হাওর-পরিবেশ রক্ষা করেই কৃষিজ উৎপাদন বাড়াতে হবে, বাদ পড়া হাওরগুলোকে মাস্টারপ্ল্যানের আওতাভুক্ত করতে হবে: ড. আবেদ চৌধুরী
প্রকাশিত হয়েছে : ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ৫:৩১ অপরাহ্ণ
প্রেস বিজ্ঞপ্তি::
হাওরের কৃষিজ উৎপাদন (ধান ও মাছ) বাড়ানোর লক্ষ্যে কাউয়াদিঘী হাওর রক্ষা আন্দোলনের আয়োজনে মৌলভীবাজার জেলার কৃষক মৎসজীবীদের মতবিনিময় সভার অংশীজনেরা বলেন, এশিয়ার বৃহত্তম হাওর হাকালুকি — দেশের মিঠাপানির সবচেয়ে বড় রিজার্ভার এবং নানা প্রজাতির মাছ ও জলজ উদ্ভিদের সমাহার — যে হাওরের ৭০ ভাগ অংশ মৌলভীবাজার জেলায়, এককভাবে বৃহত্তর হাওর কাউয়াদিঘীকে কেন্দ্র করে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মনু সেচ প্রকল্প এবং পর্যটকদের প্রিয় বাইক্কা বিলের হাইল হাওর এবং এ তিনটি বড় হাওরের গর্ভেও অনেকগুলো ছোট ছোট হাওর রয়েছে। এছাড়াও হাওরের বৈশিষ্ট্য নিয়ে এখনো ঠিকে আছে বড় হাওর, কাটাবিলের হাওর, গুলের হাওর, হলদিয়ার হাওর, কেওলাবিলের হাওর, করাইয়ার হাওর, হিংগুয়ার হাওর, বীর গুগালির হাওর, ভুরভুরির হাওর, চাতলা বিলের হাওর, খাইঞ্জার হাওর সহ ছোট-বড় ৩০ টির বেশি হাওর রয়েছে এ জেলায়। কিন্তু জলাভূমি ও হাওর উন্নয়ন অধিদপ্তর মনগড়াভাবে তাদের মাস্টারপ্ল্যানে বলছে, জেলায় হাওরের সংখ্যা ৩ টি। হাওরগুলোর প্রকৃত সংখ্যা জেলার পাউবি, কৃষি, মৎস্য ও পরিবেশ — কোনো দপ্তরের হাতেই নেই। তাহলে এই ভুল সংখ্যা উনারা পেলেন কোথায়? যে হাওরগুলো জেলার ২১ লাখ মানুষের পরিবেশ ভারসাম্যের হৃৎপিণ্ড হিসেবে কাজ করছে এবং মিঠাপানির মাছের চাহিদা পুরণ সহ খাদ্যের যোগান দিচ্ছে, সেই হাওরগুলো নিয়ে সরকারের আমলা-কামলাদের দায় ছাড়া ধরণের দায়িত্ব পালন প্রমাণ করছে আমরা উন্নয়ন বৈষম্যের শিকার হচ্ছি। এই তালিকা সংশোধন করতে হবে। এটা সংশোধন করা না হলে হাওর পাড়ের জনগণের উন্নয়ন বৈষম্য রোধ করা যাবে না। কাউয়াদিঘী হাওরে রয়েছে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ‘মনু সেচ প্রকল্প’। কিন্তুকম থাকায় সরকারি মেডিক্যাল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়েছে। বিগত সময়ের অদক্ষ ও লুটেরা রাজনৈতিক নেতৃত্ব বৈষম্যের এই বিষয়গুলোর সঠিক মোকাবেলায় ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। নতুন রাজনৈতিক নেতৃত্ব যারা আসবেন, তাঁরা এসব বিষয়ে মনোযোগ দিয়ে কাজ করতে হবে। জিন বিজ্ঞানী ড. আবেদ চৌধুরী বলেন, দেশে গুণী মানুষের কদর নেই, দূর্বৃত্তরা দেশ চালিয়েছে, হাওর নদী পাহাড় সব খেয়ে নিতে চাচ্ছে। জনগণের সচেতনতাই এসব প্রতিরোধ করতে পারে। মৌলভীবাজার জেলার হাওরগুলোতে ফসলের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। এই সম্ভাবনা কাজে লাগানোর জন্য হাওর নিয়ে ভাবতে হবে। হাওরের ভূমির উপযোগী ধান উৎপাদন করতে হবে। হারিয়ে যাওয়া মাছ ফিরিয়ে আনতে হবে। অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সয়েল সাইন্স বিভাগের অধ্যাপক এম এ কাশেম, জলজ সম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক মৃত্যুঞ্জয় কুন্ড, মৌলভীবাজার মহিলা সমিতির সভাপতি ডাঃ দিলশাদ পারভীন চৌধুরী প্রমুখ।
