জাতীয় সংসদে আজ ২ লাখ ৯৫ হাজার কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা
প্রকাশিত হয়েছে : ৪ জুন ২০১৫, ৬:০৭ পূর্বাহ্ণ
অর্থ-বাণিজ্য ডেস্ক ::
একজন অর্থমন্ত্রীর জন্য সবচেয়ে দুশ্চিন্তার নাম মূল্যস্ফীতি। মূল্যস্ফীতি এখন অনেক কম, সাড়ে ৬ শতাংশের মতো। অর্থমন্ত্রীর সামনে সুযোগ রয়েছে সীমিত আয়ের সাধারণ মানুষকে আরও খানিকটা স্বস্তি দেওয়ার। কারণ, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দর কমেছে, কমছে ভোগ্যপণ্যের দামও।
বৈদেশিক মুদ্রার মজুত মজবুত অবস্থানে। প্রবাসী-আয় আবারও ঘুরে দাঁড়িয়েছে। লেনদেনের ভারসাম্য পুরোটাই অনুকূলে। বাড়ছে শিল্প উৎপাদন।
এতগুলো অনুকূল সূচক নিয়েই আজ বৃহস্পতিবার আবুল মাল আবদুল মুহিত ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করবেন। তবে সাধারণ মানুষের সূচক কিন্তু এতটা অনুকূল নয়। মূল্যস্ফীতি কমলেও খাদ্যবহির্ভূত পণ্যে মূল্যসূচক কিন্তু বাড়ছে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, পরিবহন ও স্বাস্থ্যসেবায় মানুষের খরচ অনেক বেশি বেড়ে যাচ্ছে। এর ওপর আবার সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বাড়ছে। এতে নতুন করে বাড়তে পারে মূল্যস্ফীতির চাপ।
বেসরকারি ও বিদেশি বিনিয়োগ একই অবস্থায় থেকে যাওয়ায় কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ছে না। বাড়তি কাজ করে কেউ কেউ জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাচ্ছেন, কেউবা সাগরপথে পাড়ি দিতে গিয়ে গণকবরে ঠাঁই নিচ্ছেন। রপ্তানি আয় আগের মতো বাড়ছে না, দুশ্চিন্তায় পোশাকমালিক ও শ্রমিকেরা। বাম্পার ফলন ফলিয়েও ধানের দাম পাচ্ছেন না কৃষকেরা।
অর্থমন্ত্রী কি পারবেন এসব দুশ্চিন্তা থেকে সীমিত আয়ের মানুষকে স্বস্তি দিতে? নতুন বাজেট হবে ২ লাখ ৯৫ হাজার কোটি টাকার। কিন্তু প্রায় তিন লাখ কোটি টাকার এই বাজেটের সুফল পাবেন কজন? অর্থমন্ত্রী গতকালই প্রথম আলোকে বললেন, ‘বাজেটটি হবে অর্থনীতিকে বেগবান ও কার্যকর করার। এটি হবে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের পথনকশা।’ আগে কখনো তিনি ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারেননি। এবার কি পারবেন? বিনিয়োগ বাড়ছে না বলে মোট দেশজ উৎপাদনেও (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি নেই। অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, সেটি করতে হলে বড় ধরনের সংস্কার করতে হবে। অর্থমন্ত্রী করবেন? তাহলে ২০২১ সাল নাগাদ কী করে বাংলাদেশ হবে মধ্যম আয়ের দেশ?
বেসরকারি বিনিয়োগ না বাড়ায় অর্থমন্ত্রীর ভরসা এখনো সরকারি বিনিয়োগ। এরই ধারাবাহিকতায় এবারও বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) ঠিক করেছেন ৯৭ হাজার কোটি টাকা। কেবল সরকারি বিনিয়োগ দিয়ে প্রবৃদ্ধি টিকে থাকবে?
