অতিরিক্ত কীটনাশকে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে চা বাগানের
প্রকাশিত হয়েছে : ৫ ডিসেম্বর ২০২১, ১১:০২ অপরাহ্ণ
মোঃ হাসান আহমদ::
চা বাগান ও কৃষি চাষাবাদে পোকা ও আগাছা দমনের জন্য মাত্রা অতিরিক্ত এবং অপরিকল্পিতভাবে ক্ষতিকর কীটনাশক ও রাসায়নিক সার প্রয়োগ করা হচ্ছে। এসব কীটনাশক আশপাশের নদী কিংবা জলাভূমিতে মিশে মারা যাচ্ছে মাছ, ব্যাঙ ও সাপসহ অন্যান্য জলজ প্রাণী।
এক হিসেবে জানা গেছে, প্রতি বছর দেশের চা বাগানগুলো অকারণে প্রায় ৫০ লাখ লিটার তরল কীটনাশক, চার লাখ মেট্রিক টন রাসায়নিক সার মাটি ও পানিতে মিশছে।
কীটনাশক ও রাসায়নিক সারের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে এবং তা থেকে নিজেকে সুরক্ষিত রাখার জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি চা বাগান কর্তৃপক্ষ সরবরাহ্ না করায় চা শ্রমিকরা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে অকালে মারা যাচ্ছেন।
দেশের ছোট বড় ২০৬টি ছোট বড় চা বাগানে এসব কীটনাশক প্রয়োগ করা হচ্ছে। এর মধ্যে সিলেট, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজারে রয়েছে প্রায় ১৮৩টি চা বাগান।
চা বাগানগুলোতে কীটনাশক উডিসাইড, মেলাথিয়ন, ইথিয়ন, কাপরাভিট সহ বিভিন্ন কীটনাশক এবং ইউরিয়া জিংকসহ অন্যান্য সার ব্যবহার হচ্ছে অবাধে। চা শ্রমিকের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে নির্বিচারে শ্রমিকদের দিয়ে অপরিকল্পিতভাবে এসব কীটনাশক ব্যবহার করাচ্ছে চা বাগান কর্তৃপক্ষ।
যে সমস্থ চা শ্রমিকরা কীটনাশক ছড়ানোর কাজে নিয়োজিত তাদের মুখোশ, চশমা, গ্লাভস, গাউন, বুট জোতা, মাস্ক এবং টুপিসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় প্রতিরোধী সরঞ্জাম সরবরাহ করা হয় না।
ফলে শ্বাসকষ্ট পেটের পীড়া, চর্ম রোগ, হাঁপানীসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন চা শ্রমিকরা। এমনকি দীর্ঘ মেয়াদে এসব কাজ করার ফলে পুষ্টিহীনতাসহ মরণব্যাধি ক্যান্সারেও আক্রান্ত হচ্ছেন তারা। এছাড়া কীটনাশক সহজলভ্য হওয়ায় চা বাগানগুলোতে শ্রমিকদের মাঝে আত্মহত্যার প্রবণতাও লক্ষ করা যায়।
আবার চা বাগানে ব্যবহার করা কীটনাশক বৃষ্টির পানির মাধ্যমে নদী ও ছড়ায় গিয়ে পড়ছে। সেখান থেকে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে হাওর ও বড় বড় নদীতে। এতে মুক্ত জলাশয়ের মাছসহ অন্যান্য জলজ প্রাণী বৈচিত্র্য বিলীন হয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি মাত্রাতিরিক্তভাবে টিলাভূমি ও কৃষিজমিতে কীটনাশক ও রাসায়নিক সার ব্যবহারে এই অঞ্চলের মাটির গুণাগুণ দিন দিন বিনষ্ট হচ্ছে।
এ পরিস্থিতিতে চা বাগানে অবৈজ্ঞানিক ভাবে এভাবে কীটনাশক প্রয়োগ এ অঞ্চলের পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যে কী ধরণের ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে তা নিয়ে গবেষণা জরুরি বলে মনে করছেন পরিবেশবীদরা।
ক্ষতিকর বিষয়টি বর্ণনা বরতে গিয়ে চা শ্রমিক নাইডু, বিরাম এবং সিতা রাণী বলেন, কীটনাশক স্প্রে করার পর তাদের মাথা ঘোরে, চোখে জ্বলে, পিঠ ব্যথা, শরীর ও হাত-পায়ে চুলকানি হয়ে ঘা হয়ে যায়। খাওয়ার রুচি কমে যায় কোনও কিছু খেতে ইচ্ছা হয় না।
চা শ্রমিক নেতা রবি দাশ বলেন, প্রতি বছর বাগান ম্যানেজমেন্টের সাথে এ নিয়ে তাদের বাদানুবাদ হয়। কখনো কখনো প্রয়োজনের তুলনায় খুবই সামান্য কিছু সরঞ্জাম কর্তৃপক্ষ সরবরাহ করে। কিন্তু সেখানেও সব জিনিসের পরিপূর্ণতা থাকে না।
পরিবেশবাদী সাংবাদিক রিপন দে বলেন, চা বাগানে কীটনাশক ব্যবহারের কারণে চা শ্রমিকরা যেভাবে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে, তেমনি বৃষ্টির পানি বাহিত হয়ে নদীনালা খালবিলে ডোবা ও পুকুরে কীটনাশক ছড়িয়ে পড়ায় মাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধি হ্রাস পাচ্ছে। চা শ্রমিকদের গ্লাভস, চশমা, মুখোস, গাউন, বুট, টুপি জরুরি ভিত্তিতে সরবরাহ করা আবশ্যক বলেও জানান তিনি।
২৫০ শয্যা মৌলভীবাজার সদর হাসপাতাল তত্ত্বাবধায়ক ডা: বীরেন্দ্র ভৌমিক বলেন, যেভাবে চা বাগানে উডি সাইড, রাউন্ড আপ, মেলাথিয়ন, ইথিয়ন, ড্রাগ, কাপরাভিট, ইউরিয়া, জিংকসহ নানাবিধ কীটনাশক ও রাসায়নিক সার ব্যবহার হচ্ছে তাতে করে চা শ্রমিকদের রক্ত দূষণ শ্বাসকষ্ট, চোখ নষ্ট হয়ে যাওয়া, কিডনি, হার্ট ডিজিজ, চর্মরোগসহ নানারোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এমনকি ব্লাড ক্যান্সার হওয়ারও সম্ভাবনা থাকে। তাদেরকে সচেতন করে গড়ে তুলতে হবে। এগুলো ব্যবহার থেকে আমাদের বিরত থাকা জরুরি।