মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১০টি বিশেষ উদ্যোগ এবং রূপকল্প ২০২১ ও রূপকল্প ২০৪১
প্রকাশিত হয়েছে : ১৪ ডিসেম্বর ২০১৯, ৭:০৮ অপরাহ্ণ
খায়রুন নাহার
ভূমিকা :
স্বাধীনতার ছেছল্লিশ বছর পর বাংলাদেশ আজ যেখানটায় দাঁড়িয়ে আছে তা উন্নয়নের এক উর্বর ভূমি। একজন রিকশা শ্রমিক এখন তার উপার্জনে তিন বেলা খেয়ে-পরে ভালোভাবে দিনাতিপাত করতে পারছে। গ্রামেগঞ্জে আজকাল আর যেনতেন কাজের জন্যে শ্রমিক পাওয়া যায় না। কারণ ইচ্ছে করলেই তারা অধিক পারিশ্রমিকের কাজ পেয়ে যাচ্ছে। গ্রামেও এখন পণ্য উৎপাদনের অনেক উদ্যোক্তা গড়ে উঠেছে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে তথ্য প্রযুক্তির অপার সুবিধা। ডিজিটাল বাংলাদেশের এক স্বপ্নীল ছোঁয়ায় সরকারি সব সেবা পৌঁছে গেছে মানুষের দোরগোড়ায়। স্বাধীনতার সময় বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু গড় আয় ছিল মাত্র ১২৯ মার্কিন ডলার। বর্তমানে তা সাড়ে ১২ গুণ বেড়ে মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে ১৬১০ মার্কিন ডলারে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ছিল ৪৭ বছর। আজ আমাদের গড় আয়ু ৭১ বছর ৬ মাস। যে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়েছি সেখানে সে সময়ে কোন নারী শিক্ষক ছিলেন না। আজ সে স্কুলে একজনও পুরুষ শিক্ষক নেই। বাংলাদেশের প্রথম বাজেটের আকার ছিল ৭শ ৮৬ কোটি টাকা। আর আজ ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকা, যা প্রথম বাজেটের প্রায় ৫০০ গুণ বেশি। হঠাৎ করে কোন অদৃশ্য যাদুমন্ত্রে এমন করে বদলে যায়নি সবকিছু। গভীর দেশপ্রেম আর দেশের জন্যে উজাড় করে দেয়া ভালবাসায় তৈরি হয়েছে এমন অসাধারণ পরিবর্তনের গল্পগুলো। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একান্তই নিজস্ব চিন্তাপ্রসূত ১০টি বিশেষ উদ্যোগ, রূপকল্প ২০২১ ও রূপকল্প ২০৪১-এর মতো অভাবনীয় পরিকল্পনাগুলো বাংলাদেশকে এনে দাঁড় করিয়েছে উন্নত রাষ্ট্রের এক স্বপ্ন যাত্রায়।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ উদ্যোগ, রূপকল্প ২০২১ ও রূপকল্প ২০৪১
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ইশতেহারে ডিজিটাল বাংলাদেশ শিরোনামে ‘রূপকল্প- ২০২১’ এবং ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ‘এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ’ শিরোনামে রূপকল্প- ২০৪১’ ঘোষণা করেন। রূপকল্প ২০২১ এর মূল লক্ষ্য ছিল -দারিদ্র কমিয়ে মধ্যম আয়ের দেশে নিয়ে যাওয়া, শিশু ও মাতৃমৃত্যু কমানো, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা আনয়ন, শিক্ষা ও স্যানিটেশনে উন্নয়ন, নারীর সমঅধিকার, আইনের শাসন, মানবাধিকার, সুশাসন ও দুষণমুক্ত পরিবেশ। সুনির্দিষ্টভাবে ২০২১ সালের মধ্যে ২০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন, সকলের জন্যে আবাসন, দারিদ্র ও বেকারত্বের হার ১৫ শতাংশে নামিয়ে আনার পরিকল্পনা নেয়া হয় এ সময়। রূপকল্প ২০৪১ এর মূল লক্ষ্য হচ্ছে আগামী ২৩ বছরের মধ্যে দেশকে উন্নত দেশের কাতারে নিয়ে যাওয়া। ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশ গড়ার প্রতিশ্রæতি এবং সরকারের করণীয় সম্পর্কে বিস্তারিত বলা হয়েছে এই পরিকল্পনায়। দারিদ্র বিলোপের পাশাপাশি কারিগরি ও জ্ঞানসম্পন্ন মানবসম্পদ গঠন, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও যোগাযোগ খাতের অবকাঠামোগত উন্নয়নের উপর জোর দেয়া হয়েছে। ২০১৪ সালে সরকার গঠনের পর দেশের সকল মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি বাড়ি একটি খামার, আশ্রয়ণ, ডিজিটাল বাংলাদেশ, শিক্ষা সহায়তা কর্মসূচি, নারীর ক্ষমতায়ন, ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ, কমিউনিটি ক্লিনিক, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি, বিনিয়োগ বিকাশ ও পরিবেশ সুরক্ষা-এই শিরোনামে যে ১০টি উদ্যোগ নেন তা যেন দেশের দারিদ্র ও বৈষম্যমুক্ত সমৃদ্ধির এক পথনকশা।
