বিশ্ববাজারে জ্বালানী তেলের দাম কমলেও সমন্বয় হচ্ছে না দেশে
প্রকাশিত হয়েছে : ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৪, ৮:১৫ পূর্বাহ্ণ
অর্থ-বাণিজ্য ডেস্ক ::
সর্বশেষ গত বছরের জানুয়ারিতে দেশের বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়। তখন সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, বিশ্ববাজারে দাম কমলে স্থানীয় পর্যায়েও দাম সমন্বয় করা হবে। এর পর দেড় বছর বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম মোটামুটি স্থিতিশীল ছিল। তবে চলতি বছর জুনের পর কমতে শুরু করে জ্বালানির দাম। এরই মধ্যে তা জুনের তুলনায় ১৭ শতাংশ কমেছে। কিন্তু স্থানীয় বাজারে দাম কমানোর কোনো উদ্যোগও নেই সরকারের।
জানা যায়, গত জুনে বিশ্ববাজারে প্রতি ব্যারেল জ্বালানি তেলের দাম ছিল ১০৫ মার্কিন ডলার। গতকাল পর্যন্ত তা কমে দাঁড়িয়েছে ৯৬ ডলার। এক্ষেত্রে প্রতিবেশী দেশ ভারতে নিয়মিত দাম সমন্বয়ের ব্যবস্থা থাকলেও বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত তা করা সম্ভব হয়নি। শুধু তা-ই নয়, এখানে নির্বাহী আদেশে জ্বালানি মন্ত্রণালয় থেকে দাম ঘোষণা করা হয়। যদিও এ দাম নির্ধারণের কথা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) চেয়ারম্যান মো. ইউনূসুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, জ্বালানি তেলের ক্ষেত্রে গত কয়েক বছরে সামগ্রিক লোকসান কমেছে। বিশ্ববাজারে দাম স্থিতিশীল থাকলে চলতি বছর এ লোকসান আরো কমবে। তবে ডিজেলের লোকসান কোনোভাবেই সমন্বয় করা সম্ভব হচ্ছে না। তাই আপাতত দাম কমানোর কোনো যৌক্তিকতা নেই।
তবে ডিজেলের ওপর উচ্চ শুল্কহারের কারণেই জ্বালানি তেলে লোকসান দিচ্ছে বিপিসি। আবার দেশের আমদানি করা জ্বালানির ৬৫ শতাংশ ডিজেল হওয়ার কারণে বড় দেখাচ্ছে বিপিসির লোকসান। যদিও সরকারি কোষাগারে লোকসানের সমপরিমাণ অর্থ শুল্ক হিসেবে জমা হচ্ছে।
সূত্র জানায়, অন্যান্য ব্যয়সহ বর্তমানে বিশ্ববাজার থেকে প্রতি লিটার ডিজেল কিনতে বিপিসির মোট ব্যয় হয় ৬৬ টাকা। দেশের বাজারে এটি বিক্রি হয় ৬৮ টাকায়। কিন্তু প্রতি লিটারে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে ৭-৮ টাকা শুল্ক পরিশোধ করতে হয়। আর তাতেই ডিজেলে লোকসানে পড়ে বিপিসি। অন্যদিকে প্রতি লিটার ফার্নেস অয়েল কিনতে বিপিসির ব্যয় হয় ৫০ টাকা। তা বিক্রি থেকে আয় হয় ৬০ টাকা। এ হিসাবে আমদানি করা ফার্নেস থেকে গত অর্থবছর ২০০ কোটি টাকা মুনাফা করে বিপিসি।
বর্তমানে প্রতি লিটার ফার্নেস বিক্রি করে ২ টাকা মুনাফা করে প্রতিষ্ঠানটি। এছাড়া পেট্রল, অকটেন ও জেট ফুয়েল বিক্রি করে অনেক আগে থেকেই মুনাফা করছে রাষ্ট্রীয় এ প্রতিষ্ঠান।
বিপিসি সূত্রে জানা যায়, দেশে আমদানি করা জ্বালানি তেলের ৬৫ শতাংশই ডিজেল। বছরে আমদানি করা ৫৭ লাখ টন জ্বালানি তেলের মধ্যে ৩৩ লাখ টনই ডিজেল। ডিজেলের পর সবচেয়ে বেশি আমদানি হয় ফার্নেস অয়েল। এর পরিমাণ ১০-১২ লাখ টন।
