মাওলানা নাসির ভাই- এ হৃদয় এখনো তোমাকে খোঁজে || সালাহ্ উদ্দিন ইবনে শিহাব
প্রকাশিত হয়েছে : ৮ জুলাই ২০২৪, ১:৪৩ অপরাহ্ণ
আজ ৮ জুলাই। শমসেরগঞ্জের মাওলানা নাসির উদ্দিন ভাইয়ের ইন্তেকাল বার্ষিকী। প্রতিবছর এই দিন এলে হৃদয়ে শূন্যতার তোফান বয়ে যায়। মানুষ হৃদয়ে এতোটা মায়া ধরে রাখতে পারে তা নাসির ভাইকে না দেখলে হয়তো বুঝতাম না। খুব ছোটবেলা থেকেই মৌলভীবাজার সদর উপজেলার শমসেরগঞ্জের দৌলতপুরস্থ তাদের বাড়িতে আমার যাতায়াত। সেই সময় থেকে মাওলানা নাসির উদ্দিন ভাইকে আমি খুব কাছে থেকে দেখেছি। প্রথম দিন দেখেই নাসির ভাইকে আমার ভাল লেগে যায়। সেবার করিমুল ভাইয়ের সাথে তাদের বাড়িতে প্রায় ২/৩ দিন থেকেছিলাম। আসার সময় নাসির ভাই বল্লেন, ‘সালাহ উদ্দিন- তুমি তো আমরার বাড়িত আইয়া মায়া লাগাইলিছো, সব সময় আইয়ো’। তারপর থেকেই এই বাড়িটি নিজের বাড়ির মতোই আপন হয়ে গিয়েছে। তখন থেকে বেশুমার যাতায়াত তাদের বাড়িতে। আজও যাই- কিন্তু কি যেন নাই। মাওলানা ভাইকে ছাড়া সীমাহীন শূন্যতায় পোড়ে বাড়ি, পুকুরঘাট, ওজুখানা। আজ নাসির ভাইর মৃত্যুর ৪ বছর হয়ে গেল। কত দ্রুত সময় ফুরোয়। জানি, পৃথিবীর এই রঙ্গশালায় মানুষ মুসাফির মাত্র। মানুষের বিপুল বাসনা, আশা-আকাঙ্ক্ষা মৃত্যুর শেষ তরনীতে মিলিয়ে যায়। কিন্তু এতোটা দ্রুত, এতো তাড়া নিয়ে নাসির ভাই চলে গেলেন যা হৃদয়ের মর্মরে করুণ সুরে বাজে। সীমাহীন শূন্যতায় হু হু করে উঠে বুক।
স্মৃতি বড় দুঃখজাগানিয়া। বারবার ওলট-পালট করে দেয়। নাসির ভাইর কথা মনে হলে- আমার তাদের ঘরের বারান্দায় খাবারের দৃশ্যের কথা মনে পড়ে যায়। একসাথে অনেকজন বসে খাবার খাচ্ছি আর নাসির ভাই পাঁয়চারি করছেন। কার প্লেটে কী দেওয়া দরকার তদারকি করছেন। অমুক তমুককে বলছেন- এই এখানে কদুর তরকারি দেও, দেশি মাছ দেও। আহ! এইসব মানুষগুলো কেন যে এতো দ্রুত আমাদের ছেড়ে চলে যান! কেন এতো চলে যাওয়ার প্রতিযোগিতা আমি বুঝি না। মনের এই সংবেদনশীলতা আমাকে বারবার টুকরো টুকরো করে দেয়।
ব্যক্তিগতভাবে কারও স্তুতি বন্দনা করা আমি জানি না। এজন্য পেছনের সারিতেই পড়ে রই। অনেক কিছু অনায়াসে ছেড়ে আসা লোক আমি। কিন্তু যেটা ছাড়তে পারি না- সেটা মায়া। মানুষের স্নেহ, ভালবাসা ও মায়ের কাছে বারবার আটকে গেছি। আর আমি সেই মায়া খোঁজে পেয়েছি মাওলানা নাসির উদ্দিন ভাইয়ের কাছে।
