সূর্য যেদিন হার মেনেছিল তরুণদের কাছে…
প্রকাশিত হয়েছে : ২২ মার্চ ২০১৫, ১:১৩ অপরাহ্ণ
মহ্সীন মুরাদ
হার মেনেছিল সূর্যের আলো। তারুণদের কাছে। বলয়সহকারে কোন দুর্গম পথ কিংবা পাহাড়ের চূড়া জয়ের ইচ্ছা নিয়ে এগিয়ে যাওয়া আরোহীদের মতো এক ঝাঁক তরুণ-তরুণী। কখনো ওরা দল বেধে, কখনো খণ্ড হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে দেশের অন্যতম জাতীয় উদ্যানে লাউয়াছড়ার ভেতর দিয়ে। শুধু লাউয়াছড়াই নয় এখান থেকে শুরু হয়েছিল মাত্র। জেলার অন্যতম দর্শনীয় স্থান মাধবপুর লেইক পাশ্ববর্তি বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের স্মৃতি বিজড়িত স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গনও ছিল সূচির আওতাধীন। আনন্দঘন এ দিনটি ছিল ২১ মার্চ ২০১৫ শনিবার। মৌলভীবাজর সরকারি কলেজের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষা সফর। দুইটি বাসভর্তি শিক্ষার্থীর এ আনন্দ মেলায় যোগ দিয়েছিলেন এ বিভাগের সকল শিক্ষক, প্রভাষকবৃন্দ।
সূর্যের তাপ বাড়ার সাথে সাথে সরকারি কলেজের ফটক থেকে শুরু। বাস ভ্রমণে পিকনিক! সে আলাদা এক অনুভূতি। তার মাঝে সংযোগ দেয়া হয়েছিল সাউন্ড সিস্টেম। এখানে গায়ক ছিল সকল শিক্ষার্থীরাই। তাল-বেতাল গানে সুর দিতে কেউ কার্পণ্য করেনি। যে যেভাবে পারছে সেভাবেই সুর তুলেছে গানে। বাংলা, হিন্দি, বাউল, জারি সারি, ধামাইল কিংবা সিলেটি আঞ্চলিক গান। গানের দুচার লাইন পরে না পারলে আরেকটা শুরু এভাবে জগাখিচুরি টাইপের সিরিজ গান গাইতে গাইতে লাউয়াছড়া ফটকের সামনে চলে আসলো বাস। এখানে নেমে প্রথমেই সকালের নাস্তা খাওয়া হবে। তারপর সবাইকে অবমুক্ত করা হবে। এরকম বুঝা গেলো সবার হাব-ভাব। সে অনুপাতে সবাই খেয়ে তৈরি হল।
আস্তে আস্তে করে দুই সাইট দিয়ে ইটসলিংকৃত লম্বা রাস্তা ধরে সবাই চলতে লাগলো। সবার দূরত্ত্ব প্রায় একহাতের ভিতরেই ছিল। মৌন মিছিলের মতো। ঠিক মৌন মিছিলের মতো ছিলনা কারণ উদ্যানের বোর্ডে লেখা ছিল ‘নিরবে প্রকৃতিকে উপভোগ করুন চিৎকার করবেন না’ একটু একটু হৈ-হুল্লড় থাকায় শুধু সাড়িটাই ছিল মৌনমিছিলের সদৃশ। তারমাঝে তোলা হল অনেকগুলো ছবি। পাশাপাশি ইয়ারমেট আবেগী শিপন আর আজমল হোসাইনের হাস্যকর কথা শুনতে শুনতে শেষ হল লাউযাছড়ার হাটাপর্ব।
দুপুর ১টা বেজে ২৫ মিনিট। মাধবপুর লেইকে এসে পৌঁছলাম মাত্র। বাস নিয়ে ভিতরে ঢুকামাত্র সেখানের পাহারাদার ছেয়ে বসল ২শ টাকা। জাফর স্যার সেটা সামাল দিয়ে লান্স সেরে ফেলার আদেশ দিলেন। সেদিন খাওয়ার প্রতি খুব জোড় ছিল। যেখানেই যাওয়া হয়েছে সেখানেই খাওয়ার পর্বটা চলে এসেছে আগে। হয়তো এটাই ছিল এদিনের পরো নীতি। ফলে বহাল তবিয়তে এমন দায়িত্ব পালন করেছেন দায়িত্বশীলরা। লান্সের পরে ড্রিংস খেতে খেতে সবাই চললাম লেইকের ভিতর দিয়ে তবে এখন আগের মতো নয়। এবার ভাগ ভাগ হয়ে যার যেদিক ভাল লাগছে সেদিকেই যাচ্ছে। তবে শাহী স্যার একবার বলেছিলেন ‘যাও যেদিকে ইচ্ছে তবে আবার বিকাল ৩টার ভিতরে ফিরে এসো’।
