ভেজাল ও ক্ষতিকারক প্রসাধনী পণ্যে বাজার সয়লাব
প্রকাশিত হয়েছে : ৮ মে ২০১৫, ৮:২৭ পূর্বাহ্ণ
পূর্বদিক ডেস্ক ::
ঢাকার চকবাজার দেশের সবচে বড় কসমেটিকস মার্কেট হিসেবে পরিচিত। এখানে রাস্তার দুধারী এবং দুই-তিন তলা মার্কেটে সারি সারি কসমেটিকসের দোকান। মূলত এই দোকানগুলো থেকে পাইকারি হারে বিক্রি হয় পণ্য। এখানে দেশি, বিদেশি পণ্য যেমন পাওয়া যায় তেমনি পাওয়া যায় তাদের ভাষায় “২ নম্বর কসমেটিকস”। তবে এই ২ নম্বরের মধ্যে দেশি-বিদেশি নামকরা ব্রান্ডের পণ্যও কিন্তু রয়েছে।
পুলিশের অভিযানের ভয়ে প্রথমেই কেউ ২ নম্বর পণ্যের খোঁজ দিতে চায় না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ২ নম্বর কসমেটিকস সম্পর্কে এক দোকান মালিক বলছিলেন, “পন্ডস পাউডার, সানসিল্ক শ্যাম্পু, ডাভ, হেড এন্ড শোল্ডার, হিমালয়া ফেসওয়াস, তেলের মধ্যে ভাটিকা, কুমারিকা, আমলা এসব আছে। এগুলো সব ২ নম্বর। চায়না থেকে কন্টেইনার আসে আমরা এখানে তৈরি করি। মার্কেটে আপনি যে দামে কিনবেন তার অর্ধেক দামে এখানে ঐগুলাই পাওয়া যায়। এগুলা মাখলে কোন ইফেক্ট নেই। ভাল-খারাপ কিছুই হয় না। যশোর, চিটাগাং, রাজশাহী, খুলনা, কুষ্টিয়া, হবিগঞ্জ সব জায়গায় আমাদের কাস্টমার আছে। তারা ফোন করলে আমরা পরিবহনে মাল পাঠিয়ে দিই।
ক্ষতিকারক উপাদানে তৈরি হচ্ছে প্রসাধনী, সাবান
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা যায় দেশে যে পরিমাণ কসমেটিকস অর্থাৎ স্নো, ক্রিম, শ্যাম্পু, সাবান, লোশন, আফটার-শেভ লোশন, পারফিউম এসব চাহিদা রয়েছে তার ১৫ শতাংশ পূরণ হচ্ছে দেশিয় কোম্পানির উৎপাদনে। আর ১৫ শতাংশ -আমদানি করা বিদেশি পণ্য। বাকি ৭০ শতাংশ কসমেটিকস নকল ও ক্ষতিকারক উপাদান দিয়ে তৈরি হচ্ছে ।
গবেষণায় বলছে পুরান ঢাকার চকবাজার, জিঞ্জিরা, ইসলামপুর এবং ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলা শহরে এই ভেজাল কসমেটিকস তৈরির কারখানা গুলো গড়ে উঠেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের অধ্যাপক আবু সারা শামসুর রউফ বলেন, ভেজাল করার ক্ষেত্রে শুধুমাত্র সুগন্ধিটি ছাড়া বাকিটা ক্ষতিকারক উপাদানে তৈরি হয়। যে পরিমাণ ফরমালডিহাইড থাকলে ক্ষতি হবে না, সেটা অনেক বেশি পরিমাণে হচ্ছে, প্রিজারভেটিভ এবং এন্টি অক্সিডেন্ট ব্যবহারের মাত্রা থাকে ভেরি ভেরি হাই। এর প্রথম উপসর্গ হবে রোগীর এলার্জি দেখা দেবে।
তবে দেশিয় যেসব উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে তাদের পণ্যে এসব উপাদান ব্যবহারের ক্ষেত্রেও সঠিক নিয়ম মানা হয় না বলেও তিনি জানান।
দেশিয় প্রতিষ্ঠানের কসমেটিকসের কী অবস্থা
বাংলাদেশে কসমেটিকস পণ্য তৈরির পুরনো প্রতিষ্ঠান কোহিনুর কেমিক্যালস বলছে তাদের পণ্যের মান বিএসটিআইএর অনুমোদন প্রাপ্ত। তবে বাজারের তাদের ব্রান্ডের নকল পণ্যের ঘটনা সম্পর্কে তারা জানেন।
