পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উপলক্ষ্যে প্রকাশিত ধারাবাহিক নিবন্ধ
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জন্ম এবং এতদসংক্রান্ত অলৌকিক ঘটনাবলী (০২)
প্রকাশিত হয়েছে : ৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:১৪ অপরাহ্ণ
ধারাবহিক পর্ব ০২
ইদ্রীস কান্ধলাবী তাঁহার গ্রন্থে উল্লেখ করেন যে, সিরিয়ার রাজপ্রাসাদ জ্যোতির্ময় হওয়ার ইহাও একটি কারণ যে, চল্লিশজন আবদাল (কামেল ওলী)-এর মধ্যে যে একজন আবদাল মিল্লাতি ইব্রাহীমের অনুসরণ-অনুকরণ করিয়াছিলেন, তাঁহাদের সকলেরই বাসস্থান ছিল সিরিয়া অঞ্চলে। সুতরাং অন্যান্য অঞ্চল হইতে সিরিয়াতেই বেশী নূর উদ্ভাসিত হইয়াছিল। ইহা ছাড়াও আরো. একটি সূক্ষ্ম ইঙ্গিত রহিয়াছে যে, এই স্থানটি ছিল নবুওয়াতের জ্যোতিতে উদ্ভাসিত একটি বিশেষ স্থান। এই কারণে মি’রাজের রাত্রে রাসূলুল্লাহ (স)-কে মহান আল্লাহ সিরিয়া অর্থাৎ মাসজিদুল আকসা পর্যন্ত ভ্রমণ করাইয়াছিলেন। আল্লাহ পাক বলিয়াছেন:
‘পবিত্র ও মহিমময় তিনি, যিনি তাঁহার বান্দাকে এক রজনীতে মসজিদুল হারাম হইতে মসজিদুল আকসাতে পরিভ্রমণ করাইয়াছেন, যাহার চারিপার্শ্ব আমি বরকতে পরিপূর্ণ করিয়া দিয়াছি, যেন আমার কুদরতের নিদর্শনসমূহ হইতে কিছু তাহাকে দেখাইতে পারি’ (১৭ : ১) (মুহাম্মাদ ইদ্রীস কান্ধলাবী, সীরাতুল মুসতাফা, পৃ. ৫৪)।
আস্-সীরাতুল-হালাবিয়্যা গ্রন্থে মুহাম্মাদ (সা.)-এর সিজদারত অবস্থায় জন্মগ্রহণের এক তাৎপর্য এইভাবে উল্লেখিত হইয়াছে, সিজদারত অবস্থায় জন্মগ্রহণ অবশ্যই এই দিকে ইঙ্গিত বহন করে যে, তাঁহার জীবনের প্রথম আমলের বহিঃপ্রকাশ এমন এক অনুপম ইবাদতের মাধ্যমে, যাহার দ্বারা রব্বুল আলামীনের অধিক নৈকট্য লাভ করা যায় (‘আলী ইবন্ বুরহানুদ্দীন আল-হালাবী, আস-সীরাতুল-হালাবিয়্যা, ১খ, পৃ. ৫৪)।
তন্দ্রাবস্থায় সায়্যিদা আমিনার কাছে আগমনকারীদের সংখ্যা ছিল অসংখ্য-অগণিত, এই মর্মে আস্-সুয়ূতী আল-ওয়াকিদী’র সনদ-পরস্পরায় ইবন সা’দ-এর উদ্ধৃতিতে আরো উল্লেখ করিয়াছেন যে, ‘অসংখ্য আগমনকারী তন্দ্রাকালীন সময়ে আমার নিকট প্রায়ই আসিত এবং জিজ্ঞাসা করিত, তুমি কি নিজেকে একজন গর্ভবর্তী অনুভব করিতেছ? উত্তরে বলিতাম, না, মোটেই না’ (আস্-সুয়ূূতী, আল-খাসাইসুল-কুরা, ১খ, পৃ. ৪২)। এই সম্পর্কে আরো (দ্র. ইব্ন সায়্যিদিন-নাস, ‘উদ্বুদুল-আছার ফী ফুনুনিল- মাগাযী ওয়াশ শামাইল ওয়াস-সিয়ার, পৃ. ২৫)। ভূমিষ্ঠকালীন প্রকাশিত অলৌকিক ঘটনাবলীর প্রত্যক্ষকারী