তথ্য দেয়ায় কলেজ ছাত্রকে জেল খাটালেন বন কর্মকর্তা
প্রকাশিত হয়েছে : ১৫ জুলাই ২০২৪, ১০:০৩ অপরাহ্ণ
নিজস্ব প্রতিবেদক::
গাছ চুরির তথ্য সাংবাদিকদের জানানোয় মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার এক কলেজ ছাত্রকে মিথ্যা মামলা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এ মামলায় কলেজ ছাত্র ছনির হোসেন ইতিমধ্যে ১৫ দিন জেল খেটে জামিনে মুক্ত পেয়েছে। লাঠিটিলা বন বিটের বিট কর্মকর্তা মাজহারুল ইসলামের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ উঠেছে।
অভিযোগ রয়েছে, লাঠিটিলা সংরক্ষিত বন থেকে সেগুন কাঠ চুরির তথ্য গণমাধ্যমকে জানানোর কারনে তার প্রতি ক্ষিপ্ত হয়ে মামলা দিয়েছেন ঐ কর্মকর্তা। ছনির হোসেন (২০) উপজেলার গোয়াবাড়ী ইউনিয়নের লালছড়া গ্রামের ভিলেজার আসুক মিয়ার ছেলে। সে শিলুয়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের মানবিক বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। এছাড়াও একই মামলায় আরো দুইজনকে আসামী করা হয়েছে। তারা হলেন একই এলাকার মৃত আব্দুর রহমানের ছেলে আব্দুল (২৮) ও লোকমান মিয়ার ছেলে বদর মিয়া (৩৮)। এ ঘটনায় সুষ্ট তদন্তের মাধ্যমে প্রতিকার চেয়ে বিভাগীয় বন কর্মকর্তা বরাবরে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন ছনির হোসেন।
ছনির হোসেন অভিযোগ করে বলেন, এই গাছগুলো সরকারের সম্পত্তি। আমি একজন ভিলেজারের (বন জাগিদার) সন্তান হিসেবে এই বন রক্ষা করা আমার দায়িত্বে পড়ে। আমি বন বিভাগকে গাছ চুরির তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছি। বিট কর্মকর্তা চোরের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টা আমার উপর মামলা দিয়েছেন। গাছ চুরির সংবাদ গণমাধ্যমে প্রচার হওয়ার পরে একাধিকবার বিট কর্মকর্তা আমাকে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসা করেছেন কিভাবে এ খবর গণমাধ্যম পেয়েছে। আমি গাছ চুরির তথ্য দিয়েছি। চুরির সাথে জড়িত প্রকৃত চোরদের মামলা দেওয়ার কথা। আমি তো চুরির সাথে জড়িত নয়। আমাকে কেন মামলায় জড়ানো হলো। এই মামলার জন্য ঈদের আগের দিন থেকে আমি ১৫ দিন জেলে ছিলাম। এখন আমার পড়ালেখার ব্যাঘাত ঘটছে। পড়ালেখা করতে না পারলে আমার জীবন ধ্বংস হয়ে যাবে। আমি সুষ্ট তদন্তের মাধ্যমে সঠিক বিচার চাই এবং প্রকৃত দোষীদের আইনের আওতায় আনা হোক।
অনুসন্ধানে জানা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারী মাসের শেষের দিকে লাঠিটিলা বনের গলা চিপা ও দশের টিলা থেকে পনেরটি’রও বেশি সেগুন গাছ চুরি হয়েছে। এছাড়াও ১৫ থেকে ২০ টি সেগুন গাছ রিং পদ্ধতিতে মারা হয়েছে। এই বিষয়টি লাঠিটিলা বিট কর্মকর্তা অবগত হওয়ার পরেও বিষয়টি বন বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে না জানিয়ে স্থানীয় কয়েকজনকে নিয়ে সমাধান করেন। পনেরটিরও বেশি গাছ চুরির ঘটনায় বন বিভাগ অপরাধীদের আইনের আওতায় নেওয়ার কথা থাকলেও বিষয়টি অজ্ঞাত রয়ে যায়।
অভিযোগ রয়েছে, লাঠিটিলা বন বিটের দায়িত্বে থাকা বিট কর্মকর্তা মাজহারুল ইসলাম অনৈতিক সুবিধা নিয়ে পুরো ঘটনাটি আড়াল করার চেষ্টা করেন। ১ মাস পেরিয়ে গেলেও রহস্যজনক কারণে তৎকালিন সময়ে বন বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ’কেও ঘটনাটি জানানো হয়নি। এমনকি সেসময় জুড়ী রেঞ্জের রেঞ্জ কর্মকর্তা নাজমুল হুসাইন’কেও অবহিত করা হয়নি বলে জানিয়েছিলেন ঐ কর্মকর্তা। এভাবে সংরক্ষিত বনের গাছ চুরি হলে এক সময় পুরো বন উজাড় হয়ে যাবে বলে মনে করেন ভিলেজাররা। এ বিষয়টি বিট কর্মকর্তা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করলেও সচেতন কয়েকজন বন জাগিরদার গণমাধ্যমকে অবগত করেন। এ নিয়ে সংবাদ প্রকাশ না করতে গণমাধ্যমকর্মীকে মুঠোফোনে মামলার হুমকিও দেন ঐ বিট কর্মকর্তা।
