জীবনের শেষ বেলায় প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ চান যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা সহিদ
প্রকাশিত হয়েছে : ২৫ ডিসেম্বর ২০২৩, ৮:৪৩ অপরাহ্ণ
নিজস্ব প্রতিবেদক::
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর চলাচল পথে স্থল মাইন পুঁততে গিয়ে একটি মাইন বিস্ফোরণে চিরতরে দুই চোখ ও দুই হাত হারানো যুদ্ধাহত বীরমুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সহিদ চৌধুরী খুশি (৭০) জীবনের শেষ সময়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করতে চান।
মৌলভীবাজার জেলার জুড়ী উপজেলার ভবানীপুর গ্রামের বাসিন্দা মৃত আব্দুল ওহাব চৌধুরী ও মৃত সৈয়দা আক্তরী নেছার ১ম পুত্র আব্দুস সহিদ চৌধুরী খুশি ১৯৫৩ সালের ২৪ এপ্রিল জন্মগ্রহণ করেন। জুড়ী উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে ছাত্রলীগের রাজনীতি করতেন। ১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী ছিলেন। পাকিস্তানের শোষণ বঞ্চনার বিরুদ্ধে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের আহবানে সাড়া দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়ে প্রশিক্ষণে ভারতে চলে যাওয়ায় পরীক্ষা দেয়া হয়নি।
একান্ত আলাপচারিতায় জানা যায়- তিনি স্থল মাইন স্থাপন, এ্যান্টিট্যাংক মাইন, রাইফেল, গ্রেনেড, হ্যান্ড গ্রেনেড ইত্যাদি চালনার প্রশিক্ষণ নেন। প্রশিক্ষণ শেষে মুক্তিযুদ্ধের ৪ নং সেক্টরের ৪ নং সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন আব্দুর রবের অধীনে বারপুঞ্জি করিমগঞ্জে তাকে প্রেরণ করা হয়। তার কাজ ছিল বড়লেখা, বিয়ানীবাজার ও জকিগঞ্জ এলাকায় পাকিস্তানী শত্রুদের চলাচল পথে স্থল মাইন ফিট করা ও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা। মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে জলঢুপ সেতু, কালনী সেতু, নান্দুয়া সেতু ভাঙ্গা ও কুমারসাইল চা বাগানের বিভিন্ন স্থানে স্থল মাইল স্থাপনসহ বেশ কিছু অভিযান অসীম সাহসিকতার সহিত সহযোগীদের নিয়ে সফল ভাবে সম্পন্ন করেন তিনি।
যুদ্ধকালীন সময়ে আব্দুস সহিদ খুশির জীবনের বিপর্যয়কর ঘটনাটি ঘটে ১০ আগস্ট। এদিন একটি স্থল মাইন বিস্ফোরণে দু’টি হাত ও দু’টি চোখ হারান তিনি। ক্যাপ্টেন আব্দুর রবের নির্দেশে ও সুবেদার কুতুবের নেতৃত্বে বড়লেখা উপজেলার শাহবাজপুর ইউনিয়নের নান্দুয়ায় ভাঙ্গা সেতুর পাশে পাকিস্তানী শত্রæদের চলাচল রাস্তার পাশে স্থল মাইন পুঁতার কাজে যান তিনি। সাথে ছিলেন শাহবাজপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা আব্দুন নূর ও আব্দুল মান্নান। জায়গা মত ১০ টি স্থল মাইন পুঁতা হয়। তখন ভোর ৪টা। প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছিল। ১১ নম্বর মাইন পুঁতার কাজে ব্যস্ত খুশি। এ সময় অসাবধানতাবশত মাইনটি বিস্ফোরিত হয়। এতে তাঁর দুই হাত উড়ে যায়। দু’টি চোখ দগ্ধ হয়। গুরুতর আহতাবস্থায় সঙ্গীরা তাঁকে ক্যাম্পে নিয়ে যান। পরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি টিম তাঁকে করিমগঞ্জ হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে ১৫দিন, মাছিমপুর ক্যান্টনমেন্ট হাসপাতালে ১৫দিন, গুয়াহাটি আর্মি হাসপাতালে এক মাস ও মহারাষ্ট্রের কিরকি হাসপাতালে ১৫দিন চিকিৎসার পর পুণা সামরিক হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে হাত এবং চোখের অপারেশন করা হয়। কিন্তু চোখ গুলো পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়। ১৯৭২ সালের নভেম্বর মাসে চিকিৎসা শেষে দেশে চলে আসেন। তবে একা চলাফেরা করতে পারেন না। ৭৮ সালের জুনে বিয়ে করে সংসারী হন।
১৯৭৩ সালে ৭৫ টাকা দিয়ে ভাতা শুরু হয়ে বর্তমানে ৪৫ হাজার টাকা করে ভাতা পেলেও অন্যান্য সুবিধা থেকে বার বার বঞ্চিত হওয়া এই যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা জানান, ২০০৩ সালে সেনা বাহিনীর মেডিকেল বোর্ড যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের পঙ্গুত্ব নির্ণয় করে। সারা দেশে এ ক্যাটাগরীতে শত ভাগ যুদ্ধাহত হিসেবে ৯ জন মুক্তিযোদ্ধা চিহ্নিত করা হয়। এর মধ্যে তিনি এক জন। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘১৯৮২ সালের জানুয়ারিতে কয়েকজন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাকে বীরপ্রতীক উপাধিতে ভূষিত করা হয়। মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট কর্তৃক বাছাইকৃত তালিকায় আমার নাম ছিল। কিন্তু মহামান্য রাষ্ট্রপতির নিকট তালিকা প্রেরণের সময় অজ্ঞাত কারণে আমার নাম বাদ দেয়া হয়। ১৯৯১ সালে ২০জন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাকে এক লক্ষ টাকা করে পূনর্বাসন স্বরূপ দেয়া হয়। অর্থ বিভাগে প্রেরিত তালিকার ১৭নং ক্রমিকে আমার নাম ছিল। সেখানেও অজ্ঞাত কারণে আমার নাম বাদ দিয়ে অন্য এক জনকে দেয়া হয়। ১৯৯২ সালে শত ভাগ যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদেরকে মাসে দুই হাজার টাকা টেলিফোন বিল দেয়ার সিদ্ধান্ত হয় এবং তা দেয়া হচ্ছে। একই কারণে সেই তালিকায় আমার নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। ২০১৪ সাল থেকে টেলিটক কোম্পানী যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদেরকে মাসিক পাঁচশ (৫০০) টাকা করে টেলিফোন বিল দিচ্ছে। সেই তালিকায় আমার নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। একই বছর ঢাকার মোহাম্মদপুরে মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবন নির্মাণ করা হয়। বাংলাদেশে শত ভাগ যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আমিসহ ৯জন। ৮জন সেখানে বাড়ী বরাদ্ধ পেলেও অজ্ঞাত কারণে আজও আমি বাড়ী বরাদ্ধ পাইনি’।