আশ-শিফা বিনতে আমর ইব্ন আওফ হইতে আরো কিছু বর্ণনা সীরাত গ্রন্থাবলীতে পাওয়া যায়। এই প্রসঙ্গে সুয়ূতী (র.) উল্লেখ করিয়াছেন, আবু নু’আয়ম আবদুর রহমান ইবনে আওফ হইতে, তিনি তাঁহার মাতা আশ-শিফা বিনত আমর ইবন আওফ হইতে বর্ণনা করেন : সায়্যিদা আমিনার গর্ভ হইতে রাসূলুল্লাহ (সা.) উভয় হাতের উপর ভর দিয়া ভূমিষ্ঠ হইলেন এবং কিছুটা শব্দ করিলেন।
অতঃপর আমি এক ব্যক্তিকে বলিতে শুনিলাম, ‘মহান আল্লাহ আপনার উপর অনুগ্রহ করুন। নিশ্চয় আপনার প্রতিপালক আপনার উপর অনুগ্রহ করিয়াছেন।’ আশ্-শিফা বলেন, অতঃপর প্রাচ্য-প্রতীচ্যের মধ্যবর্তী সকল স্থান জ্যোতির্ময় হইয়া উঠিল। ফলে আমি রোম নগরীর সকল অট্টালিকা স্পষ্ট দেখিতে পাইলাম। তিনি বলেন, ইহার পর আমি তাঁহাকে কাপড় পরিধান করাইলাম এবং কাৎ করিয়া শোয়াইলাম। হঠাৎ দেখিতে পাইলাম, আমার ডান দিক হইতে একটা অন্ধকার আমাকে ঘিরিয়া ফেলিল। ফলে দেহ-মন কাঁপিয়া উঠিল এবং ভয়ের সঞ্চার হইল। তারপর আমি একজনকে বলিতে শুনিলাম, ‘তুমি তাঁহাকে কোথায় লইয়া যাইতেছ?’ উত্তরে অন্যজন বলিল, আমি তাঁহাকে প্রতীচ্যে ভ্রমণে লইয়া যাইতেছি। তারপর সে আমার নিকট হইতে তাঁহাকে লইয়া গেল। কিছুক্ষণ পর আমার বাম দিক হইতে অনুরূপ অন্ধকার ও ভীতিজনক পরিস্থিতি আসিল, অতঃপর অনুরূপ প্রশ্নোত্তর শুনিতে পাইলাম। এইবার তিনি বলিলেন, আমি তাঁহাকে প্রাচ্যে ভ্রমণে লইয়া যাইতেছি। আশ্-শিফা বলেন, আমি এই ঘটনা প্রায়ই আলোচনা করিতাম। অবশেষে মহান আল্লাহ তাঁহাকে নবুওয়াত দান করিলেন। আর আমি তাঁহাদের মধ্যকারই একজন ছিলাম যাঁহারা প্রথমে ইসলাম গ্রহণ, করিয়াছিলেন (আস-সুয়ূতী, খাসাইসুল-কুরা, ১খ, তা. বি., ৪৬, ৪৭)।
আবূ নু’আয়ম রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর শুভ জন্মের মুহূর্তে ফেরেস্তাদের আগমন ও পারস্পরিক মুবারকবাদ জ্ঞাপন, শয়তান বন্দী, মূর্তির অধঃপতি ও বায়তুল্লাহর মৃদু কম্পন ইত্যাদি বিষয় প্রসঙ্গে ‘আমর ইব্ন কুতায়বা-এর রিওয়ায়াত বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমি আমার বিজ্ঞ পিতাকে বলিতে শুনিয়াছি যে, যখন সায়্যিদা আমিনার গর্ভের সন্তান ভূমিষ্ঠ হইবার সময় নিকটবর্তী হইল তখন মহান আল্লাহ্ ফেরেস্তাদের বলিলেন, তোমরা আসমানের সকল দরজা খুলিয়া দাও, এমনকি জান্নাতের দ্বারগুলিও উন্মুক্ত করিয়া দাও। মহান আল্লাহ সকল ফেরেশতাকে তথায় উপস্থিত হইতে আদেশ করিলেন। ফলে ফেরেশতারা পরস্পর মুবারকবাদ জ্ঞাপন করিতে করিতে অবতীর্ণ হইল।
