বিশ্ব পরিবেশ দিবস
গাছ পাখিদের পরম বন্ধু তারা
প্রকাশিত হয়েছে : ৫ জুন ২০২৩, ৭:৪৪ অপরাহ্ণ
কেউ হাওরের বুকে লাগিয়েছেন বৃক্ষ। কাউবা পথে পথে রোপন করেছেন তালের বীজ। আবার কেউতো নিজের বাড়িকে উসর্গ করে দিয়েছেন পাখিদের জন্য। হাওরের গাছ আর পাখি পরম বন্ধু হয়ে উঠেছেন তারা। মৌলভীবাজারের কাউয়াদিঘি আর হাকালুকি হাওরের তীরের জনপদে এমন চার প্রকৃতি দরদি ব্যক্তির খোঁজ মিলেছে। তারা হলেন শতাধিক তালগাছ রোপনকারী হাসিম মিয়া, পাখিপ্রেমি পঙ্কি মিয়া আর বৃক্ষপ্রেমী হাতিম মিয়া ও মোঃ এলাইছ মিয়া।
মৌলভীবাজার জেলা শহর থেকে কাউয়াদিঘী হাওরের দূরত্ব প্রায় ২০ কিলোমিটার। মৌলভীবাজার সদর উপজেলার হাওর পারের আখাইলকুরা ও একাটুনা ইউনিয়নের রায়পুর, জগৎপুর, কচুয়া গ্রামে রাস্তার দুইপাশে সাড়ি সাড়ি তালগাছ দাঁড়িয়ে আছে। প্রায় ২০ কিলোমিটার সড়ক জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে তালগাছগুলো। বড় গাছগুলোর কোনোটিতে তাল ধরছে। সেসব গাছ থেকে অনেকেই বিক্রির জন্য কচি অবস্থাতেই তালের শাঁস কেটে নিয়ে যান। পাকা তাল কুড়িয়ে নেন আশপাশের লোকজন। আবার কাছাকাছি সময়ের গাছও আছে। যেগুলো মাত্র কয়েক বছরের। ৪-৫ ফুট উচ্চতায় পাতা ছড়িয়ে মাথা তুলছে আকাশের দিকে। গ্রামীণ সড়কের দুপাশে প্রায় ৫০ বছর আগে তালবীজ রোপণ করেছিলেন বৃক্ষপ্রেমী হাসিম মিয়া। তিনি অসুস্থ ও বয়সের ভারে নুইয়ে পড়লেও তালগাছগুলো ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। কোনো কোনোটিতে আবার তালও ধরছে। বছর দুই-তিন ধরে অসুস্থ থাকায় আর আগের মতো তালবীজ রোপণ করতে পারেন না হাসিম মিয়া।
হাসিমের স্ত্রী সুরমা বেগম জানান, তাদের বিয়ের আগে থেকেই হাসিম মিয়া তালের বীজ রোপণ শুরু করেছেন। এটা শুরু হয়েছিল হাসিম মিয়ার মামার বাড়ি থেকে। মামার বাড়িতে অনেকগুলো তালগাছ ছিল। ভাদ্র মাসে তাল পাকলে সেখান থেকে তিনি তালের বীজ নিয়ে আসতেন। একাটুনা বাজারে ব্যাংকের কাজ, কেনাকাটাসহ নানা কাজে যেতেন। যাওয়ার সময় ব্যাগে করে তালের বীজ নিয়ে যেতেন। পাঁচ বছর আগে হাসিম মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের কারণে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এর আগ পর্যন্ত তিনি ধারাবাহিক এ তালবীজ রোপণ করেছেন। তবে শুধু তালগাছই নয়, বাড়িতে অন্যান্য ধরনের গাছও লাগিয়েছেন তিনি।