ভরদুপুর। খাঁ খাঁ রোদ। মাথার উপর সোঁজাসুজি হয়ে পরছে। সূর্যের এ উত্তাপ উপক্ষা করে ছুটলো সবাই। সবুজঘেরা চা-পাতার মাঝখানটাতে দাঁড়িয়ে বুঝি ছবি তুলতে সবার ভাল লাগে। এ জন্য সবাই একবারের জন্য হলেও দাঁড়িয়েছে সেতায়।
শাপলাভর্তি পানিতে পা ডুবিয়েও ছবি তুলতে ভুলে নি রুবাইয়াৎ। গাছে হেলান দিয়ে কিংবা গাছকে টেনে ধরে বিভিন্ন ফ্যাশনেও সবাই ছবি তুলেছে অনেকে। টিলার উপর উঠার পর সামাদ সবার জন্য ২০ টাকার আইসক্রিম স্পন্সর করেছিল। পরবর্তিতে তার আর হয়নি। কারণ সেখানে আমিই অর্ধেকে ভাগ বসিয়ে দিয়েছিলাম।
৪টা বাজে। আমরা এখন বীর শ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের স্মৃতিবিজড়িত এলাকায়। এখানে হামিদুর রহমান স্মরণে রয়েছে স্মৃতিসৌধ। মনোমুগ্ধকর পরিবেশ। চারিদিকে চায়ের গাছ। সবুজের চাহনী। পরন্ত বিকেলে সূর্যটা পশ্চিমের আকাশে ধীর পায়ে হাঁটছে। এ সময় সৌধের দণি পাশের দেয়ালে ৩০/৪০ সাইজের একটা কাগজে হাতে আঁকা এক তরুণীর ছবি লাগিয়ে দিলেন মুন্নিয়া ম্যাডাম। চোখ বাঁধা অবস্থায় এ তরুণীর কপালে টিপ পড়াতে হবে ছেলেদের। যে ঠিক জায়গায় পড়াতে পারবে সে হবে ১ম। অল্পের জন্য ৩য় স্থান পেয়ে গেছিলাম। কিন্তু ভারত-বাংলাদেশের কোয়ার্টার ফাইনালের মতো হেরে গেছি। অন্যদিকে মেয়েরা খেলেছে মারবেল চামচ খেলা। প্রথমে একটা সাড়িতে ১০জন তরুণী দাঁড়িয়ে মুখের মধ্যে চামচ রাখবে। চামচের মাঝে রাখবে একটা মারবেল। তারপর হাঁটবে। মারবেল সহকারে এপাশ থেকে ওপাশে যে আগে যেতে পারবে সে প্রথম। আমাদের ইয়ারের রেহনুমা রুবাইয়াৎ অবশ্য ২য় স্থান পেয়েছিল। তারপর উন্মুক্ত দর্শক প্রতিযোগিতা ছিল। রেহনুমার কুপন নিয়ে আমি খেলায় উঠি। সেখানে গিয়ে পছন্দের গান গেয়ে শেষের স্থানটা অধিকার করি।
পশ্চিমের সূর্যটা আমাদের বাড়ির দিকে যেতে হাতছানীতে ডাকছে। কারণ সূর্যের সাথেই শুরু হয়েছিল আমাদের এ যাত্রা। তাই তার ডাকে সাড়া না দিয়ে পারি? এরই মধ্যে সবার হাতে বিশেষ পুরস্কার পৌঁছানো হল। তা ছিল একটি রাবার ও একটি করে কাঠপেন্সিল।
সবাই গাড়িতে উঠলাম বাড়ি ফিরব। খাবার এসে গেল ইয়ারমেট মেরাজের হাত ধরে। এবার বিরানী কিংবা খিচুরী নয় শুধু আপেল। সবাইকে আপেল দেয়া হল। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসায় বাইরের আর কিছু দেখা যায় না। শুধুমাত্র কিছুণ পর পর গাড়ির লাইট ছাড়া। কান্ত শ্রান্ত হয়ে সবাই বসে আছে গাড়ির সিটে। একসময় শহরের চৌমোহনায় এসে গাড়ি থামলে নেমে গেলাম যার যার বাসার পথ ধরে। জীবন ডায়েরিতে লিখার মতো মুহূর্তেগুলোর ইতি হল এখানেই।
সেদিন আমাদের সাথে ছিলেন, অর্থনীতি বিভাগের প্রভাষক ইমরান উদ্দিন, আবু জাফর চৌধুরী, মন্নিয়া চৌধুরী, মশিউর রহমান ও মাহমুদুল হাসান শাহী স্যার।