টানা ছুটিতে শ্রীমঙ্গলে পর্যটকের ঢল, তিল ধারণের ঠাঁয় নেই হোটেল রিসোর্টে!
প্রকাশিত হয়েছে : ২৩ ডিসেম্বর ২০২২, ৯:৩০ অপরাহ্ণ
নিজস্ব প্রতিবেদক::
বড়দিনের ছুটিসহ টানা তিনদিনের ছুটিতে পর্যটকদের ঢল নেমেছে চায়ের রাজধানী খ্যাত দেশের অন্যতম পর্যটন এলাকা মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে। ধারণ ক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত পর্যটক আসায় তিল ধারণের ঠাঁয় নেই এখানকার হোটেল-রির্সোটেগুলোতে।
শুক্রবার সরেজমিনে বেশ কিছু দর্শণীয় স্থান ঘুরে দেখা যায়, দল বেঁধে পর্যটকরা প্রকৃতির সাথে মিশে ঘুরাঘুরি করছেন এবং ছবি তুলছেন। এসময় কয়েকজন বিদেশি পর্যটককেও দেখা গেছে এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে।
জানা যায়, প্রতি বছর শীতের শুরু থেকেই এখানে বিপুল সংখ্যক পর্যটকের আগমন ঘটে। একদিকে পর্যটন মৌসুম আর অন্যদিকে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের বড়দিনকে কেন্দ্র করে সরকারী বাড়তি একদিন ছুটি যুক্ত হওয়ায় সারা দেশের সকল পর্যটন এলাকাতেই ছুঠছেন ভ্রমন পিপাসুরা। ব্যতিক্রম ঘটেনি চায়ের রাজ্যেও।
পর্যটন সংশ্লীষ্টরা জানান, সিলেট অ লে বেড়াতে আসা পর্যটকদের প্রথম পছন্দই হচ্ছে শ্রীমঙ্গল। ৯০ শতাংশ পর্যটক’ই শ্রীমঙ্গলের হোটেল-রিসোর্টে রাত্রী যাপন করে থাকেন। বাকি ১০ শতাংশ পর্যটক জেলা সদরসহ অন্যান্য উপজেলায় অবস্থান করে থাকেন। তারা এখানে অবস্থান করে পূরো জেলার দর্শণীয় স্থান দর্শনের পাশাপাশি সিলেটের বিভিন্ন পর্যটন আকর্ষনীয় স্থান ঘুরে বেড়ান এবং জেলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করেন।
শ্রীমঙ্গলের আবাসন সংস্থা জানায়, বড়দিন উপলক্ষে পাওয়া ছুটিতে ইতিমধ্যে শ্রীমঙ্গলের হোটেল-রিসোর্টে কক্ষ ৯০-৯৫% রিজার্ভ হয়ে গেছে। গত (২২ ডিসেম্বর) বৃহস্পতিবার থেকেই হোটেল রিসোর্টগুলোতে পর্যটকরা অবস্থান করছেন। তারা আরো জানান যে কোন ছুটিতে’ই পর্যটকদের ভিড় থাকে চায়ের রাজধানী খ্যাত শ্রীমঙ্গলে। সবুজ গালিচা চা বাগান আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে পর্যটকের জন্য অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান শ্রীমঙ্গল।
এখানে যেসব এলাকা পর্যটকরা ঘুরে দেখেন তা হলো, শ্রীমঙ্গলের হাইল হাওরের বাইক্কা বিল, উঁচু-নিচু পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে সবুজের গালিচায় মোড়ানো চা-বাগান, খাসিয়া পুঞ্জি, মণিপুরি ও ত্রিপুরাদের গ্রাম, বন্যপ্রাণী সেবা ফাউন্ডেশন, বধ্যভূমি ৭১, শংকর টিলা লেক, ভাউাউড়া লেক, জাগছড়া লেক, ফুলছড়া গারো লাইনের লেক, নিমাই শিববাড়ী, শ্রীমঙ্গল শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে ফিনলে চা বাগানের ভেতরে ডিনস্টন সিমেট্রি, হরিণছড়া গলফ মাঠ, হরিণছড়া তীর্থ স্থান, হরিণ ছড়া ঝাউবন, বিদ্যাবিল হজম টিলা, নাহারপুঞ্জিতে শতবর্ষ গিরীখাত ও লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান।