বৈষম্য নিরসনে এবং মৌলভীবাজার জেলার হাওর পাড়ের কৃষক-মৎস্যজীদের উন্নয়নে কাউয়াদিঘী হাওর রক্ষা আন্দোলনে দাবিগুলো নিম্নরূপ —
(১) মৌলভীবাজার জেলার ছোট-বড় ৩০ টি হাওরকে হাওর ও জলাভূমি উন্নয়নের হালনাগাদ মাস্টার প্ল্যানের তালিকাভুক্ত করতে হবে।
(২) হাওরের খাল-বিল-ছড়া নদী খনন ও দখলমুক্ত করতে হবে। হাওরের কান্দিগুলোতে/বিলের পাড়ে জলজ বৃক্ষ (হিজল, করচ, জারুল) রূপন করতে হবে।
(৩) মাছের প্রাকৃতিক উৎপাদন বাড়ানো, দেশীয় প্রজাতির মাছ বাঁচানো, পুষ্টি চাহিদা পুরণে হাওরে মাছের অভয়াশ্রম বাধ্যতামূলক করতে হবে এবং অনতিবিলম্বে কাউয়াদিঘী হাওরের ৪২ টি বিলের মধ্যে ‘হাওয়া বিলকে’ অভয়াশ্রম ঘোষণ কর৷ অন্যান্য বিলের মাছ আহরণে লুটেরা লীজ প্রথা বাতিল করে লাইসেন্স প্রথা চালু কর।
(৪) হাওর পরিবেশ-প্রতিবেশ, প্রাণ-প্রকৃতি, জীববৈচিত্র্য বিনাশ করে এমন জায়গায় সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপন/শিল্পায়ন করা যাবেনা।
(৫) মনু সেচ প্রকল্পভূক্ত কাউয়াদিঘী হাওরে নদী থেকে হাওরে মাছের অবাধ (আগের মতো) প্রবেশের জন্য কুশিয়ারা নদীর বেরিবাঁধে ৪ টি ও মনু নদের বেরিবাঁধে ২ টি ‘ফিসপাস গেইট’ নির্মাণ করতে হবে।
(৬) কৃষিজ উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে — মনু সেচ প্রকল্পের পরিবেশ সহায়ক বিজ্ঞান সম্মত আধুনিকায়ন/ সংস্কার-সহ হাওরের পানির মৌসুম ভিত্তিক লেভেল নির্ধারণ করে (ক) কৃষক-মৎস্যজীবী প্রতিনিধি নিয়ে (হাওর পাড়ের ৩৭ টি গ্রাম/পাড়া থেকে অনূন্য ৫ জন করে) পানি ব্যবস্থাপনা এবং (খ) ভূমির ধরণ অনুযায়ী পঞ্চব্রীহি, চতুর্ব্রীহি, ত্রি-ব্রীহি, দ্বি-ব্রীহি ধান ও সবজি ফলনের প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
(৭) হাওর এলাকায় যে কোনো উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করতে হাওর নিয়ে কাজ করে এমন দপ্তর/পরিদপ্তর সমূহের সমন্বিত পরিকল্পনা থাকতে হবে। বর্ষা মৌসুমে হাওরের পানির প্রবাহ বাঁধাগ্রস্থ করে বন্যার সৃষ্টি হয় ও মাছের অবাধ বিচরণে বিঘ্ন ঘটে এমন প্রকল্প গ্রহণ করা যাবে না।
(৮) হাওরের রাস্তায় নির্মিত নিচু কালভার্ট/ব্রীজ (যেগুলোর নীচ দিয়ে বর্ষায় নৌকা চলাচল করতে পারে না) এমন কালভার্ট/সেতু অপসারণ করে পুননির্মাণ করতে হবে।
(৯) কাউয়াদিঘী হাওরের নলুয়া ছড়া, কাংলা, লাছ, মাছুখালি, ধলিধরা ছড়া লীজ দেওয়া বন্ধ করতে হবে। গোয়ালী খাড়ায় স্লুইসগেট নির্মাণ করতে হবে এবং কৃষকদের বিনামূল্যে সার-বীজ-কীটনাশক দিতে হবে।
দল-মত নির্বিশেষে ৯ দফা দাবি আদায়ের আন্দোলনে যুক্ত হবার জন্য বক্তারা সংশ্লিষ্ট সকলকে আহবান জানান।