জানা গেছে, তেলের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন তেল সরবরাহকারী কোম্পানির সঙ্গে অগ্রিম চুক্তি করলেও তাতে দাম নির্ধারণ করা হয় না, শুধু প্রিমিয়াম (উত্স থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত পরিবহন ব্যয়, ইন্স্যুরেন্স ইত্যাদি) ঠিক করা হয়। আমদানিকরা তেলের দাম নির্ধারণ প্রক্রিয়া সম্পর্কে বিপিসির এক কর্মকর্তা বলেন, তেল জাহাজে তোলার সময় আন্তর্জাতিক বাজারের দাম ও প্রিমিয়াম মিলিয়ে জ্বালানি তেলের মূল্য নির্ধারণ করা হয়। এক্ষেত্রে জাহাজীকরণের আগের দুইদিন ও পরের দুইদিনসহ মোট পাঁচদিনের আন্তর্জাতিক বাজারমূল্যের গড়ের সঙ্গে প্রিমিয়াম যোগ করে দাম নির্ধারণ করা হয়। সরকারের ক্রয় কমিটির অনুমোদনসাপেক্ষে বর্তমানে মালয়েশিয়া, মিসর, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, কুয়েত, ভিয়েতনাম, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও চীনের বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান থেকে জ্বালানি তেল আমদানি করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিকভাবে নির্ধারিত দামেই এসব দেশে তেল বিক্রি করা হয়। প্রসঙ্গত, কেরোসিন ৬৮, পেট্রল ৯৬ ও অকটেন ৯৯ টাকায় বিক্রি হচ্ছে বর্তমানে।
বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমলেও মূলত লোকসানের কারণে স্থানীয় বাজারে দাম সমন্বয় করা হচ্ছে না। যদিও সরকারকে ট্যারিফ দিতে গিয়েই এ লোকসানের শিকার হচ্ছে বিপিসি। গত অর্থবছর বিপিসির ঘাটতি ছিল ২ হাজার ৪৭৮ কোটি টাকা। একই সময়ে সরকারকে ৪ হাজার ৫২৫ কোটি টাকা রাজস্ব প্রদান করেছে বিপিসি। এ হিসাবে জ্বালানি তেল কেনাবেচায় প্রকৃতপক্ষে ২ হাজার ৪৭ কোটি টাকা মুনাফা করেছে প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু রাজস্ব পরিশোধের চাপ থাকায় তেলের দাম কমাতে পারছে না তারা।
জ্বালানি বিভাগ সূত্র জানায়, চলতি বাজেটে জ্বালানি তেল আমদানিতে ট্যারিফ মূল্য বাড়ানো হয়েছে। যদিও বেসরকারি খাতের একাধিক কোম্পানি বর্তমানে ভ্যাটমুক্ত সুবিধায় তেল আমদানি করছে। ট্যারিফ-ভ্যাট মওকুফ হলে বিপিসিও দাম কমাতে পারবে। কিন্তু ভ্যাট মওকুফ করার পরিবর্তে বিপিসি থেকে রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে সরকার। ট্যারিফ মূল্য বাড়ানোর ফলে চলতি অর্থবছর রাজস্ব আহরণ ১ হাজার কোটি টাকা বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এদিকে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) সূত্র জানায়, ফার্নেসের দাম লিটারে ২ টাকা কমালে ফার্নেসভিত্তিক বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় কমবে ইউনিটপ্রতি প্রায় ৫০ পয়সা। তাতে পিডিবি বছরে ২০০ কোটি টাকা সাশ্রয় করতে পারে। সব মিলে বর্তমানে ফার্নেস অয়েলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা ২ হাজার মেগাওয়াট। বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদনে পিডিবির নিজস্ব ক্ষমতা ৭৯১ মেগাওয়াট, আইপিপির ২৯৭ মেগাওয়াট এবং ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর এ ক্ষমতা ৯১৭ মেগাওয়াট।
এ প্রসঙ্গে বিদ্যুৎ বিভাগের নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক মাহবুব সারোয়ার-ই-কায়নাত বলেন, বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় কমাতে ফার্নেস অয়েলের দাম কমাতে পারে সরকার। ফার্নেসের দাম লিটারে ২ টাকা কমিয়ে ফার্নেস অয়েলভিত্তিক কেন্দ্রের উৎপাদন ব্যয় ৫০ পয়সা কমালে গড় উৎপাদন ব্যয় কমবে ১৫ পয়সা। এটি পিডিবির জন্য অনেক সাশ্রয়ী হবে।