কমলগঞ্জের মাধবপুর লেক, ধলই চা বাগানে বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের স্মৃতিসৌধ, খাসিয়া পল্লী, হাম হাম জলপ্রপাত, কলাবন, বড়লেখার মাধবকুন্ড জলপ্রপাত, হাকালুকি হাওর। রাজনগরের কমলা রাণীর দীঘি, কাউয়াদীঘি হাওর, জলের গ্রাম অন্তেহরি।
এছাড়া মৌলভীবাজার সদরে ৫০০ বছরের প্রাচীন স্থাপত্যের খোজার মসজিদ, বর্ষিজোড়া ইকো পার্ক। জুড়ীর সারি সারি কমলা ও আগরের বাগানসহ লাঠিটিলা সংরক্ষিত বন। কুলাউড়া উপজেলার গগনটিলা, কালাপাহাড়, মূরইছড়া ছড়া ইকো পার্ক ইত্যাদি।
জানা যায়, মৌলভীবাজার দুসাই রিসোর্ট এন্ড স্পা, রাঙ্গাউটি রিসোর্ট, বর্ষিজোড়া বাগান বিলাস রিসোর্ট, শ্রীমঙ্গল রাধানগর গ্র্যান্ড সুলতান টি রিসোর্ট এন্ড গলফ, চা বোর্ডের টি রিসোর্ট এন্ড মিউজিয়াম, টি হ্যাভেন, লেমন গার্ডেন, বালিশিরা রিসোর্ট, নবেম রিসোর্ট, গ্র্যান্ড সেলিম রিসোর্ট, হীড বাংলাদেশসহ এখানে প্রায় শতাধিক হোটেল, রিসোর্ট ও কটেজ রয়েছে।
লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের টিকেট কাউন্টার ম্যানেজার শাহিন মাহমুদ জানান, শুক্রবার সকাল নয়টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত বার শতাধিক পর্যটক টিকিট কেটে লাউয়াছড়া বনে ভেতরে প্রবেশ করেছেন। দেশিয় পর্যটকের পাশাপাশি কয়েকজন বিদেশি পর্যটকও রয়েছেন।
শ্রীমঙ্গল পর্যটন সেবা সংস্থার সাধারণ সম্পাদক সামছুল হক বলেন, মৌলভীবাজার জেলায় অনেকগুলো দর্শনীয় স্থান থাকায় যেকোনো ছুটি কিংবা উৎসবে প্রচুর পর্যটকের আগমন ঘটে এখানে। মৌললভীবাজার জেলায় আগত পর্যটকদের বড় অংশ রাত্রীযাপনের জন্য শ্রীমঙ্গলকে বেচে নেন।
তিনি আরও বলেন, গত বৃহস্পতিবার থেকেই বিপুল সংখ্যক পর্যটকের আগমন ঘটেছে। এছাড়া আগামী ৩১ডিসেম্বর পর্যন্ত শ্রীমঙ্গল হোটেল-রিসোর্টে আগাম বুকিং হয়ে গেছে ৯০% পারসেন্ট।
শ্রীমঙ্গলের হোটেল-রিসোর্টেও ভাড়া বেশি হওয়ায় পর্যটকরা নানা বিড়ম্বনায় পড়েন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, হোটেলের মান অনুযায়ী ভাড়া নিধারণ করেন হোটেল রিসোর্ট কর্তৃপক্ষ। আবার কিছু ব্যবসায়ী আছেন মান অনুযায়ী সেবা দেওয়া হয় না বরং বেশি টাকা নিয়ে থাকে। আমরা সেদিকে নজর দিচ্ছি যাহাতে পর্যটকরা প্রতারিত না হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পর্যটন-সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যবসায়ী বলেন, ২০০৮ সাল পর্যটন জেলা মৌলভীবাজার হিসেবে ঘোষণা হওয়ার পর থেকে চাহিদা অনুযায়ী আবাসন গড়ে উঠেনি। রাস্তাঘাটের তেমন কোন উন্নয়ন হয়নি। এ পর্যন্ত যে অবকাঠামো গড়ে উঠেছে, তার বেশির ভাগই করেছেন পর্যটন ব্যবসায়ীরা। সরকারি কর্মকর্তা ও জন প্রতিনিধিরা সব সময় উন্নয়নের গল্প শোনান। কিন্তু বাস্তবে তার কিছুই হচ্ছে না।
