গ্রাম আদালতে জরিমানার পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে তিনগুণ
প্রকাশিত হয়েছে : ১৫ ডিসেম্বর ২০১৪, ১২:৪৪ অপরাহ্ণ
মহ্সীন মুরাদ ::
দিনদিন বেড়ে চলছে গ্রাম আদালতের সফলতা। এর মাধ্যমে ন্যায় বিচার পাচ্ছেন সাধারণ জনগণ। ফলে ইউনিয়মুখি হচ্ছে তারা। গ্রাম আদালতকে আরো সক্রিয় ও কার্যকর করতে গ্যাজেটের মাধ্যমে জরিমানার টাকার পরিমাণ বৃদ্ধি করা হয়েছে তিনগুণ।
সরেজমিন পরিদর্শন করে এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে জানা যায়, কম খরচ, কম সময়ে ছোট খাটো যেকোন মামলার বিচারকার্য নিষ্পত্তির জন্য এলাকাবাসী সন্তোষ্ট রয়েছেন। এতে সর্বোচ্চ ৩০ দিনের মাঝে বিচার কার্য শেষ করা হয়। এখানে ৩ ধরনের জরিমানা করা হয়ে থাকে। প্রথমত, কাউকে সমন পাঠানো হলে তার কোন জবাব না পাওয়া গেলে তাকে ৫০০ টাকার পরিবর্তে বর্তমানে ১ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। দ্বিতীয়ত, ইউনিয়ন অফিসে এসে বিচারিক কার্যক্রম নষ্ট করতে চাইলে বা তার পরিবেশ নষ্ট করলে তাতে ১ হাজার টাকা, মিথ্যা মামলা দায়ের করে কাউকে লাঞ্চিত বা হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করলে প্রমাণ সাপেক্ষে মামলাকারীকে ৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। গ্রাম আদালতের ভাষায় একে জরিমানা বলা হয়। এদিকে পূর্বে গ্রাম আদালতের বিচারে ক্ষতিপূরণের পরিমাণ ছিল ২৫ হাজার টাকা। এখন এর পরিমাণ বৃদ্ধিকরা হয়েছে ৭৫ হাজার টাকায়। গ্রাম আদালতের বিচারিক কার্যক্রমকে আরো গতিশীল ও সক্রিয় করার লক্ষেই সরকারিভাবে ক্ষতিপূরণের টাকার পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে।
গ্রামীণ এলাকায় ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৭৬ সালে প্রণীত হয় ‘গ্রাম আদালত অধ্যাদেশ, ১৯৭৬’। পরবর্তীতে কিছু সংশোধনের পর ২০০৬ সালে এই অধ্যাদেশটি আইনে রুপান্তর করা হয় ‘গ্রাম আদালত আইন’ নামে । এ আদালতে ২ ধরণের মামলার এখতিয়ার রয়েছে- ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রে গ্রাম আদালতের এখতিয়ারভূক্ত ধারাগুলো হলো দন্ডবিধির ১৬০, ৩২৩, ৩৩৪, ৩৪১, ৩৪২, ৩৫২, ৩৫৮, ৪২৬, ৫০৪, ৫০৬ (প্রথম অংশ), ৫০৮, ৫০৯ এবং ৫১০ ধারা। দেওয়ানি মামলার ক্ষেত্রে-চুক্তি বা দলিলমূলে প্রাপ্য টাকা আদায়, স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির দখল পুনরুদ্ধার এবং গবাদিপশুর অনধিকার প্রবেশের জন্য ক্ষতিপূরণ এবং কৃষিশ্রমিকের মজুরি সংক্রন্ত মামলাসমূহের বিচার গ্রাম আদালতে করা সম্ভব (দৈনিক সুনামগঞ্জ প্রতিদিন, ২১ নভেম্বর, ২০১৩)।
গ্রাম আদালত গঠনসূত্রে জানা যায়, সংশোধিত আইনের যথাযথ অনুসরণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগ নির্দেশনাসহ গেজেট কপি সকল ইউনিয়ন পরিষদে পৌঁছানো হয়। নির্দেশনাপত্রে গ্রাম আদালত (সংশোধন) আইন ২০১৩ উল্লেখ করে বলা হয়েছে, গ্রাম আদালতের এখতিয়ার ২৫ হাজার টাকার পরিবর্তে ৭৫ হাজার টাকায় বৃদ্ধি করে গ্রাম আদালতে বিচার ব্যবস্থা চালুর মাধ্যমে দরিদ্র মানুষের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত ও সহজ করতেই গঠন করা হয়েছে এ আদালত।