প্রতিষ্ঠানটির ভাইস প্রেসিডেন্ট( ব্রান্ড) গোলাম কিবরিয়া সরকার জানান, আমাদের সব পণ্য মান নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসটিআই এর কাছ থেকে অনুমোদন নেওয়া হয়। তাদের অনুমিত উপাদানের মাত্রা দিয়েই পণ্য উৎপাদন করি আমরা। তবে আমাদের পণ্য নকল হয় এটা অস্বীকার করার কিছু নেই।
তিনি আরো জানান, আমাদের ‘তিব্বত বল সাবান’ কিছু দিন আগে নকল বের হয় আমরা বাজার মনিটর করে আইনানুগ ব্যবস্থা নিয়েছি তাদের বিরুদ্ধে। যারা এগুলো করে তারা ঢাকার বাইরে প্রত্যন্ত এলাকায় একরকমের কারখানা করেও এই পণ্য নকল করার কাজ করে। তবে আমাদের ব্রান্ড ইমেজ বাজারে খারাপ হওয়ার আগেই আমরা ব্যবস্থা নিয়ে থাকি।
শরীরের জন্য কতটা ক্ষতিকর
অনন্ত ১০ টি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে কসমেটিকস উৎপাদন করছে। দেশে প্রসাধনীর বিপুল চাহিদাও রয়েছে। প্রতিদিন নানা ধরনের কসমেটিকস বাজারে আসছে, সাধারণ ভোক্তারা এইসব প্রসাধনীর চটকদার বিজ্ঞাপন দেখে অথবা অনেক সময় বাজারে যেয়ে এর গুনাগুণ শুনে দাম দিয়ে কেনেন এবং ব্যবহার করেন।
বিজ্ঞাপনের তাক লাগানো এসব পণ্যের ভিতরের উপাদান কতটা ক্ষতি করতে পারে?
বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের চর্ম বিভাগের অধ্যাপক লে. কর্নেল (অব) আব্দুল ওয়াহাব বলছিলেন, আমরা যেসব রোগী প্রতিদিন পায় তাদের মুখে কালো দাগ, র্যাশ, গোটা, লালা হয়ে যাওয়া, এলার্জি, অত্যধিক ঘাম ঝরে।
তিনি আরও বলেন, রোগীর কাছে যখন জানতে চাই কি ব্যবহার করে,তখন তারা কিছু ক্রিম, লোশনের কথা বলে যেগুলোতে আমরা পরীক্ষা করে দেখেছি মারাত্মক ক্ষতিকর উপাদান থাকে। তবে রোগীদের পক্ষে জানা সম্ভব না তারা কি ব্যবহার করছে।
এই উপাদানগুলোর ইমিডিয়েট এলার্জিক রিয়্যাকশনে রোগী মারা যেতে পারেন। এমন রোগী আমরা পেয়েছি। এছাড়া দীর্ঘদিন এসব ব্যবহারে ত্বক সহ কিডনি এবং শরীরে অন্য অংশে মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে।
গত বছরের ডিসেম্বরে ঢাকার চকবাজারে নকল ব্র্যান্ডের কসমেটিকসের পাইকারি মার্কেট ও কারখানায় অভিযান চালিয়ে দুই ট্রাক নকল কসমেটিকস জব্দ করে র্যাব।
এ বছরের মার্চ মাসে প্রায় ২০ কোটি মূল্যমানের খালি কন্টেইনার জব্দ করার খবর আসে গণমাধ্যমে। যেগুলোতে বিশ্বের নামি দামি ব্রান্ডের কসমেটিকসের খালি প্যাকেট ও কন্টেইনার ছিল।
দেশে চাহিদার একটা বড় অংশই তৈরি হচ্ছে স্থানীয় কারখানাগুলোতে ক্ষতিকারক উপাদান দিয়ে, পণ্যটি হচ্ছে নকল ও ভেজাল। কিন্তু যারা ভোক্তা, তারা পণ্যগুলোর মান সম্পর্কে হয় কিছু জানতে পারছেন না নয়ত ধারণা থাকলেও বিশ্বাসের ওপর ভর করেই ব্যবহার করছেন টাকা খরচ করে এসব দামি কসমেটিকস।