উদ্যোগ- ১ : একটি বাড়ি একটি খামার ও পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক
‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্পের মাধ্যমে গৃহীত কর্মসূচি এখন প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে একটি বিপ্লবে পরিণত হয়েছে। ২০০৯ সাল থেকে শুরু হওয়া এই প্রকল্প বিশ্বে সরকারী উদ্যোগে দারিদ্রমুক্তির প্রথম মহাপরিকল্পনা বলে বিবেচিত হচ্ছে।
প্রথম পর্যায়ে প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের ৬৪টি জেলার ৪৮৩টি উপজেলার ১৯৩২টি ইউনিয়নে ১৭৩০০টি সমিতি গঠন করে ১০ লক্ষ ৩৮ হাজার পরিবারকে স্বাবলম্বী করে তোলা হয়। জুলাই ২০১৩ থেকে দেশের ৪৫০৩টি ইউনিয়নের অতিরিক্ত ২৩১৩৯টি গ্রামসহ মোট ৪০৫২৭টি গ্রামকে প্রকল্পের আওতায় আনা হয়েছে।
উদ্যোগ- ২ : আশ্রয়ণ প্রকল্প
১৯৯৭ সালের ১৯ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘূর্ণিঝড়ে আক্রান্ত কক্সবাজার ও পার্শ্ববর্তী এলাকা পরিদর্শনে গিয়ে দেখতে পান অসংখ্য পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়েছে। তাদের দুঃখ-দুর্দশা থেকে মুক্ত করতে তিনি বঙ্গবন্ধু প্রবর্তিত ‘গুচ্ছগ্রাম’ এর আদলে ‘আশ্রয়ণ’ প্রকল্প গ্রহণ করে সকল গৃহহীন পরিবারকে পুনর্বাসনের তাৎক্ষণিক নির্দেশ দেন। প্রকল্পের আওতায় ১৯৯৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৩টি পর্যায়ে ১৯০৪.১০ কোটি টাকা ব্যয়ে আয়বর্ধক কর্মকান্ডের জন্য প্রশিক্ষণ প্রদান ও ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণসহ নানান কর্মসূচির মাধ্যমে ১,৪৩,২২৩টি পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে।
উদ্যোগ- ৩ : ডিজিটাল বাংলাদেশ
ইতোমধ্যে ৫২৭৫টি ডিজিটাল সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে, যেখান থেকে প্রায় ২০০টি সেবা প্রদান করা হচ্ছে। ২৫০০০ ওয়েবসাইট নিয়ে বিশ্বের বৃহত্তম ওয়েবপোর্টাল ‘জাতীয় তথ্য বাতায়ন’ চালু করেছে সরকার। ই-পেমেন্ট ও অনলাইন ব্যাংকিং চালু করা হয়েছে। ই-সেবা, অনলাইন ভর্তি ও অনলাইন টিকেটিং জীবনযাত্রাকে অনেক সহজ করে দিয়েছে। আউটসোর্সিং-এ বাংলাদেশ এখন বিশ্বে চতুর্থ।
উদ্যোগ- ৪ : শিক্ষা সহায়তা কর্মসূচি
বঙ্গবন্ধু যেমনি শিক্ষাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই ৩৬ হাজার ১৬৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করেছিলেন ঠিক একইভাবে শিক্ষাকে মূলধারায় নিয়ে আসার লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ইতোমধ্যে ২৬,১৯৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ১,৪৪,৮৭৬ জন শিক্ষকের চাকরী জাতীয়করণ করেছেন।
২০১৮ সালের ১ জানুয়ারি নবমবারের মতো প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের ৪ কোটি ৪২ লাখ ৪ হাজার ১৯৭ জন শিক্ষার্থীর হাতে বিনামূল্যে তুলে দেয়া হয়েছে ৩৫ কোটি ৪২ লাখ ৯০ হাজার ১৬২ টি বই। ২০০৯ সালে চালু হওয়া এই অভূতপূর্ব ব্যবস্থায় গত ৮ বছরে শিক্ষার্থীদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে ২২৫ কোটি ৪৫ লাখ ১১ হাজার ৭৫০ টি বই ও শিক্ষা উপকরণ। সারাদেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ৩ হাজার ১৭২টি কম্পিউটার ল্যাব স্থাপন করা হয়েছে। ৩১ হাজার ১৩১টি মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাল্টিমিডিয়া ক্লাশরুম স্থাপন করা হয়েছে। ২০১৭-১৮ সালের বাজেটে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে সর্বোচ্চ ৬৫,৬৪৩ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে।
