বিজয়ের ৪৩ বছর পরও সংরক্ষিত হয়নি কুলাউড়ার বধ্যভূমিগুলো
প্রকাশিত হয়েছে : ১৪ ডিসেম্বর ২০১৪, ১১:৪২ পূর্বাহ্ণ
নাজমুল ইসলাম ::
মহান মুক্তিযুদ্ধে মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার রয়েছে গৌরবময় ভূমিকা। ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর যখন সমগ্র দেশে বিজয় উৎসব ধ্বনিত হয় তার পূর্বে ৬ই ডিসেম্বর এই উপজেলা সম্পূর্ণরুপে শত্রুমুক্ত হয়।
বিজয়ের ৪৩ বছর পরও উপজেলার বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণের কোন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। অরক্ষিত ও অবহেলা অবস্থায় পড়ে রয়েছে বধ্যভূমিগুলো। শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি রক্ষার্তে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও উপজেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় কুলাউড়া ডাক বাংলো মাঠে নির্মিত হয়েছে স্বাধীনতার স্মৃতিস্তম্ভ।
১৯৭১ সালের ৭মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণের পর সারাদেশ যখন মুক্তিযুদ্ধের জন্য সংগঠিত হতে থাকে ঠিক ঐ সময় পাকিস্তানী শাসকদের শোষণ থেকে মুক্তি সংগ্রামে কুলাউড়ার দেশ প্রেমিক মুক্তিকামী সন্তানরা হাতে তুলে নিয়েছিল অস্ত্র। এই উপজেলায় ব্যারিস্টার আব্দুল মুক্তাকিম চৌধুরী, নবাব আলী সবদর খান রাজা, নবাব আলী সরওয়ার খান চুন্ন, আব্দুল লতিফ খান, মো. আব্দুল জব্বার, লুৎফুর রহমান চৌধুরী হেলাল, মো. আব্দুর রহিম, মুকিম উদ্দিন আহমদ, মো. খালেদুর রব, মো. আব্দুল মতিন, মো. মমরুজ বখ্শ মটু, আলাউদ্দিন আহমদ, আছকির আলী, হাবীব উদ্দিন, আতাউর রহমান, মছাদুর রহমান, গিয়াস উদ্দিন আহমদ প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধাদের সু-সংগঠিত করে ভারতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন।
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, এই উপজেলায় সর্বমোট ৫৮২জন মুক্তিযোদ্ধা সংক্রিয় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এই রক্তক্ষয়ী সংর্ঘষে কুলাউড়া উপজেলার মুক্তিযোদ্ধাসহ প্রায় ৪৫০জন শহীদ হন।
পাক বাহিনীর প্রবেশ ও নির্মম গণহত্যা
কুলাউড়া শহরে পাক বাহিনীর প্রবেশ পথে ৭১সালের ৭ই মে কাপুয়া ব্রিজের কাছে গতিরোধ করেন অকুতোভয় বীর সৈনিক মোজাহিদ আলী সহ জয়চন্ডী ইউনিয়নের আছকির আলী ও হাবীব উদ্দিন। শুরু হয় সংঘর্ষ এক পর্যায়ে আছকির ও হাবীব গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন। এই দুইজনই হলেন কুলাউড়া উপজেলার প্রথম শহীদ মুক্তিযোদ্ধা। তারপর পাক সেনারা একে একে হত্যা করে কটু মিয়া, আব্দুল কদ্দুছ, ছলিমউল্লাহ সহ স্থানীয় ৫জন গ্রামবাসীকে। শহরের চৌমুহনায় এসে হত্যা করে ডেঙ্গী পাগল নামে একজনকে। এরপর বিকালে স্থানীয় স্বাধীনতা বিরোধীদের সহায়তায় বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্টানে হত্যা ও লুটপাট চালায়। শহরে প্রবেশ করে হত্যা করে ছাত্রলীগ থানা শাখার সভাপতি নুরুল ইসলাম ভূইয়া ও তার সহকর্মী সহ-বোডিং ম্যানেজার আব্দুর রহমানকে।
এদেশের দোসরদের সহায়তায় পাকসেনারা নিধনযজ্ঞ অব্যাহত রাখে। পরে কুলাউড়া উপজেলার জয়চন্ডী ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম থেকে রাজাকার সহযোগে পাক সেনারা ২২জন গ্রামবাসীকে ধরে এনে হত্যা করে। পরবর্তীতে ২৪শে মে ও ১৪জুন মীরবক্সপুর গ্রামে গিয়ে বেশ কয়েকজন গ্রামবাসীকে হত্যাসহ একই গ্রামে গিয়ে নিধন যজ্ঞ চালায়।
পাক বাহিনীর ক্যাম্প তৈরি
পাক সেনারা থানা হাসপাতাল, রেলওয়ে স্টেশন, কুলাউড়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়সহ বিভিন্ন স্থানে স্থাপন করে ক্যাম্প। এসব ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন পাকিস্তানী মেজর মোগল ও ক্যাপ্টেন দাউদ। পাকিস্তানী সৈন্যের আগমনে স্বার্থানেষী ও স্বাধীনতা বিরোধীরা শান্তি কমিটি, আলবদল, রাজাকার, আল-সামস, কমিটি গঠন করে বাঙালী নিধন যজ্ঞে মেতে উঠে।
যেসব স্থানে রয়েছে বধ্যভূমি
