড়তে যাচ্ছে এ খাতের সুবিধাভোগী ১ কোটি মানুষও।
এদিকে বাচ্চা উৎপাদনকারী ব্যবসায়ীদের সংগঠন ব্রির্ডাস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-এর সাধারণ সম্পাদক সাইদুর রহমান বাবুও একদিনের বাচ্চার অস্বাভাবিক দাম বাড়ার তথ্য স্বীকার করে বলেন, ‘ঈদ উপলক্ষে নতুন নতুন ব্যবসায়ীর জন্ম হয়। এ জন্য হঠাৎই দাম বেড়েছে। চড়া এ দাম দু’দিন পরই কমে যাবে।’
নওগাঁ সান্তাহারের তৃপ্তি পোল্টি ফার্মের স্বত্বাধিকারী খামারি নাহিদ সুলতানা জানান, ‘বাচ্চার অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধিতে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক খামারিরা নিষ্পেষিত-নির্যাতিত। এক সময়ের লাভজনক ব্যবসা এখন আতঙ্কে রূপ নিয়েছে। বাচ্চা ও মুরগির দাম ওঠানামা করে ইচ্ছেমতো, যা নিয়ন্ত্রণে কারো কোনো পদক্ষেপ নেই।’
কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলা পোল্ট্রি খামারি সমিতির সভাপতি কাজী মোস্তফা কামাল বলেন, ‘কুমিল্লার বিভিন্ন খামারি গতকালও ৭২ থেকে ৭৪ টাকায় একদিনের বাচ্চা কিনেছে। আগামী ৭ দিনে এ দাম আরো বাড়বে। আর ৭২/৭৫ টাকায় বাচ্চা কিনে ৩৫ দিন লালনপালনের পর (ফিড, ওষুধ, কর্মচারী বেতনসহ একটি দেড় কেজির মুরগিতে উৎপাদন খরচ পড়বে ২২০ থেকে ২৩০ টাকা।) উৎপাদন খরচ কেজিতে পড়বে অন্তত ১৬০ টাকা। এ হিসেবে বাজারদর থাকলে ঈদের সময় এক কেজি মুরগি কিনতে ১৭০ থেকে ১৮০ টাকা গুনতে হবে ভোক্তাদের। তিনি বলেন, দ্রুত বাচ্চার দাম না কমলে দেশব্যাপী বৃহত্তর আন্দোলনে যাওয়া ছাড়া খামারিদের কোনো পথ নেই। তার দাবি, পোল্ট্রি খাতের সঙ্গে ১ কোটি মানুষ জড়িত থাকলেও এবং বেকার সমস্যা সমাধানে বড় ধরনের ভূমিকা রাখলেও সরকার সংশ্লিষ্টদের তদারকি নেই এ শিল্পের দিকে, যা সত্যিই দুঃখজনক।
পোল্ট্রি ব্যবসায়ীরা জানান, বর্তমানে প্রান্তিক খামারিরা প্রতি কেজি মুরগি পাইকারি ১১০ থেকে ১২০ টাকায় বিক্রি করছে, যা ঢাকার বাজারে খুচরা বিক্রি হচ্ছে ১৩০ থেকে ১৫০ টাকায়।
এদিকে পোল্ট্রি খামার রক্ষা জাতীয় পরিষদের গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ‘২০০৯ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে একদিনের একটি ব্রয়লার বাচ্চা ১২ থেকে ১৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। আর এ সময়ে ৫০ থেকে ৭০ টাকা কেজিতে মুরগি কিনেছে ভোক্তারা।
১০ ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি পোল্ট্রি খাত
সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করে বলেন, দেশের সম্ভাবনাময় পোল্ট্রি খাত এখন ১০ ব্যবসায়ীর ইচ্ছা-অনিচ্ছার কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। বাচ্চার দাম বাড়াতে কাজী ফার্মস, আফতাব গ্রুপ, প্যারাগন, নীলসাগর, সিপি, বি এগ্রো, আগা হ্যাচারি, আমান হ্যাচারি, প্রোভিটা ও নারিশ প্রত্যক্ষভাবে ভূমিকা রাখছে। ব্যবসায়ীরা জানান, যেকোনো একটি হ্যাচারি প্রতিদিন সকালে বাচ্চার দাম নির্দিষ্ট করে ডিলারদের কাছে মোবাইলে এসএমএস দেয়। পরে অন্য কোম্পানিগুলো একই পথ অনুসরণ করে। এর আগে বাচ্চার অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির সময় এক গোয়েন্দা সংস্থা তাদের প্রতিবেদনেও এসব ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের অতিরিক্ত অর্থলিপ্সার মনোভাবের তথ্য তুলে ধরে।
প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক আতাউর রহমান জানান, ‘উৎপাদন ঘাটতির কারণেই হঠাৎ করে দাম বেড়েছে বাচ্চার। ১ মাসের মধ্যেই দাম নিয়ন্ত্রণে আসবে।’