মৌলভীবাজারে তিন লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি, প্লাবিত ৫০০ গ্রাম
প্রকাশিত হয়েছে : ২১ জুন ২০২৪, ৫:৫১ অপরাহ্ণ
নিজস্ব প্রতিবেদক::
গত কয়েকদিনের ভারী বর্ষণে, উজানের পাহাড়ি ঢল ও নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় ফুলে ফেঁপে উঠেছে হাকালুকি হাওর। মৌলভীবাজারের কুলাউড়া, জুড়ী, বড়লেখা উপজেলায় হাকালুকি হাওর পারের বিভিন্ন ইউনিয়নের গ্রামগুলোতে পানি অঝোর ধারায় প্রবেশ করছে। এদিকে জেলার মনু, ধলাই, কুশিয়ারা ও জুড়ী এই চারটি নদ-নদীর চারটি স্থানে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে।
বুধবার (১৯ জুন) সন্ধ্যা ৬টার তথ্য অনুযায়ী, মনু নদ মৌলভীবাজার শহরের কাছে চাঁদনীঘাটে বিপৎসীমার ৩৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়।এখানে বিপৎসীমা ১১ দশমিক ৩০ সেন্টিমিটার।
এদিকে পানিবন্দি মানুষদের খোঁজ-খবর নিতে হাকালুকি হাওর তীরবর্তী ভূকশিমইল ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করেন মৌলভীবাজার-২ কুলাউড়া আসনের সংসদ সদস্য শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল। অন্যদিকে বুধবার উপজেলার বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করে পানিবন্দি মানুষের খোঁজ-খবর নেন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মাওলানা ফজলুল হক খান সাহেদ।
এদিকে মঙ্গলবার বিকেলে সাবেক পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রী ও স্থানীয় সংসদ সদস্য মো. শাহাব উদ্দিন এমপি বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ জায়ফরনগর ও পশ্চিম জুড়ী ইউনিয়নের বন্যা কবলিত বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করেন এবং আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নেওয়া পরিবারের খোঁজ-খবর নেন। এসময় তিনি এসব পরিবারের মধ্যে রান্না করা খাবার ও ত্রাণ বিতরণ করেন। অন্যদিকে সদর উপজেলার জুগিডর এলাকা পরিদর্শন করেন জেলা প্রশাসক ড. উর্মি বিনতে সালাম, মৌলভীবাজার পৌরসভার মেয়র মো. ফজলুর রহমান, পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জাবেদ ইকবাল প্রমুখ।
এদিকে মৌলভীবাজার সদর উপজেলার কুশিয়ারা নদীর পাড়ে জুগিডর, মাছুয়াখালী এলাকা ও রাজনগর উপজেলার খাস প্রেমনগর এলাকায় বালু ভর্তি বস্তা দিয়ে পানি প্রবেশ রোধ করা হচ্ছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষ থেকে।
বুধবার (১৯ জুন) সন্ধ্যায় জেলা প্রশাসন সূত্র নিশ্চিত করে জানায়, গত কয়েক দিনে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল এবং বিভিন্ন স্থানে ভারি বৃষ্টিপাতে সৃষ্ট বন্যায় মৌলভীবাজারের সাতটি উপজেলার ৬৭টি ইউনিয়ন ও ৫টি পৌরসভার মধ্যে ৪৭টি ইউনিয়নের ৪৭৪টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে দুই লাখ ৮১ হাজার ৯২০ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বন্যায় প্রস্তুতকৃত আশ্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা ২০৪টি।
বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত উপজেলাগুলোর মধ্যে বড়লেখা উপজেলার ১০টি, জুড়ী উপজেলার ৬টি, কুলাউড়া উপজেলার ৮টি, সদর উপজেলার ৮টি এবং রাজনগর উপজেলার ৬টি ইউনিয়ন, কমলগঞ্জের ৪টি, শ্রীমঙ্গলের ৫টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়। পানি বৃদ্ধির ফলে বন্যাক্রান্ত উপজেলাসমূহে সকল ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। ইতিমধ্যে সবক’টি উপজেলায় বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে ভুক্তভোগী প্রায় দেড় হাজারেরও বেশি মানুষ আশ্রয় নিয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) মৌলভীবাজার সূত্রে জানা গেছে, মৌলভীবাজারে মনু, ধলাই, জুড়ী ও কুশিয়ারা নদীর চারটি স্থানে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। বুধবার সন্ধ্যা ৬টার তথ্য অনুযায়ী, মনু নদ মৌলভীবাজার শহরের কাছে চাঁদনীঘাটে বিপৎসীমার ৩৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এখানে বিপৎসীমা ১১ দশমিক ৩০ সেন্টিমিটার। মনু নদ কুলাউড়ার হাজীপুরে মনু রেলওয়ে স্টেশনের কাছে বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে। এখানে বিপৎসীমা ১৭ দশমিক ৫৫ সেন্টিমিটার। কমলগঞ্জে ধলাই নদ রেলওয়ে ব্রিজের কাছে বিপৎসীমার ৪৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এখানে বিপৎসীমা ১৯ দশমিক ৩৫ সেন্টিমিটার। কুশিয়ারা নদী শেরপুরে বিপৎসীমার ২১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এখানে বিপৎসীমা হচ্ছে ৮ দশমিক ৫৫ সেন্টিমিটার এবং জুড়ী নদী প্রবাহিত হচ্ছে ২০৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে। জুড়ীতে বিপৎসীমা হচ্ছে ৮ দশমিক ৯৩ সেন্টিমিটার।
