মসজিদ মন্দির এতিমখানার জন্য বরাদ্দ চাল হরিলুট
প্রকাশিত হয়েছে : ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ৮:৫৬ অপরাহ্ণ
নিজস্ব প্রতিবেদক::
মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসকের জিআর চাল উপজেলা পর্যায়ে ত্রাণ কার্য উপ-বরাদ্দে হরিলুট হয়েছে। অস্তিত্বহীন মসজিদ মাদরাসার নামেও বরাদ্দ দেখানো হয়েছে। আবার অনেক প্রতিষ্ঠান জানেই না তাদের প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে জেলা প্রশাসকের বরাদ্দ ছিল। একটি চক্র বরাদ্দের টাকা আত্মসাৎ করেছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, এ অনিয়মের সাথে উপজেলা প্রকল্প কর্মকর্তা ও স্থানীয় চালের ডিলাররা জড়িত।
জেলা ত্রাণ ও পুণর্বাসন অফিস জানায়, মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসক এর অনূকুলে বরাদ্দপ্রাপ্ত সরকারি/বেসরকারি এতিমখানা, লিল্লাহ বোর্ডিং, অনাথ আশ্রম, বৃদ্ধাশ্রম ও সামাজিক কল্যাণে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানের অনুকুলে সদর উপজেলায় ৬২টি প্রতিষ্ঠানকে ১২৪ মেট্টিক টন, শ্রীমঙ্গল উপজেলায় ৮৬টি প্রতিষ্ঠানকে ১৭২ মেট্টিক টন, কুলাউড়া উপজেলায় ২৮টি প্রতিষ্ঠানকে ৫৬ মেট্টিক টন, কমলগঞ্জ উপজেলায় ১২৩টি প্রতিষ্ঠানকে ২৪৪ মেট্টিক টন, রাজনগর উপজেলায় ৫৫টি প্রতিষ্ঠানকে ১১০ মেট্টিক টন ও জুড়ী উপজেলায় ৫০টি প্রতিষ্ঠানকে ১০০ মেট্টিক টন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, উপজেলা পর্যায়ে চাল বিতরণে সাগর চুরি করেছেন সংশ্লিষ্টরা। ২ মেট্টিক টন চালের বিপরীতে কাউকে দেয়া হয়েছে ১০ হাজার আবার কাউকে ২০, ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা পর্যন্ত। অথচ তৎকালিন সময়ে বাজার মূল্য ছিল ৭০/৮০ হাজার টাকা।
সরেজমিন জেলার সদর উপজেলার পূর্ব খলিলপুর জামে মসজিদের সভাপতি হাজী আনর মিয়া বলেন, বক্কর মেম্বার এর মাধ্যমে উপজেলা থেকে ৫০ হাজার টাকা পেয়েছি। এসময় দেখেছি খলিলপুর বড় মসজিদকেও ৫০ হাজার টাকা দেয়া হয়েছে। বালিকান্দি মাদ্রাসা ও এতিমখানার প্রধান শিক্ষক শাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, আব্দুল্লাহ সাহেবের মাধ্যমে ৫৮ হাজার টাকা পেয়েছি। জামেয়া রহমানিয়া মাদরাসার অধ্যক্ষ জামিল আহমদ আনসারি বলেন, সম্প্রতি সময়ে কোন চাল ও অর্থ বরাদ্দ পাইনি। আমার প্রতিষ্ঠানের নাম যে তালিকায় আছে এটাও জানি না। প্রেমনগর চা বাগান গনেশ মন্দিরের পুরহিত কমলাশীষ বলেন, আমার মন্দিরে কোন চাল বরাদ্দ পাইনি। এবিষয়ে আমি জানি না। কোনটাকাও পাইনি। পশ্চিম আগনসি জামে মসজিদের মোতাওয়াল্লি আব্দুর রউফ বলেন, আমি টাকা পেয়েছি, উপজেলা থেকে ৬৭ হাজার টাকা দেয়া হয়েছে। শ্রীমঙ্গল উপজেলার সাগরদিঘীরপাড় হাফিজিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানার প্রিন্সিপাল আবুল কালাম ইউসুফ বলেন, মৌলভীবাজারের আমার এক উস্তাদ ফোন দিয়ে বলেন তোমার মাদ্রাসার নামে উপজেলা থেকে ২ টন চাল বরাদ্দ হয়েছে। এটা পেয়েছ কি-না? তখন পর্যন্ত আমি জানতাম না আমার মাদ্রাসার নামে বরাদ্দ হয়েছে। পরবর্তীতে উপজেলা মসজিদের ইমাম হাফেজ মাওলানা ফেরদাউস আহমদ জানালেন উপজেলা থেকে টাকা নেয়ার জন্য। টাকা আনতে উপজেলায় গেলে নগদ ২০ হাজার টাকা দেয়া হয়। এসময় আমি প্রশ্ন করলাম আমার মাদ্রাসার নামে তো ২ মেট্টিক টন চাল বরাদ্দ তাহলে ২০ হাজার টাকা কেন? উপজেলা মসজিদের ইমাম বলেন, উপর থেকে কমে আসতে আসতে এটা রয়েছে। ছওতুল হেরা নুরানী মাদ্রাসা ও এতিমখানার পরিচালক আব্দুর রাজ্জাক বলেন, আমার পরিচিত বদরুল আলম এর মাধ্যমে উপজেলা থেকে ১০ হাজার টাকা পেয়েছি। ২ মেট্টিক টন চাল বরাদ্দ ছিল এটা জানতামনা। আল আমিন মাদ্রাসা ও এতিমখানার ভাইস প্রিন্সিপাল