উদ্যোগ- ৫ : নারীর ক্ষমতায়ন
‘জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা ২০১১’ প্রণয়নের মাধ্যমে সর্বক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহনের সুযোগ সৃষ্টি এবং নারীর প্রতি বৈষম্য দূর করার লক্ষ্যে নারী ক্ষমতায়েনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। নারী জনশক্তি-নির্ভর তৈরি পোষাক রপ্তানিতে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ। বেতনসহ মাতৃত্বকালীন ছুটি ৪ মাস থেকে ৬ মাসে উন্নীত করা হয়েছে। সরকারি কর্মকান্ডে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে ৪০টি মন্ত্রণালয়ে জেন্ডার সেনসিটিভ বাজেট তৈরি হচ্ছে।
উদ্যোগ- ৬ : ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ
জাতীয় প্রবৃদ্ধি অর্জন, দারিদ্রবিমোচন, ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠন এবং দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের অন্যতম চালিকাশক্তি বিদ্যুৎ। ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দায়িত্ব গ্রহণকালে বিদ্যুতের উৎপাদন ছিল ৪৯৪২ মেগাওয়াট, বর্তমানে যা ১৫৩৫১ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। স্থাপিত হয়েছে ৮১টি নতুন প্লান্ট।
উদ্যোগ- ৭ : কমিউনিটি ক্লিনিক
সারাদেশে ১৩,১৩৬টি কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে গ্রামের সুবিধাবঞ্চিত দরিদ্র মানুষকে বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা হচ্ছে। এখান থেকে সাধারণ রোগের চিকিৎসার জন্য ৩০ প্রকারের ওষুধ সরবরাহ করা হয়ে থাকে। প্রতি ৬০০০ মানুষের জন্যে একটি কমিউনিটি ক্লিনিক থাকার কথা। এই হিসেবে চাহিদার আলোকে বিভিন্ন স্থানে নতুন নতুন কমিউনিটি ক্লিনিক গড়ে উঠছে।
উদ্যোগ- ৮ : সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসুচি
অক্ষম, অসচ্ছল ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষকে একটি নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে এনে তার আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ঘটানো এ উদ্যোগের মূল লক্ষ্য। সরকার ইতোমধ্যে ২৮টি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ১৪২টি সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে এ সকল কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য প্রায় ২৪,০১৫ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
উদ্যোগ- ৯ : বিনিয়োগ বিকাশ
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দায়িত্ব নিয়েই দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার জন্য বেশকিছু যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। এ লক্ষ্যে বিভিন্ন দেশে সফর করছেন। তাঁর শক্তিশালী কুটনৈতিক সক্ষমতার মাধ্যমে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে চীনের ৩৭ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রæতি আদায় করেছেন। পাশাপাশি জাপানের ৬ বিলিয়ন ডলারের বিষয়টি তো আছেই।ইতোমধ্যে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার কাজ দ্রæত এগিয়ে চলেছে। অধিকতর প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে ‘রূপকল্প-২০২১’-এর আওতায় বৈদেশিক বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা ৫.৪ বিলিয়ন ডলার নির্ধারণ করা হয়েছে।
উদ্যোগ- ১০ : পরিবেশ সুরক্ষা
২০০৬ সালের শতকরা ৭.৮ ভাগ থেকে ২০১৬ সালে বনভূমি প্রায় শতকরা ১৭.৬২ ভাগে বিস্তার ঘটানো সম্ভব হয়েছে। ইটভাটায় সনাতন প্রযুক্তির ১২০ ফুট চিমনি নিষিদ্ধ করে এ পর্যন্ত দেশের প্রায় ৪৯.৮৪ ইটভাটাকে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তিতে রূপান্তর করা হয়েছে। দেশের দুই শতাধিক শিল্প কারখানায় বর্জ্য শোধনাগার প্লান্ট বা ইটিপি স্থাপন করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষেত্রে তাঁর সুদূরপ্রসারী উদ্যোগের জন্য জাতিসংঘ ‘চ্যাম্পিয়ন অব দ্য আর্থ ২০১৫’ পুরস্কারে ভূষিত করেছে।
