গণিতের কিংবদন্তী জন ন্যাশের জীবনাবসান
প্রকাশিত হয়েছে : ২৫ মে ২০১৫, ৬:৫০ পূর্বাহ্ণ
বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ডেস্ক ::
এ বিউটিফুল মাউন্ড সিনেমার শেষ দৃশ্যে পর্দায় কয়েকটি লাইন ভেসে ওঠে। যারা সত্যিকারের জন ন্যাশকে চিনতেন না, ওই ক’লাইন পড়ে তাদের অনেকেই হয়ত স্তদ্ধ হয়েছিলেন কয়েক মুহূর্ত। “জন এবং অ্যালিসিয়া ন্যাশ নিউ জার্সির প্রিন্সটনে বসবাস করেন। গণিত বিভাগে জন এখনও নিয়মিত অফিস করেন এবং প্রতিদিন হেঁটে ক্যাম্পাসে যান।”
ওই কয়েক লাইনে দর্শক তীব্র মানসিক ঝাঁকিতে উপলব্ধি করেন, গণিতের অসম্ভব প্রতিভাবান অধ্যাপক, যিনি দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন সিজেফ্রেনিয়ায় এবং যার উদভ্রান্ত, ব্যথাতুর অথচ চমৎকার একটি সুন্দর মন ছিল, সেই জন ন্যাশ কোনো কাল্পনিক চরিত্র নন।
২৩ মে রোববার জীবনাবসান ঘটল প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের এই গণিত প্রতিভার। তার বয়স হয়েছিল ৮৬। নিউ জার্সির পুলিশ দপ্তরের তথ্যানুসারে অধ্যাপক ন্যাশ এবং তার স্ত্রী অ্যালিসিয়াকে বহনকারী ট্যাক্সি ক্যাবটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনায় পরে। অধ্যাপকের স্ত্রী-ও ঘটনাস্থলেই মারা যান। অ্যালিসিয়া ন্যাশ-এর বয়স হয়েছিল ৮২।
প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালে জন ন্যাশ গেইম থিওরি বিষয়ে ২৭ পৃষ্ঠার একটি থিসিস লিখেছিলেন। একাধিক প্রতিপক্ষ আছে এমন পরিস্থিতিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ বিষয়ে গাণিতিক ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছিল তার ওই থিসিসে। তার ওই সিদ্ধান্ত পরে কাজে লেগেছে আন্তঃরাষ্ট্রীয় বোঝাপড়ায়, কম্পিউটার বিজ্ঞানে, অর্থনীতিতে, রাজনীতিতে এমনকি জীববিজ্ঞানেও। প্রকৃত অর্থে প্রতিযোগিতা রয়েছে এমন যে কোনো বাস্তবতায় ব্যবহৃত হয়েছে তার দেওয়া সিদ্ধান্ত। গেইম থিওরি বিষয়ে সম্ভবত সবচেয়ে আলোচিত সূত্রের জনক জন ন্যাশ। অথচ যে সময় তার সূত্র ব্যাপক আকারে ব্যবহার শুরু হয়েছে নানা ক্ষেত্রে, সেসময় তিনি ছিলেন প্রায় আড়ালেই।
খুব সহজ ভাষায় বলা চলে গেইম থিওরির অন্যতম প্রতিপাদ্য হচ্ছে দুই বা ততোধিক পক্ষের মধ্যে সিদ্ধান্তগ্রহনে কোনো এক পক্ষের যতটা লাভ হবে, সেটি বাদবাকী সবার মিলিত লোকসানের সমান। জন ন্যাশ এই বিষয়ে আরো জটিল পরিস্থিতির বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেন যা ন্যাশ ইকুইলিব্রিয়াম নামে পরিচিত। ১৯৫৮ সালে মাত্র ৩০ বছর বয়সেই ফরচুন ম্যাগাজিন তাকে বিশ্বের সেরা গণিতবিদদের একজন বলে ঘোষণা করে। ১৯৫৯ সালে তিনি গণিতে ডক্টরেট অর্জন করেন। একই সময়ে, যখন তিনি ক্যারিয়ারের শিখরে অবস্থান করছেন, তিনি ক্রমশ অসুস্থ হতে শুরু করেন। তিনি সিজেফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত হন এবং তার দৃষ্টিবিভ্রম ঘটতে থাকে।