কুলাউড়ার রাবেয়া আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা কাদিপুর ইউনিয়নের মৈন্তাম গ্রামের আক্কাস আলী (৪৫) বলেন, পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় আমার ঘরের ভেতর হাঁটুপানি। একটু পানি বাড়লেই বিছানায় পানি উঠবে। তাই পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ঈদের দিন বিকেলে আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছি। কখনো কল্পনাও করিনি এইভাবে নিজের বাড়ি ছাড়া হয়ে ঈদ করব।
ভূকশিমইল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আজিজুর রহমান মনির বলেন, হাকালুকি হাওরের পানি ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়ায় আমার ইউনিয়নের ২২টি গ্রামই প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি মানুষের জন্য ইউনিয়নের বিভিন্ন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে ৯টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। বুধবার দুপুর পর্যন্ত বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে প্রায় ১২০টি পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। শহরের সঙ্গে প্রধান সড়কের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। সরকারিভাবে এখনো কোনো সহায়তা পাইনি। তবে প্রশাসনের নির্দেশনা পেয়ে সরকারের পক্ষ থেকে শুকনো খাবার বিতরণ করছি।
কাদিপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাফর আহমদ গিলমান বলেন, পানি ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়ায় আমার ইউনিয়নের ১৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি মানুষের জন্য ইউনিয়নের বিভিন্ন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে ৮টি আশ্রয়কেন্দ্র বুধবার বিকেল পর্যন্ত প্রায় ৫০টিরও বেশি পরিবার আশ্রয় নিয়েছে।
কুলাউড়া উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো. শিমুল আলী বলেন, কুলাউড়ায় এখন পর্যন্ত ২২টি আশ্রয়কেন্দ্রে খোলা হয়েছে। বুধবার বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে ২৬৫টি পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। এখন পর্যন্ত ৮১ হাজার পরিবার পানিবন্দি রয়েছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে এবং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের মাধ্যমে আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা মানুষের মাঝে শুকনো খাবার, ওর স্যালাইন বিতরণ করা হচ্ছে।
জুড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা লুসিকান্ত হাজং বলেন, জুড়ী উপজেলায় ৬টি ইউনিয়নের ৬৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এখন পর্যন্ত ৪৬ হাজার ৯১০ পরিবার পানিবন্দি রয়েছে। পানিবন্দি হওয়ায় ২৩১টি পরিবার বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে রান্না করা খাবার খিঁচুড়ি ও পরিষদের পক্ষ থেকে শুকনো খাবার বিতরণ করা হচ্ছে।
পাউবো মৌলভীবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী জাবেদ ইকবাল বলেন, মঙ্গলবার রাতেও ভারতের ত্রিপুরায় অনেক বৃষ্টি হয়েছে। বুধবার সকালেও মাঝারি বৃষ্টি হচ্ছে। মনু ও ধলাই নদে উজানের পানি প্রবেশ করছে। তবে পানি বাড়লেও মনু নদের বাঁধ নিয়ে এখনো তেমন ঝুঁকি নেই। ধলাই নিয়ে ঝুঁকি আছে। ধলাই নদের বাঁধ পুরোনো। অনেক স্থানে বাঁধের অর্ধেক নদীতে বিলীন হয়ে গেছে।
মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসক উর্মি বিনতে সালাম বুধবার গণমাধ্যমকে জানান, জেলার সাতটি উপজেলায় মোট ২০৪টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এগুলোতে এক হাজার ৫১৩ টি পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। ৭০টি মেডিক্যাল টিম প্রস্তুত রয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় পানিবন্দি লোকদের উদ্ধারে প্রয়োজনীয় তৎপরতা চালাচ্ছে উপজেলা প্রশাসন। বন্যার সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য জেলা প্রশাসকের কার্যালয় এবং উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়ে কন্ট্রোল রুম স্থাপন করা হয়েছে। প্রতিটি ইউনিয়নে ট্যাগ অফিসার নিয়োগ করা হয়েছে। বন্যার্তদের স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের জন্য ইউনিয়নভিত্তিক মেডিক্যাল টিম গঠন করা হয়েছে। সরকারি ও বেসরকারিভাবে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। বন্যার্তদের সার্বিক সহযোগিতা প্রদান ও উদ্ধার কার্যক্রম চালানোর লক্ষ্যে স্বেচ্ছাসেবক টিম (স্কাউট, রোভার স্কাউট, রেড ক্রিসেন্ট, যুব রেড ক্রিসেন্ট, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স) প্রস্তুত রাখা হয়েছে। পুরো জেলায় বন্যা পরিস্থিতির ওপর সতর্ক দৃষ্টি রাখা হচ্ছে বলেও জানান জেলা প্রশাসক।