রাজনগরের পাঁচগাঁও বদ্ধভূমি ও শহীদের পরিজনরা আজও অবহেলিত
প্রকাশিত হয়েছে : ১০ ডিসেম্বর ২০১৪, ৬:৫৮ পূর্বাহ্ণ
আব্দুর রহমান সোহেল ::
পাকিস্তানী হায়েনারা দালালদের সহায়তায় ৫৯ জন বাঙালীকে হত্যা করে লাশ ফেলে দিয়েছিল মৌলভিবাজারের রাজনগর উপজেলার সরকার বাজার দীঘির পানিতে। পানি থেকে লাশ তুলে দীঘির পাড়েই তাদের দেয়া হয় গণকবর। ১৯৭১ সালের ৭ই মে সংঘটিত এ গণহত্যার গণকবরকে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের দাবী ৪৩ বছরের। কিন্তু এখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের উদ্যোগ আজও নেয়া হয়নি। তেমনি নিহতদের স্মরণে নেয়া হয় না কোন উদ্যোগ।
এদিকে গত ২ নভেম্বর মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় ডিও.৪৮.০০.০০০০.১০০.০১.০০১.২০১৪.৫৪৬ নং স্মারকে একটি পত্র পাঠায় স্থানীয় প্রশাসনের কাছে। এতে সংশ্লিষ্ট এলাকার মুক্তিযুদ্ধা, মুক্তিযোদ্ধাদের নামে সড়কের নামকরণ, বদ্ধভুমির উন্নয়নসহ বিভিন্ন বিষয় উল্লেখ করা হয়। তবে এ বিষয়ে মন্ত্রণালয় থেকে এখনো কোন কার্যকর উদ্যোগ নেয়া হয়নি।
ঐতিহাসিক এ গণহত্যার সময় পাক সেনাদের গুলির সামনে থেকে বেঁচে যান সুবোধ মালাকার (৮০)। তিনি বলেন, যখনই এ গণহত্যার কথা মনে হয় চোখের জলে ভেসে যায়। ১৯৭১ সালের ঔ দিনে বাংলা তারিখ ছিল ২৩ শে বৈশাখ, শুক্রবার। যুদ্ধের সময় আমার বয়স ৩৮-৪০ হবে। ফজরের নামাজের আগেই পাক সেনাদের ৫০জনের একটি দল দুটি গাড়িতে করে স্থানীয় দুই রাজাকারকে নিয়ে গ্রামের সরকারবাজার দীঘির পাড়ে থামে। এক রাজারকার কিছু সৈন্য নিয়ে আমাদের বাড়িতে আসে। বাড়ির ৯ জন পুরুষ সদস্যকে বের করে নিয়ে যায় দীঘির পাড়ে মিটিং করবে বলে। সবাইকে সোজা লাইনে দাঁড়ও করাচ্ছে। তখনই মনের অজান্তে মৃত্যুর ছবি ভেসে আসে। এভাবে গ্রাম থেকে প্রচুর লোকজনকে ধরে আনে। একজনের হাত আর অন্যজনের পায়ের সাঙ্গে বেঁধে রাখে। জামিনি মালাকারের সাঙ্গে আমাকে বেঁধে গুলি করে করে ফেলে দেয় দীঘির পানিতে। একটি গুলি আমার কান ফোঁড়ে চলে যায়। আমি দীঘির পানিতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকি। জ্ঞান ফিরলে দীঘির লম্বা কচুরিপানার নিচে নাক ভাসিয়ে কয়েকজন প্রাণ বাঁচাতে সক্ষম হই। কিন্তু জামিনি মালাকার পাক সেন্যদের গুলিতে মারা যান। হায়েনারা চলে যাওয়ার পর লোকজন আহতদের তুলে আনে। এভাবে পাষণ্ডরা একে একে পানির মধ্যে গুলি করে হত্যা করে ৫৯ জন নিরীহ অসহায় নিরস্ত্র লোকজনকে। তন্মধ্যে চরিত্র শব্দকর, সাধু শব্দকর ও কাটি শব্দ কর প্রমুখ। পরে কয়েকজনকে ধরে নিয়ে মৌলভীবাজার চাঁদনীঘাট ব্রিজের উপর গুলি করে লাশ মনু নদীতে ফেলে দেয়।
প্রবাসী মালাকার (৬৫) স্বামী নারায়ন চন্দ মালাকার ও তার দুই দেবর নঙ্গু মালাকার ও বিধু মালাকার ওই গণহত্যায় শহীদ হন। তিনি বলেন, পাক বাহিনী তার পিঠে বন্দুকের বাট দিয়ে আঘত করে। এতে তার পিঠের হাড় ভেঙে যায়। এখনো তিনি আজও সেরে ওঠেননি। পাননি কোন সাহায্য পাননি।
১৯৭১ সালের ঐদিনে স্বামী হারানো পরিবালা (৭০) বলেন, স্বামী হারানোর পর বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয় সৈন্যরা। আগুনে পুড়ে তিনটি গরু মারা যায়। স্থানীয় কয়েকজন রাজাকার আমাদের ক্ষতি হবে না বলে মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে ১০০ মন ধান লুটে নেয়। আমরা প্রাণে বেঁচে গিয়েও শান্তিতে থাকতে পারিনি।
রাজনগর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কামান্ডার সজল কুমার চক্রবর্তী বলেন, এখানে একটি স্মৃতি সৌধ নির্মাণের জন্য আমরা অনেকবার আবেদন করেছি। কিন্তু আজো এ ব্যাপারে তেমন কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। আমরা কয়েকবার মন্ত্রণালয়ে এব্যাপারে আবেদনও করেছি। ওই গণহত্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তার জন্যও উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে অকেবারই বলেছি কিন্তু কোন কাজ হয়নি।