প্রথমে প্যারানয়েড সিজোফ্রেনিয়া, তারপর সেখান থেকে সুস্থ হয়ে ফিরে আসা এবং তারও অনেক পরে তিনি তার কাজের স্বীকৃতি পান। ১৯৯৪ সালে তিনি নোবেল পুরস্কার জেতেন অর্থনীতিতে।
যে কমিটি জন ন্যাশকে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত করেছিল তার প্রধান আসার লিন্ডবেক জন ন্যাশের জীবনীগ্রন্থের লেখক সিলভিয়া নাসারকে বলেছিলেন, “আমরা তাকে দিনের আলোতে ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করেছি।” আসার লিন্ডবেকের মতে, “নোবেল জেতা তার জন্য ছিল পুনরুথ্থান”। কথাটি মিথ্যে নয় হয়তো। বাস্তব পৃথিবীতে তার অনুপস্থিতি এমনই ছিল যে, গণিত বিষয়ে আগ্রহীদের মধ্যেও অনেকে বিশ্বাস করতেন, জন ন্যাশ সম্ভবত মারা গেছেন।
সিলভিয়া নাসারের লেখা জন ন্যাশের জীবনী প্রকাশিত হয় ১৯৯৮ সালে, নাম ছিল ‘এ বিউটিফুল মাইন্ড’। ওই একই নামে ওই জীবনী অনুসারেই তৈরি হলিউডি চলচ্চিত্র তিন বছর পরে গোটা বিশ্বে সাধারণ মানুষের কাছে তার পরিচিতি তুলে ধরে। ২০০১ সালে তৈরি ওই চলচ্চিত্র প্রকাশের পর প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে তার নামে এত ই-মেইল আসতে শুরু করে যে, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তার ই-মেইল আইডি স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেয়। হলিউডি সিনেমায় তৈরি জনপ্রিয়তার কারণেই হয়তো, জন ন্যশকে বলা চলে একুশ শতকের সবচেয়ে জনপ্রিয় গণিতবিদ।
বলা হয়ে থাকে, কোনো সমস্যার সমাধান বা সম্ভাব্য সূত্রের ধরন তিনি স্রেফ যুক্তিগ্রাহ্য ধারণা থেকে বলে দিতে পারতেন, এ কাজে তিনি প্রথাগত গবেষণামূলক প্রমাণ খোঁজার চেষ্টা করতেন না।
সিলভিয়া নাসার জন ন্যাশকে বর্ণনা করেন গ্রিক ট্র্যাজেডির নায়কের মতো, যার পতন ঘটেছে। এ পতন সিড়ি থেকে পতন নয়, একেবারে নক্ষত্রের পতন। ২০ বছর বয়সে সিনেমার নায়কোচিত চেহারা নিয়ে প্রিন্সটনে আগমন। পরের ১৪ মাসে দুনিয়া কাঁপানো থিওরি যাতে তিনি বর্ণনা করেছেন মানুষের সংঘাত আর মিলের গাণিতিক রূপ। যার জন্য ৪০ বছর পর তিনি নোবেল জিতেছেন। ৩০ বছর বয়সের মধ্যেই বিশুদ্ধ গণিতে তার আকাশছোঁয়া সাফল্য আর বর্ণাঢ্য ব্যক্তিত্বের কারণে গণিতশাস্ত্রের জগতে তারকাখ্যাতি। সহকর্মী গণিতবিদদের মতে ন্যাশ ছিলেন, “এ ব্যাড বয়, বাট এ গ্রেট ওয়ান।”
২০০২ সালের অস্কারে এ বিউটিফুল মাইন্ড যখন ৪টি অস্কার জেতে, সেসময় দর্শক সারিতে কালো টাই পরে মুখে স্মিত হাসি নিয়ে বসেছিলেন জন ন্যাশ। পরের দিন জীবনী লেখক সিলভিয়া নাসারকে তিনি বলেছিলেন, “অস্কার অনেকটাই নোবেল পুরস্কারের মতো। পণ্ডিতরাই এতে যুক্ত থাকে আর থাকে অনেক রাজনীতি।” এখন কী করবেন এমন প্রশ্নের জবাবে ন্যাশ স্বভাবসুলভ দুষ্টামি মাখা স্বরে জবাব দিয়েছিলেন, “অটোগ্রাফ দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হব, ১৯৯৪ সালের পর আর অটোগ্রাফ দেওয়া হয়নি”।