বিশেষ উদ্যোগ : মৌলভীবাজার প্রেক্ষিত
অপরূপ নৈসর্গিক সৌন্দর্যে লীলাভূমি মৌলভীবাজার জেলা প্রবাসী অধ্যুষিত হলেও এর বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে হাওড়, চা বাগান ও পাহাড়ী এলাকা থাকায় এখানে দারিদ্র্যের হার ২৫.৭ শতাংশ। দারিদ্র দূরীকরণে জেলার ৭টি উপজেলার ৬৭টি ইউনিয়নে ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্পের আওতায় ৮১৯টি সমিতি গঠন করা হয়েছে, যেথানে উপকারভোগীর সংখ্যা ৩৯২৮৩ জন। সমবায়ীদের সঞ্চয় দাঁড়িয়েছে প্রায় কোটি টাকা।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৫ সালের সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী মৌলভীবাজার জেলায় বর্তমানে শিক্ষার হার ৬১.০২ শতাংশ, জাতীয় পর্যায়ে এই হার ৬৩.৬ শতাংশ। জেলার মাধ্যমিক পর্যায়ে ২৪৮টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাল্টিমিডিয়া ক্লাশরুম, ২৭টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব ও ৮টি আইসিটি লার্নিং সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে ১১৮টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাল্টিমিডিয়া ক্লাশরুম স্থাপন করা হয়েছে।
মৌলভীবাজার জেলায় বিদ্যুতের কভারেজ প্রায় ৮০ শতাংশ। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে মৌলভীবাজার সদর উপজেলা ও শ্রীমঙ্গল উপজেলাকে শতভাগ এবং ২০১৭ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে পুরো জেলাকে শতভাগ বিদ্যুতায়নের আওতায় আনার পরিকল্পনা রয়েছে। সদর উপজেলার একাটুনা ইউনিয়নকে ইতিমধ্যে শতভাগ বিদ্যুতায়নের আওতায় আনা হয়েছে।
সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে ৪৫২৭২ জনের মধ্যে বয়স্ক ভাতা, ১৩৩২১ জনের মধ্যে বিধবা ও স্বামী নিগৃহিতা ভাতা, ১৩৪০৬ জনের মধ্যে অস্বচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতা, ১০৫৪ জনের মধ্যে প্রতিবন্ধী শিক্ষা উপবৃত্তি, ১৭ জনের মধ্যে হিজড়া ভাতা, ২১ জনের মধ্যে হিজড়া শিক্ষা উপবৃত্তি, ৩৩৫ জনের মধ্যে বেদে, দলিত ও নিগৃহীত ভাতা, ১০৯ জন বেদে, দলিত ও হরিজনের মধ্যে শিক্ষা উপবৃত্তি প্রদান করা হয়েছে। গত ছয় বছরে ক্যান্সার, কিডনী, লিভার সিরোসিস ও স্ট্রোকে প্যারালাইজড ২৯৮ জন দুঃস্থ রোগীর মধ্যে জনপ্রতি পঞ্চাশ হাজার টাকা করে প্রদান করা হয়েছে। চা শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে ৩৯৪৬০ জন চা শ্রমিকের মধ্যে মাথাপিছু পাঁচ হাজার টাকা মূল্যের খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে। ভিজিডি কর্মসূচির আওতায় জেলার ১০ হাজার ৩০০ জন দুঃস্থ মহিলার মধ্যে জনপ্রতি ৩০ কেজি করে চাল প্রদান করা হয়েছে। এ ছাড়া ১৯০০ জন কর্মজীবী ল্যাকটেটিং মা এবং ৭১৬৯ জন গর্ভবতী মায়ের মধ্যে মাতৃত্বকালীন ভাতা প্রদান করা হয়েছে।
প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে জেলায় ১৭৫টি কমিউনিটি ক্লিনিক কাজ করছে। ২০১১ সালের নভেম্বরে জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব বান কি মুন কুলাউড়া উপজেলার মোবারকপুর কমিউনিটি ক্লিনিক পরিদর্শন করতে এসে এর ভূয়সী প্রশংসা করেন। এ ছাড়া জুড়ী উপজেলার ভোকতেরা কমিউনিটি ক্লিনিক এবং সদর উপজেলার সাধুহাটি কমিউনিটি ক্লিনিক জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ট্রত্বের স্বীকৃতি পেয়েছে। চাহিদানুযায়ী জেলায় আরো ২২টি কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে।
