তাজিয়াকে ঘিরে দিল্লিতে হিন্দু-মুসলিম উত্তেজনা
প্রকাশিত হয়েছে : ৫ নভেম্বর ২০১৪, ৫:৫৪ পূর্বাহ্ণ
পূর্বদিক ডেস্ক ::
ভারতের রাজধানী দিল্লিতে গতকাল সঙ্গলবার মহররমের তাজিয়াকে ঘিরে আজ শহরের নানা জায়গাতেই তীব্র সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছিল– যদিও শেষ পর্যন্ত বিশেষ কোনও অপ্রীতিকর ঘটনার খবর নেই। উত্তর দিল্লির বাওয়ানা এলাকায় অবশ্য জাঠ নেতাদের হুকুম মেনে মহাররমের তাজিয়া শুধু মুসলিম-অধ্যুষিত এলাকাতেই সীমাবদ্ধ ছিল।
আবার এর পাশাপাশি কিছুদিন আগে পূর্ব দিল্লির যে ত্রিলোকপুরী এলাকায় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা হয়েছিল সেখানে বেশ কিছু হিন্দুও আজ মহররমের মিছিলে সামিল হয়েছিলেন। বাওয়ানা ও ত্রিলোকপুরী-সহ শহরের বিভিন্ন এলাকাতেই মোতায়েন করা হয়েছিল হাজার হাজার পুলিশ ও দাঙ্গা-দমন বাহিনী।
আতঙ্ক আর উত্তেজনার এই পটভূমিতে দিল্লির মহররম
পূর্ব দিল্লির ত্রিলোকপুরীর ১৫ নম্বর ব্লক। মাত্র দিন দশ-বারো আগেই দীপাবলীর ঠিক পর পর হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় রক্তাক্ত হয়ে উঠেছিল শহরের এই নিম্নমধ্যবিত্ত এলাকা, গোটা রাস্তা জুড়ে ছড়িয়ে ছিল ইট-পাটকেল। আর গতকাল মহাররমের তাজিয়া গেল ঠিক সেই পথ ধরেই, যদিও এই ধর্মীয় মিছিলে যে ছুরি বা অস্ত্র বহন করার রেওয়াজ আছে পুলিশ এবারে তার অনুমতি দেয়নি। তবে তার পরেও ত্রিলোকপুরীতে এবারের মহাররম নিয়ে কোনও অভিযোগ নেই শেখ রেহমানের। তিনি বলেন, আমরা গরিব মানুষ, মিলেমিশে ভালবেসে থাকতে চাই। আমাদের মহল্লায় জানেন তো যত মুসলিম, প্রায় ততই হিন্দু – একে অন্যের উৎসবে সবাই সানন্দে অংশ নেয়। কিন্তু দেওয়ালিতে যা ঘটেছিল, তারপর সত্যিই ভাবিনি শেষ পর্যন্ত এভাবে মহাররমের তাজিয়া বের হতে পারবে।
বাওয়ানা: মহররমের আগের সন্ধ্যায় পুলিশি টহল
তাজিয়া যে নির্বিঘ্নে বেরোতে পেরেছে, তার একটা বড় কারণ গোটা এলাকাটা মুড়ে দেওয়া হয়েছে নিশ্ছিদ্র পুলিশি পাহারায়। যে দিকে তাকাবেন, সে দিকেই পুলিশ। (মাইকিং) সেই সঙ্গেই ত্রিলোকপুরীর প্রায় শখানেক স্বেচ্ছাসেবী হিন্দু যুবকের ভূমিকাও ছিল প্রশংসনীয়, যারা এলাকায় শান্তি ফেরাতে নিজেরাই মহাররমের মিছিলে যোগ দিয়েছেন।
এদেরই একজন সন্দীপ ভূষণ বলছিলেন, ৩১ অক্টোবর আমাদের জাগরণ অনুষ্ঠানেও কিন্তু মুসলিম সম্প্রদায়ের অনেকে সামিল হয়েছিলেন, তারপর আমরাও প্রায় একশোজন হিন্দু যুবক মিলে সিদ্ধান্ত নিই মুহাররমের মিছিলে যাব। একমাত্র এভাবেই কিন্তু এলাকায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ফেরানো সম্ভব, সৌভ্রাতৃত্ব নিয়ে আসা সম্ভব।
শহরের সর্বত্র একই ধরনের সম্প্রীতির ছবি ছিল তা অবশ্য বলা যাচ্ছে না। ত্রিলোকপুরী থেকে ৫০ কিলোমিটারেরও বেশি দূরে বাওয়ানাতে মহাররমের তাজিয়া যেমন জাঠ হিন্দুদের এলাকায় ঘেঁষতে পারেইনি। বাওয়ানা থেকে মেহফুজ আলম জানান, উৎসবের দিনে কোনও গণ্ডগোল চাননি তারা, তাই জাঠদের দাবি মেনে নিয়েছেন। কেউ কেউ যখন আপত্তি তুলছে তখন আমরা তাজিয়ার পুরনো রুটে আর নিজেরাই যেতে চাইনি – আমরা নিজেদের এলাকাতেই মিছিল সীমিত রেখেছি, নিজেদের মধ্যেই উৎসব পালন করছি। সব শান্তিতেই মিটছে, তবে কেউ যখন আপনাকে ঠিকমতো আপনার উৎসবও পালন করতে দেয়না, একটা বিদ্বেষ যে তৈরি হয় তা তো অস্বীকার করতে পারি না!
দিল্লির নানা প্রান্তে এই বিদ্বেষের আগুন ধিকিধিকি জ্বলতে শুরু করেছে বকরি ঈদের সময় থেকেই, যখন গরুর কোরবানিতে মুসলিমদের নানা জায়গায় বাধা দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ। ত্রিলোকপুরীর মহম্মদ ইরশাদ বলছিলেন, তাদের ঘাড়ে প্রকাশ্যে গো-হত্যা, যা দিল্লিতে বেআইনি, তার দায় চাপাতে চেয়েছিল একদল হিন্দু যুবক। তিনি বলছিলেন, বকরি ঈদের সময় প্রায় শ-দেড়শো যুবক এসে আমাদের মসজিদ তল্লাসি করে যায় তাতে কোনও গরু আছে কি না। রাতে এসে আমাদের বস্তিতে রেখে যায় চার-পাঁচটা গরু, আমরা রাত আড়াইটের সময় সেগুলো গিয়ে দিয়ে আসি পুলিশের জিম্মায় – যারা ওগুলো গোশালায় পাঠিয়ে দেয়। এই যে আমাদের ঘাড়ে মিথ্যা দোষ চাপানোর চেষ্টা, ঈদের সময় থেকেই শুরু হয়েছে এটা!
ত্রিলোকপুরী বা বাওয়ানার মুসলিমদের অনেকেরই সন্দেহ, গত বেশ কিছুদিন ধরেই একটা পরিকল্পনামাফিক হিন্দু-মুসলিম সমাজের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করার চেষ্টা চলছে, উসকানি আসছে অবিরত। এই চাপা আতঙ্কের মধ্যে মুহাররম ভালয় ভালয় মিটে গেলেও আগামী দিনের দিকে তাকিয়ে তারা কিন্তু নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না কিছুতেই!