কাউয়াদিঘি হাওরের পূর্বকোনের গ্রাম কাগজি বাড়ি। শত বছর ধরে হাওরের বুকে দাঁড়িয়ে আছে এক আমগাছ। রোদ, ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে শত বছর ধরে পথিক, কৃষককে ছায়া ও ফল দিয়ে প্রকৃতির শোভাবর্ধন করে চলেছে। অন্য সঙ্গী-সাথীদের হারিয়ে শুধু আমগাছটি টিকে আছে কালের সাক্ষী হয়ে। হাতিম মিয়া নামে এক কৃষক গাছটি লাগিয়ে ছিলেন। তিনি প্রায় ১০০ বছর বয়সে মারা গেছেন। তাও প্রায় ৩০ বছর আগে। অথচ আজও কৃষক, পথিককে ছায়া দিয়ে যাচ্ছে তার লাগানো সবুজ ছাতা।
স্থানীয়রা জানান, কাউয়াদীঘি হাওরের বুকে শত বছর আগে লাঙল দিয়ে আমনের জমিতে চাষ দিচ্ছিলেন অল্প বয়সী এক কৃষক। সারা শরীর তার রোদে পোড়ে। কোথাও একটুখানি ছায়া নেই। না আছে আকাশে ভেসে বেড়ানো মেঘ, না আছে কোনো গাছ। কৃষকটি মনে মনে ঠিক করলেন, এই খোলা প্রান্তরে গাছ রোপণ করবেন। সেই গাছের ছায়ায় বসে একটুখানি জিড়িয়ে নেবেন কৃষক, জেলে ও রাখাল। একদিন আমগাছের কয়েকটি চারা পুঁতে দিলেন উঁচু ভিটায়। তার পুঁতে দেওয়া সেই গাছের চারা হাওরের ঝড়ো বাতাস সামলে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে।
গ্রামের কৃষক আলমগীর বলেন, শত শত বছর আগে জমি চাষ করতে গিয়ে রোদে ধরেছিলে কৃষক হাতিম মিয়ার। কোনো ছায়া ছিল না। তাই এই গাছ রোপণ করেন। আজ এই গাছের নিচে বসে এখন আমরা ছায়া পাই। আমাদের ছাতা হিসেবে কাজ করে। গাছটি এখনো সজীব প্রাণ। প্রতিবছরই আম ধরে।
কাগজি বাড়ি গ্রামের পাশ^বর্তী গ্রাম বিরইমাবাদ। সেই গ্রামে সবুজ শ্যামল জীববৈচিত্রে ভরা বিশাল জলাধার কাউয়াদিঘি হাওড় এলাকার পঙ্কি মিয়ার বাড়িটি হাজারো পাখির নিরাপদ আশ্রয়ে পরিণত হয়েছে। হাওড়ের বিভিন্ন প্রজাতির পাখিরা এখানে গড়ে তুলেছে তাদের আপন ঠিকানা। হাওর পাড়ের বাড়ি ভর্তি গাছগাছালি। গাছের ডালে ডালে হরেক রকমের হাজারো পাখি। ধবল বক আর কালো রঙের পানকৌড়ির সরব উপস্থিতি জানান দেয় গাছে গাছে সংসার পেতেছে তারা। চারদিকে শুধু পাখি আর পাখি। তারা ঝাঁকেঝাঁকে উড়ে বেড়াচ্ছে। নিশ্চিন্ত মনে করছে খুনসুটি। এ যেনো পাখিদের আপন ঠিকানা হয়ে উঠেছে হাওড়পাড়ের এই বাড়িটি। সবচেয়ে বেশি দেখা মেলে সাদা বক আর পানকৌড়ির। আছে ঘুঘু, শালিক, শামুকখোলসহ অসংখ্য পাখি। হাওর ঘেঁষা পঙ্কি মিয়ার বাড়িটি যেন এক পাখিরাজ্য। আম, জাম, কাঁঠাল, নারকেল, সুপারি গাছ আর বাঁশঝাড় জুড়ে চেনা-অচেনা হাজারো পাখির বাস সেখানে। ওই পাখিদের কলতানে মুখরিত এ বাড়িতে আসলে যে কারো মনে আসবে প্রশান্তি।
পঙ্কি মিয়া বলেন, ১৫ বছর পূর্বে কয়েকটি পানকৌড়ি, শামুকখোল প্রথমে তার বাড়িতে বাসা বাঁধে। তারপর থেকে ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে পাখির সংখ্যা। এভাবেই এখন বাড়িটিতে ঠাঁই নিয়েছে প্রায় অর্ধ লক্ষাধিক পাখি। আমার বাড়িতে সারা বছরই বক, পানকৌড়ি, ঘুঘু, শালিক, শামুকখোলসহ নাম না-জানা অসংখ্য পাখি থাকে। তবে পৌষের শেষে পাখির সংখ্যা বাড়তে থাকে যা আষাঢ় মাস পর্যন্ত চলতে থাকে। এরই মধ্যে তারা ডিম দেয়, বাচ্চা ফোটায়। বর্ষা শুরু হলে বাচ্চাসহ মা পাখিরা বাড়ি ছেড়ে হাওড়ে পাড়ি জমায়। তবে ঘুঘু, শালিকসহ অন্যসব পাখি বাড়িতেই থেকে যায়।
দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম হাওর হাকালুকি। তীব্র রোধে কিংবা ঝড়ে কৃষকদের চরম দূর্ভোগ পুহাতে হয়। বোরো মৌসুমে ধান কাটার সময় গ্রীষ্মকালের রোধে কৃষকরা দিশেহারা হয়ে পড়েন। কিছু সময়ের জন্য ছায়াতে আশ্রয় নেয়ার জন্য কোনো জায়গা ছিলনা সেই বৃহত্তম হাওরে। হাকালুকি হাওরের চালিয়া এলাকায় ২০১৩ সালে একটি করচ গাছ রোপন করেন মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার বাদে ভুকশিমইল গ্রামের মোঃ এলাইছ মিয়া। গাছ রোপনের পর থেকে এটিকে বাঁচানোর জন্য সকাল বিকাল পানি দিয়েছেন তিনি। হাওর বছরের অর্ধেক সময় পানিতে থৈ থৈ থাকে। বৃক্ষ প্রেমি হাজী মোঃ এলাইছ মিয়া’র নিবিড় তত্ত্ববধানে এবং পরিশ্রম করে তিনি এই গাছটি বড় করেন। মোঃ এলাইছ মিয়া পরবর্তীতে হাওরে আরও ৫টি করছ ও হিজল গাছ রোপন করেন।
বৃক্ষরোপনকারী হাজী মোঃ এলাইছ মিয়া বলেন, বাড়ি থেকে টলি দিয়ে গাছটি এখানে এনে রোপন করেছি। দিন ও রাতে গাছে পানি দিয়েছি। যার কারণে গাছটি জীবিত হয়ে ঢাল-ফালা দেয়। প্রতিদিন শতশত কৃষক গাছের ছায়াতে বসছেন। এটাই আমার সফলতা।
হাওড় রক্ষা সংগ্রাম কমিটি মৌলভীবাজার সদর উপজেলার সাধারণ সম্পাদক রাজন আহমদ বলেন, হাওড়াঞ্চলের বসতবাড়িতে যারা পাখিদের নিরাপদ আশ্রয় দিয়েছেন। যারা নিজের টাকা খরচ করে পরিবেশ রক্ষায় কাজ করেছেন। নিজে হেঁটে হেঁটে গাছ লাগিয়ে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার কাজ করেছেন, তারাইতো প্রকৃত পরিবেশকর্মী। তাদেরকে যদি যদি সরকার পুরস্কৃত করেন, তবে ভবিষ্যতে পরিবেশ সুরক্ষায় সাধারণ মানুষ উৎসাহিত হবেন।
বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ মৌলভীবাজারের বিভাগীয় কর্মকর্তা মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, পাখিরা নিজেদের যেখানে নিরাপদ মনে করবে তারা সেখানেই যাবে। যারা পাখিদের ভালবেসে নিরাপদ বসবাসের সুযোগ দিয়েছেন তারা পরিবেশ ও পাখিবান্ধব মানুষ। যারা কষ্ট করে নিজে উদ্দমী হয়ে গাছ লাগিয়েছেন তারাও বৃক্ষপ্রেমি।
পরিবেশ অধিদপ্তর মৌলভীবাজারের সহকারী পরিচালক মোঃ মাঈদুল ইসলাম বলেন, যারা পরিবেশে সুরক্ষার জন্য গাছ লাগিয়েছেন এটা খুবই ভালো উদ্যোগ। সামাজিক ও মহৎ কাজে এভাবে সবাইকে এগিয়ে আসা উচিত।