জাহাজ ডুবিতে সুন্দরবনে ৭০ কিমি এলাকা জুড়ে তেলের স্তর
প্রকাশিত হয়েছে : ১১ ডিসেম্বর ২০১৪, ৭:১৩ পূর্বাহ্ণ
পূর্বদিক ডেস্ক ::
গত ৯ ডিসেম্বর মঙ্গলবার ভোরে ফার্নেস তেলবাহী ওটি সাউদার্ন স্টার-৭ অপর একটি মালবাহী জাহাজের ধাক্কায় ডুবে যায়। এ ঘটনায় গতকাল বুধবার সকালে জাহাজ দুটির মালিকের বিরুদ্ধে ১০০ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ মামলা করেছে বন বিভাগ। বন বিভাগের চাঁদপাই পূর্বাঞ্চলীয় রেঞ্জের কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ মংলা থানায় মামলাটি করেন। তবে গতকাল পর্যন্ত জাহাজটি উদ্ধার কিংবা দূষণ নিয়ন্ত্রণে তেল অপসারণের তৎপরতা শুরু হয়নি। দূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে গতকাল দুপুরে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে রওনা হয়েছে কান্ডারি-১০ নামের একটি জাহাজ। আজ বৃহস্পতিবার সকালে দুর্ঘটনাস্থলে জাহাজটি পৌঁছার কথা রয়েছে।
সাড়ে তিন লাখ লিটারের বেশি তেল নিয়ে ডুবে যাওয়া জাহাজটি থেকে ছড়িয়ে পড়া ফার্নেস তেল গতকাল বিকেল পর্যন্ত ঘটনাস্থলের দুই পাশে প্রায় ৭০ কিলোমিটার এলাকা ছড়িয়েছে বলে জানিয়েছে বন বিভাগ। এ অবস্থায় আবারও বিপর্যয়ের আশঙ্কায় বন কর্মকর্তাসহ প্রাণ-প্রতিবেশ বিশেষজ্ঞরা যখন সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে এ নৌরুটটি বন্ধের দাবি জানাচ্ছেন, তখনো সেখানে অবাধে চলছিল বিভিন্ন বাণিজ্যিক নৌযান।
জাহাজডুবির ঘটনায় তিন সদস্যের কমিটি গঠন করেছে সরকার। এ ছাড়া বন বিভাগ ঘটনা তদন্তের জন্য তিন সদস্যের আরেকটি কমিটি গঠন করেছে। চাঁদপাই রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক বেলায়েত হোসেনকে কমিটির প্রধান করা হয়েছে। কমিটিকে দুর্ঘটনার কারণ এবং জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশের ওপর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয় করে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
এদিকে বিকেলে ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে পরিবেশ ও বন উপমন্ত্রী আবদুল্লাহ আল ইসলাম এ দুর্ঘটনার জন্য সরাসরি দায়ী করেন বিআইডব্লিউটিএকে। তিনি বলেন, একাধিকবার নিষেধ করার পরও বিআইডব্লিউটিএ এই রুটে নৌ চলাচল অব্যাহত রাখায় এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেছে। তাঁর মতে, এ দুর্ঘটনা সুন্দরবনের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। তাই সুন্দরবনকে বাঁচাতে অবিলম্বে এ নৌ-রুট বন্ধে জোরালো উদ্যোগ নেওয়া হবে। এ সময় নৌ-রুটটি বন্ধের ব্যাপারে প্রধান বন সংরক্ষক ইউনুস আলীও মন্ত্রীর সঙ্গে একমত পোষণ করেন।
তেল ছড়িয়ে পড়া এলাকাটি সরকার ঘোষিত ডলফিনের অভয়ারণ্য। এ ছাড়া সুন্দরবন ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্য এবং জাতিসংঘ ঘোষিত বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ জলাভূমি। জাতিসংঘের ওই দুই সংস্থার নিয়ম অনুযায়ী সুন্দরবনের ভেতর এ এলাকা দিয়ে নৌযান চলাচল নিষিদ্ধ। বন বিভাগ থেকে একাধিকবার এবং জাতিসংঘের জলাভূমিবিষয়ক সংস্থা রামসার কর্তৃপক্ষ, বিজ্ঞান-শিক্ষা ও ঐতিহ্যবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো থেকে নৌপথটি নিয়ে আপত্তি তুলে তা বন্ধের আহ্বান জানানো হলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর পলিন টেমেসিস গতকাল এক লিখিত বিবৃতিতে বলেন, সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে সব ধরনের বাণিজ্যিক নৌযান চলাচল বন্ধের জন্য সরকারের কাছে আবারও আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ। এ ধরনের বনের ভেতর দিয়ে নৌযান চললে তা দীর্ঘ মেয়াদে জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি করে।
পলিন টেমেসিস আরও বলেন, সুন্দরবনের যে এলাকাটিতে তেল ছড়িয়ে পড়েছে, সেখানে বিশ্বের বিপদাপন্ন দুই প্রজাতি গাঙ্গেয় ও ইরাবতি ডলফিনের বিচরণ। এ ছাড়া অনেক সমৃদ্ধ জলজ প্রাণী রয়েছে সেখানে। সুন্দরবন ইউনেসকো ঘোষিত একটি বিশ্ব ঐতিহ্য। তাই সুন্দরবনের ভেতরে এই দুর্ঘটনায় জাতিসংঘ উদ্বিগ্ন।
তদন্ত কমিটি গঠন
জাহাজডুবির ঘটনায় সরকারের তিন সদস্যের কমিটিকে ১৫ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান সচিবালয়ে সাংবাদিকদের এ কথা জানান।
সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের নটিক্যাল সার্ভেয়ার অ্যান্ড এক্সামিনার ক্যাপ্টেন গিয়াসউদ্দিন আহমেদকে আহ্বায়ক করে গঠিত কমিটির অন্য দুজন সদস্য হলেন সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট গোলাম মাইনুদ্দিন হাসান এবং সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের খুলনার অভ্যন্তরীণ জাহাজ পরিদর্শনালয়ের পরিদর্শক মোহাম্মদ আবু জাফর মিয়া।
কমিটি দুর্ঘটনার কারণ নির্ণয়, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয়, দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শনাক্ত করার পাশাপাশি ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা কীভাবে রোধ করা যায় তার সুপারিশ করবে।
শ্যালা নদীতে নৌযান চলাচল বন্ধ রাখার নির্দেশ
বাগেরহাটের মংলা থানার অন্তর্গত সুন্দরবনের শ্যালা নদীর মৃগামারী এলাকায় গতকাল তেলবাহী ট্যাংকার ‘ওটি সাউদার্ন স্টার-৭’ডুবির কারণে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত ওই রুটে সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে গতকাল অনুষ্ঠিত এক জরুরি আন্তমন্ত্রণালয় সভায় এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন। গতকাল রাতে এক তথ্য বিবরণীতে এ খবর জানানো হয়।
সভায় আরও জানানো হয়, ধাক্কা প্রদানকারী অপর তেলবাহী জাহাজ ‘এম টি টোটাল’কে গতকাল ভোলায় আটক করা হয়েছে এবং সেটির সার্ভে ও রেজিস্ট্রেশন সনদ স্থগিত করা হয়েছে। সার্বিক প্রস্তুতি তদারকির জন্য নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. রফিকুল ইসলামকে সমন্বয়কারীর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।