মাওলানা আবুল কাশেম বলেন, আমার মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা আব্দুশ শাকুর সাহেব আমাকে ফোন দিয়ে বলেন জাতীয় পরিচয়পত্র ও ছবি নিয়ে উপজেলায় যাওয়ার জন্য। কাগজপত্র নিয়ে উপজেলায় গেলে মাদ্রাসার নামে নগদ ২০ হাজার টাকা দেয়া হয়। শংকরসেনা জামেয়া ইসলামিয়া হোসাইনিয়া কাওমিয়া মাদ্রাসার পরিচালক মো: কামাল মিয়া বলেন, শ্রীমঙ্গল শহরের চাল ব্যবসায়ী মোবারক মিয়ার কাছে ছবি ও ভোটার আইডি কার্ড দিলে তিনি ২০ হাজার টাকা দিয়ে বলেন, উপজেলা থেকে আপনার মাদ্রাসার নামে এ টাকা বরাদ্দ হয়েছে। টিকরিয়া বি-চক সুন্নিয়া হাফিজিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানার প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা আব্দুল আহাদ বলেন, বদরুল ইসলাম এর মাধ্যমে ৩০ হাজার টাকা পেয়েছি। আশিদ্রোণ জামিউল উলুম হাফিজিয়া মাদ্রাসার পরিচালক আব্দুল মালেক বলেন, চাল ব্যবসায়ী মোবারক হোসেন ফোন দিয়ে বলেন, সরকারিভাবে আপনার মাদ্রাসায় কিছু অনুদান এসেছে ছবি ও এনআইডি কার্ড জমা দিয়ে টাকা নিয়েন। পরবর্তীতে কাগজপত্র জমা দিয়ে উনার কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা পাই। তালিকায় নাম আছে কিন্তু প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি দক্ষিন মুসলিমাবাগ নূরে মদিনা জামে মসজিদ ও হেফজখানা, পূর্ব আশিদ্রোন লতিফিয়া হাফিজিয়া মাদ্রাসা-এতিমখানা, নূরে মদিনা হাফিজিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানা, বিরাইমপুর নূরানী মাদ্রাসা ও এতিমখানা এবং শ্রীমঙ্গল উপজেলা মসজিদেও হেফজখানা পাওয়া যায়নি। তালিকায় নাম আছে কিন্তু টাকা পায়নি রামনগর আল ইসলামিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানা, জালালিয়া রোড হাফিজিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানা এবং দক্ষিণ মুসলিমবাগ জামে মসজিদ ও হেফজখানা। কুলাউড়া উপজেলার দিলদারপুর হাফিজিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানার সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা রজব আলী বলেন, ৪৫ হাজার টাকা পেয়েছি। শ্রী শ্রী দূর্গা মন্দিরের সভাপতি নিত্য গোপাল চৌধুরী বলেন, ৫০ হাজার টাকা পেয়েছি। জুড়ী উপজেলায় জামেয়া ইসলামিয়া’র মোহতামিম মাওলানা তাফাজ্জুল হক বলেন, ৫০ হাজার টাকা পেয়েছি। রাজনগর উপজেলার বিচনকির্তী কিবরিয়া জামে সমজিদের মোতাওয়াল্লি সুলেমান মিয়া বলেন, এখন পর্যন্ত পাইনি। তবে চেয়ারম্যানের লোক অলিদ মিয়া বলেছেন আমাদের মসজিদের নামে ১টন চাল বরাদ্দ হয়েছে। কমলগঞ্জ উপজেলায় এখন পর্যন্ত বিতরণ করা হয়নি।
মৌলভীবাজার সদর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো. আজাদের রহমান বলেন, তালিকা জনপ্রতিনিধিরা তৈরী করেছেন, তারাই বিষয়টা জানেন কোন প্রতিষ্ঠানের কে কর্তৃপক্ষ। আমি বছরের শেষ কর্মদিবসে সব চাল বিতরণ করা হয়েছে।
জুড়ী উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, বরাদ্দ এসেছিল সেগুলো বিতরণ হয়েছে। আমি জুনের পরে এসে জয়েন করেছি। সব তথ্য জানা নেই।
জেলা ত্রাণ ও পুণর্বাসন কর্মকর্তা মো: ছাদু মিয়া বলেন, উপজেলা নির্বাহী অফিসারদের দেয়া তালিকার আলোকে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। অভিযোগ পেলে যাছাইবাছাই করা সম্ভব হতো। এ বরাদ্দের চাল কিস্তিতে কিস্তিতে বিতরণের বিধান আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, সরকারী নির্দেশনা হলো এক সাথে বিতরণ করা।
মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসক ড. উর্মি বিনতে সালাম বলেন, উপজেলা নির্বাহী অফিসারদের দেয়া তথ্যের আলোকে তালিকা চুড়ান্ত করা হয়েছে। আমি বিষয়টা খোঁজ নিয়ে দেখছি।