বিশাল বাজেটের জন্য প্রয়োজন বড় রাজস্ব আয়। নতুন অর্থবছরের জন্য মোট রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে ২ লাখ ৮ হাজার ৭৭০ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) অংশ হবে ১ লাখ ৭৬ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। এ ক্ষেত্রে প্রথমবারের মতো আয়করকে রাজস্ব আয়ের প্রথম উৎস হিসেবে বিবেচনা করছেন অর্থমন্ত্রী। এর পরেই থাকছে মূল্য সংযোজন কর বা মূসক। আয়কর খাত থেকে নতুন লক্ষ্যমাত্রা হতে পারে ৬৫ হাজার ৯৩২ কোটি টাকা। এ ছাড়া মূসক খাত থেকে আসবে ৬৩ হাজার ৯০২ কোটি টাকা।
চলতি অর্থবছরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা থেকে নতুন অর্থবছরে ৩০ শতাংশ বেশি আদায় করতে হবে। টাকার অঙ্কে তা প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। করের এই বোঝা নিয়ে কতটা স্বস্তিতে থাকবে মানুষ?
কালোটাকা সাদার সুযোগ
আগামী অর্থবছরেও বিনা প্রশ্নে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ থাকছে। থাকবে স্বেচ্ছায় অপ্রদর্শিত আয় বৈধ করার সুযোগ।
ফ্ল্যাট কেনায় কালোটাকা বিনিয়োগ করলে বরং বর্গমিটারপ্রতি করের পরিমাণ কমানো হতে পারে। চলতি অর্থবছরেও ফ্ল্যাট কেনায় এলাকাভেদে নির্ধারিত পরিমাণ কর দিয়ে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ রয়েছে, তা অব্যাহত থাকছে।
দুই বছর আগে আয়কর অধ্যাদেশে ১৯ই নামে একটি ধারা সংযোজন করে অপ্রদর্শিত আয় বিনিয়োগ করার যে ঘোষণা দিয়েছিল সরকার, তা বহাল থাকছে। তবে এই আয় বৈধ উপায়ে হতে হবে, আয়ের উৎস জানাতে হবে।
বাড়ছে উৎসে কর
পোশাকসহ কিছু খাতে উৎসে কর বাড়তে পারে। করের খড়্গ নামতে পারে এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্থায়ী আমানতের মুনাফার ওপর ১০ শতাংশ উৎসে কর বসতে পারে।
তৈরি পোশাক রপ্তানি করলে রপ্তানিমূল্যের ওপর দশমিক ৩ শতাংশ হারে করারোপের বিধানটির মেয়াদ ৩০ জুন শেষ হচ্ছে। আগামী অর্থবছর থেকে এ হার আগের মতো দশমিক ৮ শতাংশ করা হতে পারে।
হিমায়িত খাদ্য, পাট, চামড়া, সবজি ও প্যাকেটজাত খাদ্য রপ্তানি একইভাবে উৎসে কর ১ শতাংশ করা হতে পারে। এসব খাতে বর্তমানে দশমিক ৬ শতাংশ হারে উৎসে কর রয়েছে। এ ছাড়া সিকিউরিটিজের সুদ আয়, ঠিকাদার বিল, চিকিৎসকদের ফি, রয়ালটি ফি, সিগারেটের ব্যান্ডরোল, ইট প্রস্তুতকারক, গৃহসম্পত্তির আয় ইত্যাদিতে উৎসে কর বাড়তে পারে।
করমুক্ত আয়সীমা বাড়ছে
বাজেটে সাধারণ করদাতাদের খানিকটা স্বস্তি দিতে ব্যক্তিশ্রেণির করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো হতে পারে।
সাধারণ করদাতাদের ক্ষেত্রে এ সীমা হবে আড়াই লাখ টাকা পর্যন্ত। একই সঙ্গে বাড়বে নারী ও ৬৫ বছর বা তদূর্ধ্ব পুরুষ করদাতা, প্রতিবন্ধী এবং যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের করমুক্ত আয়সীমা।