স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় পাক সেনারা সমগ্র উপজেলাব্যাপী নির্মম হত্যা, গণহত্যা, লুন্ঠন ও ধর্ষণ চালায়। উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজনকে ধরে এনে নির্মম ভাবে হত্যা করে শহরের চাতলগাঁও কবরস্থান, কুলাউড়া নবীনচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ের নিকটবর্তী রেললাইন এলাকা, রেলওয়ে স্টেশনের দক্ষিণ এলাকা, বিছরাকান্দি ও উত্তর জয়পাশা এলাকা ছাড়াও পৃথিমপাশা আলী আমজদ উচ্চ বিদ্যালয়ের সম্মুখ্স্থান পদ্মদীঘির পার, সীমান্তবর্তী এলাকা শরীফপুর ইউনিয়নের নৌ-মৌজা নামক স্থানে গণকবর দেয়। এসব স্থানগুলো আজও সংরক্ষণ করা হয়নি অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে রয়েছে এসব বধ্যভূমি।
যে ভাবে হানাদারমুক্ত হয় কুলাউড়া
নভেম্বর শেষ প্রান্তথেকে ডিসেম্বরের প্রথম দিকে ভারত ও বাংলাদেশ চুক্তি হওয়াতে যৌথ মিত্র বাহিনী মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লে যুদ্ধের গতি তীব্রভাবে বেড়ে যায়। থানার সবচেয়ে বড় ও সর্বশেষ অপারেশন হয় গাজীপুর চা-বাগানে উক্ত চা-বাগানে যুদ্ধের সময় পাকহানাদার বাহিনীর একটি শক্তিশালী ঘাটি ছিল। নেতৃত্বে ছিলেন মেজর আব্দুল ওয়াহিদ মোগল। প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এক ব্যাটেলিয়ান সৈন্য বাগানে অবস্থান করছিল। অপরদিকে গাজীপুরের বিপরীতে চোঙ্গাবাড়ী নামক স্থানে মুক্তি বাহিনীর ক্যাম্প ছিল। নভেম্বরের শেষদিকে গাজীপুর মুক্ত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় এতে নেতৃত্ব দেন এম এ মুমিত আসুক, প্রথমে জুড়ী উপজেলার সাগরনাল চা-বাগানে অবস্থান নেন তারা। উক্ত স্থানে মিলিত হন ধর্মনগর থেকে আগত কর্নেল হর দয়াল সিংহ তার নেতৃত্বে ভারতীয় সেনা বাহিনী ৬৭ রাজপুত রেজিমেন্টের বিরাট একটি দল বাগানে অবস্থান নেয়। ৩০ নভেম্বর কাকুরা চা-বাগান অবস্থানকারী ৭৫জন রাজাকার ও ৫জন পাকিস্তানী সৈন্য ধরা পড়ে। ১লা ডিসেম্বর কাকুরা চা-বাগান থেকে গাজীপুর চা বাগান এলাকার দিকে মিত্র বাহিনী অগ্রসর হলে পাক সেনাদের সাথে পাল্টা গুলি বর্ষণ চলতে থাকে। ২রা ডিসেম্বর রাতে যুদ্ধ হয়। ৩রা ডিসেম্বর ৪/৫ গোর্খা রেজিমেন্ট কর্নেল হারকিলের নেতৃত্বে একটি দল সাহায্যে এগিয়ে আসে। পেছনে ৯৯মাইন্টেল ব্রিগেডের আর্টিলারি সহায়তায় রাতে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয় তবুও গাজীপুর চা-বাগান এলাকা দখল মুক্ত সম্ভব না হওয়াতে ৪ঠা ডিসেম্বর যুদ্ধের পরিকল্পনা বদলে ফেলা হয়। পিছন দিক থেকে আক্রমণ করার পরিকল্পনা নেন হারকিলর। সে অনুযায়ী সদ্য প্রয়াত জুড়ী উপজেলা চেয়ারম্যান এম এ মোমিত আসুক ও মোহন লাল সোম পিছনে আসার দায়িত্ব গ্রহণ করে রাত ১২টায় সম্মিলিত বাহিনী সবদিকে পাকিস্তানী বাহিনীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। শেষ দিকে লষ্করপুর গ্রামে অবস্থানরত মুক্তিবাহিনী এ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। উক্ত যুদ্ধে প্রায় ২৫০জন পাক সেনা প্রাণ হারায়। ৫ই ডিসেম্বর গাজীপুর চা-বাগান এলাকা শত্রু মুক্ত হয়। ঐ দিনই সন্ধ্যার দিকে সম্মিলিত বাহিনী কুলাউড়ায় পৌঁছে, ঐ রাতেই সব পাকিস্তানী সৈন্য ব্রাহ্মণবাজারের দিকে সড়ক পথে কুলাউড়া ত্যাগ করে। এভাবেই ৬ই ডিসেম্বর কুলাউড়া শত্রুমুক্ত হয়। উপজেলা শহরের লাল সবুজ স্বাধীনতার পতাকা আকাশে উড়তে থাকে।
অরক্ষিত বধ্যভূমি সংরক্ষণের ব্যাপারে প্রয়াত বীর মুক্তিযুদ্বা, সাবেক সংসদ সদস্য মোহাম্মদ আব্দুল জব্বারের পুত্র ও কুলাউড়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আসম কামরুল ইসলাম জানান, উপজেলা প্রশাসন থেকে এ বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কুলাউড়া উপজেলায় যেগুলো বধ্যভূমি রয়েছে তার প্রাথমিকভাবে আমরা চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের পরিকল্পনা রয়েছে।
মৌলভীবাজার-২ আসনের সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আব্দুল মতিন বলেন, বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণ খুবই জরুরি, বধ্যভূমি রক্ষা করতে হবে। স্বাধীনতা সংগ্রামে শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে আমরা শীঘ্রই ব্যবস্থা গ্রহণ করব।