চা বোর্ডের নিয়ন্ত্রণধীন টি রিসোর্ট এর ব্যবস্থাপক শামসুদোহা বলেন, পুরো রিসোর্ট বুকিং হয়ে গেছে। এই মাসে কোন রুম খালি নেই।
গ্র্যান্ড সুলতান টি রিসোর্ট অ্যান্ড গলফ’র নির্বাহী অফিসার দিশারী বলেন, বড়দিনের ছুটিতে ইতিমধ্যে আমাদের রিসোর্ট হাউসফুল বুকিং হয়ে গেছে।
শ্রীমঙ্গল জোনের ট্যুরিষ্ট পুলিশের ইন্সপেক্টর প্রদীপ কুমার চক্রবর্তী বলেন, পর্যকদের নিরাপত্তা দিতে প্রত্যেকটা স্পটেই আমাদের লোক নিয়োজিত আছে। এছাড়া মোবাইল টিমসহ বিভিন্ন স্পটে স্পটে পর্যটকদের সার্বিক নিরাপত্তা প্রদানে আমি নিজেও মাঠে কাজ করছি।’
শ্রীমঙ্গলস্থ ‘টি ভ্যালীর রেস্টুরেন্ট’র ডিরেক্ট ও স্মার্ট ট্যুরিজমের সত্ত্বাধিকারী স্থানীয় সাংবাদিক এম এ রকিব বলেন, পর্যটকদের সেবা প্রদানে আমরা প্রস্তুত আছি। আমাদের রেস্টুরেন্টে মান সম্পন্ন খাবার পরিবেশনের পাশাপাশি আগত পর্যটকরা যাতে ভোগান্তিতে না পড়েন, সেজন্য হোটেল রিজার্ভেশন, গাইড সার্ভিস ও রেন্ট এ কার এর ব্যাপারে সার্বিক সহযোগিতা করতে আমাদেও কর্মকর্তাদেও নির্দেম প্রদান করা হয়েছে।’
লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে নিয়োজিত সিনিয়র ট্যুর গাইড সৈয়দ রিজভী ও সোলেমান হাসিব বলেন, দেশি পর্যটক আসতে শুরু করেছে। তবে বিদেশি পর্যটক কম আসছেন।
তিনি বলেন, ২/৩জন বিদেশি পর্যটকের দেখা মেলেছে শুক্রবারে।’
পর্যটন সেবা সংস্থার সভাপতি সেলিম আহমেদ বলেন, টানা তিন দিনের ছুটিতে যথেষ্ট পরিমান পর্যটক আসছেন। এছাড়া শীতের সময় এমনিতেই পর্যটক বেশি থাকে। বিভিন্ন উৎসবে যে পরিমান পর্যটক আসেন সে পরিমান থাকার হোটেল রিসোর্ট এখানে নেই। বেসরকারীভাবে যেসব অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে সে তুলনায় সরকারী ভাবে তেমন কিছু’ই গড়ে উঠেনি।
তিনি সরকারের কাছে দাবী জানান, সরকারীভাবে যদি আর্থিক সহযোগিতা বা সহজে ব্যাংক লোনের ব্যবস্থা করা হয় তাহলে আমাদের আরো নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি হবে এবং আমরা আরো সুন্দরভাবে সাজাতে পারবো।
মৌলভীবাজার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জাকারিয়া বলেন, পর্যটকদের হয়রানি কমাতে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। জেলার প্রতিটি পর্যটন স্পটে ট্যুরিস্ট পুলিশের পাশাপাশি সাদা পোশাকে বিশেষ নিরাপত্তাব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসান বলেন, ট্যুরিজম বোর্ড এবং পর্যটন মন্ত্রনালয়ের সাথে আমরা যোগাযোগ করেছি, একটা সম্বনিত জায়গা তৈরী হয়েছে, ট্যুরিষ্টদের জন্য চমৎকার একটা পর্যটন স্পট আমরা সবগুলো ক্ষেত্রে উপহার দিতে পারি।’