ফেরেশতাদের আগমন এত বেশী ছিল যে, সারা দুনিয়ার পাহাড়-পবর্তে দীর্ঘ সারির সৃষ্টি হইল, এমনকি উহা সমুদ্রগুলিতে পৌঁছাইয়া গেল এবং পারস্পরিক মুবারকবাদ জ্ঞাপন অব্যাহত রহিল। শয়তানকে ৭০টি শিকল দ্বারা বন্দী করা হইল এবং তাহাকে উপুড় করিয়া শ্বেত সাগরের গভীরে নিক্ষেপ করা হইল। সূর্যকে সেদিন অত্যুজ্জ্বল জ্যোতির্ময় আলোর বাহারী পোশাক পরিধান করানো হইল এবং উহাকে সায়্যিদা আমিনার শিয়রে স্থাপন করা হইল।
ফেরেশতাদের আগমন এত বেশী ছিল যে, সারা দুনিয়ার পাহাড়-পবর্তে দীর্ঘ সারির সৃষ্টি হইল, এমনকি উহা সমুদ্রগুলিতে পৌঁছাইয়া গেল এবং পারস্পরিক মুবারকবাদ জ্ঞাপন অব্যাহত রহিল। শয়তানকে ৭০টি শিকল দ্বারা বন্দী করা হইল এবং তাহাকে উপুড় করিয়া শ্বেত সাগরের গভীরে নিক্ষেপ করা হইল। সূর্যকে সেদিন অত্যুজ্জ্বল জ্যোতির্ময় আলোর বাহারী পোশাক পরিধান করানো হইল এবং উহাকে সায়্যিদা আমিনার শিয়রে স্থাপন করা হইল। সঞ্চরজন ফেরেশতা মুহাম্মাদ (স)-এর শুভ জন্মগ্রহণের মুবারক মুহূর্তের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষমান ছিলেন। মহান আল্লাহর নির্দেশে মুহাম্মাদ (স)-এর সম্মানার্থে এই বৎসর প্রত্যেক মহিলার উদরে পুত্র সন্তান ভূমিষ্ঠ হইয়াছিল। মরুভূমির প্রতিটি বৃক্ষ ফলবতী হইয়াছিল। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সা.) ভূমিষ্ঠ হইলেন। ফেরেশতারা মহানন্দে মুবারকবাদ জ্ঞাপন করিতে লাগিলেন। প্রত্যেক আসমানের যবরজদ ও য়াকৃত-এর খুঁটিসমূহ মুহূর্তে কম্পমান হইয়া উঠিল এবং জ্যোতির স্তম্ভে পরিণত হইল। মি’রাজের রাত্রে রাসূলে কারীম (স) ঐগুলিকে স্বচক্ষে দর্শন করিয়া চিনিতে পারিয়াছিলেন। কম্পিত হইবার কারণ জিজ্ঞাসা করিলে উত্তর আসিল, আপনার শুভ জন্মগ্রহণের সুসংবাদ শ্রবণে ইহারা প্রকম্পিত হইয়াছিল। এই রাত্রে হাওযে ‘কাওছার’-এর প্রশস্ত তীরে ৭০ হাজার সুগন্ধিময় বৃক্ষ জন্মলাভ করিয়াছিল যাহার ফলগুলি মহান আল্লাহ জান্নাতবাসীদের সুগন্ধি গ্রহণের নিমিত্তেই সৃষ্টি করিয়াছেন।
ঐ মুহূর্তে প্রত্যেক আসমানবাসী মহান আল্লাহর কাছে অনাবিল শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য প্রার্থনা করিয়াছিলেন। মূর্তিগুলি উপুড় হইয়া পড়িয়াছিল। লাত-উযযা হইতে আক্ষেপের আওয়াজ আসিতেছিল। আক্ষেপ! কুরায়শূন্দের জন্য। তাহাদের কাছে আজ আল্-আমীন বা বিশ্বস্থজন পৌঁছিয়াছে, ‘আস্-সাদিক’ বা সত্যবাদীর শুভাগমন হইয়াছে। অথচ সেদিন কুরায়শরা বুঝিতে পারে নাই লাত-উযযার কি হইয়াছে?