গ্রাম আদালতের এ সেবা পাওয়ার জন্য প্রথমে সাদা কাগজে ইউপি চেয়ারম্যান বরাবর লিখিত অভিযোগ করতে হয়। চেয়ারম্যান অভিযোগ অমূলক মনে করলে নাকচ করতে পারেন। তবে নাকচের কারণ উল্লেখ করে আবেদনপত্র আবেদনকারীকে ফেরত দিতে হবে। ১ জন চেয়ারম্যান এবং বাদী-বিবাদী উভয় পক্ষের মনোনীত দুজন মিলিয়ে মোট ৫ জন সদস্য নিয়ে গ্রাম আদালত গঠিত হয়। প্রত্যেক পক্ষ কর্তৃক মনোনীত ২ জন সদস্যের একজন সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য হবেন। ইউপি চেয়ারম্যানই গ্রাম আদালতের রায় দিবেন। যদি চেয়ারম্যান কারণবশত দায়িত্ব পালনে অক্ষম হন বা তার নিরপেক্ষতা সম্পর্কে আপত্তি ওঠে তাহলে পরিষদের অন্য কোন সদস্য আদালতের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করবেন।
২০১৩ সালের ৩ জুন নবীগঞ্জ উপজেলার পানি উমদা ইউনিয়নের মৃত জমির উদ্দিনের ছেলে সবুজ মিয়া বাদী হয়ে কাগাবলা ইউনিয়নের নিমারাই গ্রামের জয়নাল মিয়ার মেয়ে (স্ত্রী) পারুল বেগমের উপর একটি মামলা দায়ের করেন। কিন্তু বিবাদী পক্ষের কয়েকবার অনুপস্থিতির কারণে এক মাস পরে এর রায় দেন এ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুস সালাম ফারুক ও অন্যান্য ব্যক্তিবর্গ।
এ মামলার বাদি সবুজ মিয়া জানান, আমাদের এ সমস্য অনেক আগেই সমাধান হতো যদি আরো আগে আমরা দুই পক্ষ মুখোমুখি হয়ে যেতাম। তিনি কাগাবলা ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউনিয়নবাসীকে ধন্যবাদ জানান সুন্দর একটি সমাধনের জন্য।
নওমৌজা বিচারিক কমিটির সেক্রেটারি বুরুতলা এলাকার ইমন মোস্তফা জানান, আমাদের এলাকার অনেক সমস্যার সৃষ্টি হয়। ১০০টি সমস্যার মধ্যে ৮০টির সমাধানই আমরা ইউনিয়ন পর্যন্ত না গড়িয়ে নিজ এলাকায়ই সমাধান করে থাকি। মাঝে মাঝে আমাদেরকে থানায় ডেকে নিয়ে বিবদমান বিষয়টি সমাধানের জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়। আমাদের রায়ে কারো কোন হস্তক্ষেপ যদিও নেই তবে গ্রাম আদালতের বিচার ব্যবস্থাকে আরো শক্তিশালী ও স্বাধীন করার জন্য আমাদের দাবি থাকবে।
কাগাবলা ইউনিয়ন চেয়ারম্যান আব্দুস সালাম ফারুক বলেন, গ্রাম আদালতের কার্যক্রম শুরুর প্রথমদিকে আমাদের এ ইউনিয়নে অনেক মামলা হয়েছে। বর্তমানে অনেকটা কম। ২০১২ সালে ৩৮টি মামলা হয়েছে। ২০১৩ সালের প্রথম থেকে এ পর্যন্ত মাত্র ৩টি মামলাসহ মোট ৪১টি মামলার নিস্পত্তি করা হয়েছে। তবে পূর্বের তুলনায় গ্রাম আদলতের সফলতা বর্তমানে অনেক। আগে গ্রাম আদালতের ক্ষতিপূরণ ২৫ হাজার থেকে তিনগুণ বাড়িয়ে ৭৫ হাজার টাকা করা হয়েছে। এদিকে আমার ইউনিয়নে বিভিন্ন বিচারিক কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য আমি আমার নিজস্ব উদ্যোগে এজলাস তৈরি করেছি। এর অর্থ আমি আমার নিজস্ব তহবীলসহ বিভিন্ন খাত দিয়েছি শুধু আমার এলাকার জনগণের জন্য। যাতে তারা সুষ্ঠুভাবে একটা বিচারিক পরিবেশে ন্যায় বিচার পায়।
সদর উপজেলা অফিসার আশরাফুল আলম খান বলেন, স্থানীয় মেম্বার চেয়ারম্যানরাই আলোচনা সাপেক্ষে গ্রাম আদালতকে আরো শক্তিশালী করতে পারেন। তবে গ্রাম আদালতের বিচারে আসামীকে জেল দিতে পারেন না শুধু জরিমানা করার এখতিয়ার রয়েছে। মামলা যদি কারাদণ্ড বা স্বশ্রমকারাদণ্ড উপযোগী হয় তাহলে গ্রাম আদালত থেকে সংশ্লিষ্ট উচ্চ আদালতে সে মামলাটি প্রেরণের ব্যবস্থা রয়েছে।