মাওলানা নাসির উদ্দিন ভাই ইন্তেকালের কিছুদিন আগে শমসেরগঞ্জে গিয়েছি সাব্বির ভাইকে (আলহাজ হাফিজ মাওলানা সাব্বির আহমদ, লন্ডন প্রবাসী) বিদায় জানাতে। তিনি ফের লন্ডন চলে যাবেন। অনেক রাত হয়ে গেছে, বাইরে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি। কিছুক্ষণের ভেতর ভাই চলে যাবেন, আমিও বাড়ি ফেরার চিন্তা করছি এমন সময় নাসির ভাই বললেন চিন্তা করো না- তুমি আর শফিকুলকে (মাওলানা শফিকুল আলম সুহেল) এই গাড়ি বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দেবে। নাসির ভাই আমাদের জন্য আগেই গাড়ির কথা চিন্তা করে রেখেছিলেন। কিন্তু আসার সময় তার নিজহাতে ফলানো সবজি মুকিসহ আরো কয়েকপদ ব্যাগভর্তি করে সাথে দিলেন। এটা শুধু একবার নয়- প্রায় সময় খুব গোপনে আমার হাতে পাঁচশ, একহাজার টাকার নোট ধরিয়ে দিতেন। বারবার না করলেও বলতেন- আমার কাছে তোমাদের হক আছে। এটা নাও কাজে লাগবে।
বয়সের চেয়ে অনেক ব্যবধান থাকা সত্তে¡ও ভাই বলেই যে সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল সে সম্পর্কে সজিব রাখতে সবসময় অগ্রণী ভূমিকা পালন করতেন। প্রায়ই ফোন দিয়ে খোঁজখবর নিতেন। কখনও ফোন ধরতে না পারলে মনে মনে কষ্ট পেতেন।দেখা হলে বলতেন- ফোন ধরো না কেন? তখন লজ্জা পেতাম। আজ পৃথিবীর চরম বাস্তবতা আমাকে শিখিয়েছে- পরিশ্রম করলে টাকা পাওয়া যায়, কাউকে কিছু দিলে তা ব্যাক পাওয়া যায় কিন্তু নাসির ভাইয়ের মতো মন থেকে ভালবাসার মানুষ পাওয়া যায় না।
নাসির ভাই ছিলেন অন্যদের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। এক অনন্য উচ্চতায় ছিলেন তিনি। তাঁর আচার-ব্যবহার-বিনয়, আখলাকে এক ব্যতিক্রম পুরুষ। কথাবার্তা, উদার দিল, উন্নত মানসিকতায় তিনি সকলের কাছে প্রিয় ছিলেন। অনেক মানুষ প্রতিদিন তাদের বাড়িতে যেতেন। নাসির ভাইদের ৮ ভাইয়ের মধ্যে সবার বড় শ্রদ্ধেয় জনাব ফখরুল ইসলাম ভাই একজন রাজনীতিবিদ। আলহাজ হাফিজ মাওলানা সাব্বির আহমদ ভাই একজন দেশবরেন্য ইসলামি আন্দোলনের নেতা। ফুলতলী মসলকের এক নির্ভীক সিপাহসালার। এই সুবাদে রমজান ও ঈদ ছাড়া বিভিন্ন উপলক্ষ্যে তাদের বাড়িতে বড় বড় মানুষের আগমন ঘটতো। এসকল মানুষের সকলেই নাসির ভাইকে পছন্দ করতেন।
তবু- এই মুসাফিরি জীবনেরও শেষ হয়। দুঃখসুখের দোলাচল কবরের স্পর্শে থেমে যায়। নাসির ভাইও হয়তো ঔরশজাত সন্তান না থাকার দুঃখ মনে পোষতেন। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছা মানুষের বোঝার ক্ষমতা নেই। তিনি তার ভাতিজা, ভাতিজিকে সন্তানের মতোই লালন-পালন করেছেন। আদব-আখলাক শিক্ষা দিয়েছেন। তাই আমি তাঁর ভাই, ভাতিজা ও স্বজনদের চোখে প্রিয়জন হারানোর তুমুল আহাজারি দেখি।
দুদিনের এই দুনিয়াবি সফরে মায়া ছড়িয়ে মাওলানা ভাই বেহেশতের বাসিন্দা। বারবার মনে করার মতো তাঁর কিছু কর্ম ও স্মৃতি নাজাতের ওসিলা হবে। আর আমাদের হৃদয় ভূবনে স্মৃতির তারা হয়ে জ্বলজ্বল করে আলো ছড়াবেন। আল্লাহ তুমি আমার প্রিয় মানুষ মাওলানা নাসির ভাইয়ের কবরকে জান্নাতুল ফেরদৌসের বাগান বানিয়ে দাও। আমিন।