বায়তুল্লাহ-র অভ্যন্তর হইতে এমন আওয়াজ হইতেছিল, যাহা প্রত্যেক শ্রবণকারী শ্রবণ করিয়াছিল। বায়তুল্লাহ যেন বলিতেছিল, ‘আজ আমার ‘নূর’ বা জ্যোতিকে যোগ্যতম ব্যক্তির খেদমতে প্রত্যর্পণ করা হইয়াছে। আমার প্রতিবেশীর আগমন হইয়াছে। জাহিলিয়্যাতের পঙ্কিলতা হইতে আমি মুক্ত হইলাম। ওহে লাত-উযযা। তোমাদের ধ্বংস অনিবার্য।’ ঐ মুহূর্ত হইতে বায়তুল্লাহ তিন দিন তিন রাত পর্যন্ত মৃদু কম্পমান অবস্থায় ছিল, যাহা মুহূর্তের জন্যও বন্ধ হয় নাই। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর শুভ জন্মের মুহূর্তে ইহাই ছিল প্রথম ‘আলামত বা নিদর্শন, যাহা কুরায়শগণ স্বচক্ষে দর্শন করিয়াছিল (আস্-সুয়ূতী, খাসাইসুল্ কুবরা, ১খ., পৃ. ৪৭)।
কোন কোন বর্ণনায় সমগ্র জগত আলোকিত হওয়ার উল্লেখ রহিয়াছে। এই মর্মে ‘ইকরিমা (র)-এর রিওয়ায়াত ইবন আবী হাতিম বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন ভূমিষ্ঠ হইয়াছিলেন তখন সমগ্র জগত আলোকিত হইয়াছিল (সুবুলুল হুদা ওয়ার- রাশাদ, ১খ, পৃ. ৩৪২)।
রাসূলে কারীম (সা.)-এর শুভ জন্মগ্রহণের মুহূর্ত হইতে মারদূদ শয়তান-এর অবাধ চলাফেরা নিয়ন্ত্রণে সাত আসমানেই বাধার প্রাচীর সৃষ্টি করা হয়। এই প্রসঙ্গে মা’রূফ ইবন খাররাবুয- এর রিওয়ায়াত আয-যুবায়র ইব্ন বাক্কার ও ইবনে ‘আসাকির উল্লেখ করেন, তিনি বলেন, ইবলীস সাত আসমান বিদীর্ণ করিয়া অবাধ চলাফেরা করিত। হযরত ঈসা (আ)-এর ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর তাহার অবাধ চলাফেরা নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে তিনটি আসমানে বাধার প্রাচীর সৃষ্টি করা হয়। ইহার পর সে বাকী চার আসমানে অবাধে চলাফেরা করিত। অতঃপর রাসূলে কারীম (সা.) ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর সাত আসমানেই বাধার প্রাচীর সৃষ্টি করা হয় (আস্-সুয়ূতী, খাসাইসুল কুবরা, ১খ, ৫১)।
সূত্রঃ-
সীরাত বিশ্বকোষ ৪র্থ খন্ড থেকে নেওয়া
হযরত মুহাম্মদ (সা.)
পৃষ্ঠা : ২০২-২০৪