পরবর্তীতে এ নিয়ে চলতি বছরে লাঠিটিলা সংরক্ষিত বনে লক্ষাধিক টাকার গাছ লোটপাট শিরোনামে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হয়। ঘটনাটি এলাকায় জানাজানি হলে পুরো এলাকা জুড়ে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। কলেজ ছাত্র ছনির হোসেনকে একাধিকবার বিট কর্মকর্তা তার কার্যালয়ে ডেকে গণমাধ্যমে জানানোর কারণ জানতে চেয়ে চাপ প্রয়োগ করেন। কিছুদিন পরে তিনি জানতে পারেন তার বিরুদ্ধে গাছ চুরির মামলা হয়েছে। গত ঈদ উল আযহার আগের দিন তাকে এ মামলায় গ্রেফতার করা হয়। ১৫দিন জেল খেটে জামিনে মুক্ত হোন তিনি।
এই মামলায় স্বাক্ষী ও উল্লেখিত প্রত্যক্ষদর্শী ফরেস্ট গার্ড আব্দুস সাকুর বলেন, ছনির হোসেন সে গাছ চুরির সাথে জড়িত নয়। যারা প্রকৃত চুর তাঁরা মামলা থেকে বাদ পড়েছেন। প্রকৃত গাছ চুরির সাথে জড়িতরা কোনভাবে যেন মামলা থেকে ছাড় না পায় এদেরকে আইনের আওতায় আনা উচিত। মামলার অপর স্বাক্ষী আব্দুস শুক্কুর জানান, এই মামলায় কেন তাঁকে জড়িত করা হয়েছে আমি জানি না। বিট অফিসার মাজহারুল ইসলাম আমাদের বস তিনি যাকে মামলা দিবেন, বাধ্যতামূলক সেই মামলায় আমাদেরকে স্বাক্ষর করতে হয়।
লাঠিটিলা বন বিটের দায়িত্বে থাকা বিট কর্মকর্তা মাজহারুল ইসলাম বলেন, এলাকার কিছু মানুষের কাছ থেকে তার নাম নিয়ে তদন্ত করে মামলা দিয়েছি। প্রকৃত চোরদের বাদ দিয়ে মামলা দেওয়া হয়েছে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, সে হয়তো কম জড়িত ছিলো। এ ঘটনায় জড়িত আরো দুজনকে মামলা দেওয়া হয়েছে। সে হিসেবে প্রকৃত অপরাধীদের বাদ দিয়ে মামলা দিয়েছি তা বলা যাবে না। মামলা যেহেতু হয়ে গেছে। ঐ ছেলেকে এখন কিভাবে সাহায্য করা যায় এই ব্যাপারে বুদ্ধি দেন। মামলার স্বাক্ষীরা অস্বীকার করছেন এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, তারা তো আমার স্টাফ। তারা কি কোর্টে বা আমার উদ্ধর্তন কর্তৃপক্ষের সামনে বলবে আমার কথায় স্বাক্ষর করেছে।
এ বিষয়ে জুড়ী রেঞ্জ কর্মকর্তা নাজমুল হুসাইন বলেন, ছনির হোসেন নামে যে ছেলেটাকে আসামি করা হয়েছে, সে আমার কার্যালয়ে এসেছিল। বিষয়টি আগে জানলে মামলা কোর্টে পাঠানোর পূর্বে তাঁর নাম বাদ দেওয়ার সুযোগ ছিল। এখন আর সুযোগ নেই। সে গাছ চুরির তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছে, এটা ভালো কাজ করেছে। এজন্য তাঁকে মামলা দেওয়া ঠিক হয়নি। লাঠিটিলা বিট কর্মকর্তাকে আমি অফিসে ডেকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম কেন ছেলেটাকে মামলা দেওয়া হয়েছে। তিনি জানিয়েছেন এটা ভুলে হয়ে গেছে। যাদেরকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন তারা বলেছেন ছনির হোসাইন জড়িত ছিল।
সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা হুমায়ূন কবির বলেন, এমনটি হলে এটি একটি অমানবিক এবং অত্যন্ত দুঃখজনক বিষয়। ছেলেটা মিথ্যা মামলায় জেল খাটছে এটা তো ফিরিয়ে দেওয়া যাবে না। একজন নিরপরাধ মানুষকে তো সাজা দিতে পারে না। তদন্ত করে সে নির্দোষ হলে তাকে মামলা থেকে কিভাবে অব্যাহতি দেওয়া যায় বিষয়টি বিবেচনা করবো। এটা তো মজা করার বিষয় নয়, বিট কর্মকর্তা যাচাই বাছাই না করে কেন এমন ভুল করবে। এবিষয়ে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।