বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশের নারী শ্রমিকরা কতটা নিরাপদ
প্রকাশিত হয়েছে : ৫ এপ্রিল ২০১৫, ৮:৩৮ পূর্বাহ্ণ
পূর্বদিক ডেস্ক ::
বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কাজের উদ্দেশ্যে যে নারী শ্রমিক বিদেশ পাড়ি জমায় তার একটা বড় অংশ যায় মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে। সরকারি হিসেবে গত ২৬ বছরে বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সাড়ে তিন লাখের বেশি নারী শ্রমিক বিদেশ গিয়েছেন। নিরাপত্তাসহ অন্যান্য বিষয়ে সমস্যায় পড়লে কার কাছ থেকে তারা প্রতিকার চাইবেন সেটিও অনেকের কাছেই অস্পষ্ট।
মানবসম্পদ, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৩ সালে প্রায় ৫৭,০০০ নারী অন্যান্য দেশে কাজ করতে গেছে, যা আগের বছরের তুলনায় ৭% বেশি। ব্যুরোর সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রায় ২৭৫,০০০ বাংলাদেশি নারী (দেশটির অভিবাসী কর্মীদের ১১%) এখন আনুষ্ঠানিকভাবে প্রবাসে কাজ করছে, যাদের বেশিরভাগই গৃহকর্মীর কাজ করছে।
পুরুষ অভিবাসী কর্মীদের সংখ্যা কমে গেছে, ২০১২ সালে যেখানে ৬০৮,০০০ কর্মী বিদেশে গেছে সেখানে ২০১৩ সালে বিদেশে গেছে ৪০৯,০০০ কর্মী।
বিদেশে কাজ করতে যাওয়া কয়েকজন নারীর সাথে আলাপ যা জানা যায়-
সাতক্ষীরার মেয়ে শাহিনা আকতার। আরো অনেকের মত তার স্বপ্ন ছিল বিদেশে যাওয়ার। নিজের সঞ্চয় আর ঋণ করে ১ লাখ বিশ হাজার টাকা জোগাড় করেনর। এজেন্সির মাধ্যমে দুবাই যান মসজিদের কাজে ভাল বেতন জেনে।
দুবাই পৌঁছে দেখলেন কল্পনার সাথে বাস্তবের মিল নেই। মসজিদে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কাজ দেওয়ার কথা থাকলেও তাকে গৃহকর্মী হিসেবে পাঠানো হয় একজনের বাসায়।
শাহিনা আকতার বলছিলেন “শরীরে বিভিন্ন জায়গায় গ্লাস ছুড়ে মারতো। কাজে ভুল হলে মারধর করতো, শরীরে বিভিন্ন জায়গার এখনো ক্ষত চিহ্ন রয়েছে”।
একদিন মারধরের এক পর্যায়ে শাহিনা হঠাৎ করেই বলে বসেন যদি তার গায়ে হাত তোলা হয় তাহলে তিনি রাস্তার টহলরত পুলিশকে জানিয়ে দেবেন। এরপর তার বাড়ির মালিক যে এজেন্সির মাধ্যমে তাকে কাজে নিয়েছিল তাদের ডেকে শাহিনাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করে। কিন্তু সাত মাসের কাজের কোন বেতন তাকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি।
গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতে যাওয়ার ব্যাপারে কোন সন্দেহ না থাকলেও ভয়াবহ এক অভিজ্ঞতা শিকার হন আসমা।
আসমা বলছিলেন “ সাত দিনের মধ্যে পর পর দুই রাত দুই বাসায় তারা আমাকে রেপ করার চেষ্টা করে। আমি বলি আমারে কাজ দেন নাইলে দেশে পাঠায়ে দেন”
আসমাকে সেখানে দেহব্যবসার কাজে লাগাতে চেয়েছিল তার প্রেরণকারী। এক সপ্তাহ পর ওমান থেকে দেশে ফিরে আসেন আসমা। কিন্তু দেহব্যবসার করার অভিযোগে তার স্বামী এখন আর তার সাথে থাকতে চাচ্ছেন না।
বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কাজের উদ্দেশ্যে যে হাজার হাজার নারী শ্রমিক পাড়ি জমায় তার একটা বড় অংশ যায় মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে।
সরকারি হিসেবে গত ২৬ বছরে বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নারী শ্রমিকরা গিয়েছেন সাড়ে তিন লাখের বেশি।
যারা মূলত সেখানে কাজ করেন গৃহকর্মী হিসেবে। চলতি মাসের শুরু থেকে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা শহরে চলছে নারী শ্রমিকদের সৌদি আরবসহ নানা দেশে কাজ করতে যাওয়ার জন্য নামের নিবন্ধন।
বাংলাদেশের নারী শ্রমিকদের বিদেশে কাজ করার ক্ষেত্রে নিরাপত্তা-জনিত সমস্যা ছাড়াও ভাষা, সংস্কৃতি সেদেশের নিয়মকানুন নিয়ে প্রায়ই ঝামেলায় পড়তে হয়।
সেসব অভিজ্ঞতা নিয়ে তারা দেশে ফিরে আসেন আর গণমাধ্যমে এনিয়ে নানা সময়ে ওঠে আসে প্রতিবেদন।
অভিবাসন নিয়ে কাজ করছে বেসরকারি সংস্থা রামরু, তার কর্ণধার ড. তাসনিম সিদ্দিকি জানান, নারী শ্রমিকদের গৃহকর্মী হিসেবে বিভিন্ন দেশের চাহিদা রয়েছে। তবে সেখানে নিরাপত্তা সহ অন্যান্য বিষয়গুলো দেখার জন্য প্রত্যেকটি জায়গায় সরকারের শেল্টার হোম বা আশ্রয় কেন্দ্র থাকা উচিত। যাতে করে সেখানে কেও সমস্যায় পরলে সরাসরি যোগাযোগ করতে পারে।
রিক্রুটিং এজেন্সি অনেকটা দালালের মতই কাজ করে। সেক্ষেত্রে সাহায্য পাওয়াটা অনেক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশি শ্রমিকদের ৭০ শতাংশ যায় পরিবার বা পরিচিত লোক বা তাদের ভাষায় দালালের মাধ্যমে। আর ৩০ শতাংশ যায় বিভিন্ন রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে। সম্প্রতি সরকারি পর্যায়ে জি-টু-জি পদ্ধতি মালয়েশিয়া কর্মী পাঠানোর চুক্তি হলেও যা কার্যত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে।
সচেতনতা তৈরি বা প্রশিক্ষণের জন্য দেশে কী ব্যবস্থা আছে আর সেটি কতটাই বা যথেষ্ট জানতে চাইলে জনশক্তি রপ্তানি বিষয়ক- সরকারি প্রতিষ্ঠান -বিএমইটির -যুগ্ম সচিব সহিদুল ইসলাম জানান, “২১ দিনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, ওয়াশিংমেশিন চালানো, রাইসকুকার চালানো শেখানো হয়। ভাষা শেখানো হয়। তবে এটাই পর্যাপ্ত মন না। সরকার এই সময়কাল ৪২ দিনে নেওয়ার এবং আরো সমৃদ্ধ প্রশিক্ষণের চিন্তা ভাবনা করছেন।
বর্তমানে দেশে ১৬ টি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে যেখানে বিদেশে গমনেচ্ছুদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। সময়কাল ২১ দিন।
ড. তাসনিম সিদ্দিকি জানান, প্রশিক্ষণের সময়কাল এবং প্রশিক্ষণের মানের যথেষ্ট উন্নয়ন প্রয়োজন।
স্বল্প সময়ের প্রশিক্ষণ- নির্দিষ্ট দেশের ভাষা, কাজ আর পরিবেশ সম্পর্কে ভাসা ভাসা ধারণা নিয়ে প্রতিবছর কয়েক হাজার নারী শ্রমিক পাড়ি জমাচ্ছেন বিশ্বের নানা দেশে।
যেখানে নিরাপত্তাসহ অন্যান্য বিষয়ে সমস্যায় পরলে কার কাছ থেকে তারা প্রতিকার চাইবেন সেটিও অনেকের কাছেই অস্পষ্ট।