করারোপের জন্য আয়ের স্তরগুলো অপরিবর্তিত থাকবে। উল্লেখ্য, বর্তমানে সাধারণ ব্যক্তিশ্রেণির করমুক্ত আয়সীমা ২ লাখ ২০ হাজার টাকা।
করপোরেট কর কমছে
আগামী বাজেটে করপোরেট করহার পুনর্বিন্যাস করা হচ্ছে। ব্যাংক, বিমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের করহার ৪০ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হতে পারে। তবে শেষ মুহূর্তে বদলে যেতে পারে এ সিদ্ধান্ত।
শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির করহার আড়াই শতাংশ কমিয়ে ২৫ শতাংশ করা হতে পারে। এ ছাড়া শেয়ারবাজারের মুনাফায়ও কিছুটা স্বস্তি মিলবে। শেয়ারবাজার থেকে মুনাফায় করমুক্ত আয়সীমা ২০ হাজার টাকার পরিবর্তে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত করা হতে পারে।
আরও কিছু পরিবর্তন
সিটি করপোরেশনসহ সব এলাকায় ন্যূনতম করের পরিমাণ এক হাজার টাকা বাড়ানো হতে পারে। এ করের পরিমাণ হতে পারে সিটি করপোরেশন এলাকায় চার হাজার টাকা, জেলা সদরের পৌরসভায় তিন হাজার টাকা ও অন্য এলাকায় দুই হাজার টাকা।
নতুন বেতনকাঠামো দিয়ে সরকারি কর্মকর্তাদের খুশি করা হলেও তাঁদের ওপর করের বোঝা কিছুটা বাড়ানো হচ্ছে। মূল বেতনের বাইরে বোনাস-ভাতার ওপর কর বসতে পারে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত উচ্চ বেতনভোগীদের গ্র্যাচুইটির ওপর করারোপ হতে পারে।
সারচার্জ আরোপে সম্পদশালীদের কিছুটা ছাড় দেওয়া হতে পারে ভবিষ্যতে। সে ক্ষেত্রে ন্যূনতম সারচার্জ আরোপের সীমা শুরু হতে পারে সোয়া দুই কোটি টাকা। এর বেশি সম্পদ থাকলে ওই করদাতার প্রদত্ত করের ১০ শতাংশ হারে সারচার্জ দিতে হবে। সারচার্জ আরোপের অন্য হার অপরিবর্তিত থাকবে। এ ছাড়া তথ্যপ্রযুক্তি খাতের কর অবকাশ-সুবিধা ২০২৪ সাল পর্যন্ত হচ্ছে। বর্তমানে ২০১৯ সাল পর্যন্ত এ খাতটি কর অবকাশ-সুবিধা পায়।
আবার আমদানি পর্যায়ে চাল, গম, চিনিসহ কিছু পণ্যে নতুন করে অগ্রিম কর বসানো হতে পারে। অন্যদিকে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে বহুতল আবাসিক ভবন নির্মাণ করলে কর রেয়াত বা অবকাশ-সুবিধা মিলতে পারে।
গত বাজেটের মতো এবারও সম্পূরক শুল্কে বড় ধরনের পরিবর্তন আসতে পারে। সম্পূরক শুল্কের স্তর ও হার পুনর্বিন্যাস করা হতে পারে। এতে শতাধিক পণ্যের সম্পূরক শুল্ক নিকটবর্তী নিম্নতম স্তরে চলে যাবে।
অন্যদিকে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে টার্নওভার করসীমা বাড়িয়ে ৩৬ লাখ করা হতে পারে। বেশ কিছু পণ্য ও সেবায় মূসকের হার বৃদ্ধির পাশাপাশি আওতাও বাড়তে পারে। মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিতে বর্তমানে কোনো শুল্ক না থাকলেও আগামীবার এতে শুল্ক বসতে পারে।