মৌলভীবাজার জেলায় সম্প্রতি উদ্বোধন হয়েছে বাংলাদেশের দ্বিতীয় চা নিলাম কেন্দ্র ও উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন রাবার কাঠ ট্রিটমেন্ট প্রকল্প। মৌলভীবাজারের বিশাল বনভূমি পরিবেশ সুরক্ষার ক্ষেত্রে জাতীয় পর্যায়ে এক অনবদ্য অবস্থানে রয়েছে। বৃক্ষ রক্ষায় কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যত্যয় ঘটলেও লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, মাধবকুন্ড ও বর্ষিজোড়া ইকো পার্ক, রাজকান্দি, পাথারিয়া ও ভাটেরা হিল রিজার্ভ, বিস্তীর্ণ চা বাগান এবং ব্যক্তি পর্যায়ে বসতবাড়ী বনায়ন সবকিছু মিলে মৌলভীবাজার যেন এক সবুজের সমারোহ।
যুদ্ধ যেখানে দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে :
বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন,‘‘আমার দেশের প্রতিটি মানুষ খাদ্য পাবে, আশ্রয় পাবে, শিক্ষা পাবে, উন্নত জীবনের অধিকারী হবে- এই হচ্ছে আমার স্বপ্ন।’’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্পষ্টই বলেছেন,‘‘আমরা শত্রæকে পরাজিত করে, যুদ্ধ করে বিজয় অর্জন করেছি। এখন আমাদের যে যুদ্ধ সেটা হচ্ছে- দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে, বাংলাদেশকে আমরা দারিদ্রমুক্ত করতে চাই।’’
তাই আমরা দেখতে পাই ব্রান্ডিংয়ের জন্যে নির্ধারিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দশটি বিশেষ উদ্যোগ দারিদ্র বিমোচনকে কেন্দ্র করেই যেন আবর্তিত হয়েছে। রূপকল্প ২০২১ এর মূল লক্ষ্য চরম দারিদ্র সম্পূর্ণভাবে বিমোচিত করা। রূপকল্প ২০৪১ বলছে দারিদ্র শূণ্যের কোটায় নামিয়ে আনার কথা। অর্থাৎ তিনটি পরিকল্পনাই তৈরি হয়েছে দরিদ্র মানুষেকে ঘিরে, দারিদ্র দূর করার প্রত্যয় নিয়ে-এ যেন মুক্তিযুদ্ধের পরে আরও এক যুদ্ধে সামিল হয়েছি আমরা সবাই।
চ্যালেঞ্জ যেখানে:
দারিদ্র আমাদের প্রথম সমস্যা এবং তা দূরীকরণে যে কোন বৃহৎ কর্মসূচি বাস্তবায়নে অর্থের যোগান দেয়া প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে প্রথম থেকেই চিহ্নিত হয়ে আসছে। অধিক জনসংখ্যা এবং শিক্ষায় অনগ্রসরতা এখনও আমাদের উন্নয়নে বাঁধা হয়ে আছে। নারীর ক্ষমতায়নে বাল্যবিবাহ ও যৌতুক প্রতিনিয়ত প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে।
দূর্ভাগ্যবশতঃ প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমাদের জীবনের অনুসঙ্গ হয়ে উঠেছে। তাই জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিরোধ বাংলাদেশের জন্যে সবসময় একটি বড় চ্যালেঞ্জ। দেশে বিদ্যমান বেকারত্ব আরেকটি বড় সমস্যা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী দেশে এখন কর্মক্ষম ২৬ লাখ মানুষ বেকার। বিশ্বব্যাংক অবশ্য বলছে, বেকারের সংখ্যা আরও বেশি। জঙ্গী ও সন্ত্রাসবাদ এবং মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত হতে না পারলে আমাদের স্বাভাবিক অগ্রগতি বাঁধাগ্রস্থ হবে। হাওড়, চা বাগান, চর ও পার্বত্য এলাকাসহ সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর জন্যে সমতাভিত্তিক টেকসই উন্নয়ন পরিকল্পনা এখনও গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। সর্বক্ষেত্রে দূর্নীতি উপড়ে ফেলে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবী।
রূপকল্প ২০৪১ অনুযায়ী উচ্চ আয়ের দেশ হতে হলে বর্তমান ১৬১০ মার্কিন ডলারের বিপরীতে মাথাপিছু আয়ের প্রয়োজন হবে ১২৭৩৬ মার্কিন ডলার। এ প্রসঙ্গে বলা যায় মালয়েশিয়ার সুপারকরিডরের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন কৌশল হতে পারে একটি অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত। ১৯৯১ সালে গৃহীত ৩০ বছর মেয়াদী এই পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২০ সালে মালয়েশিয়া পরিণত হবে একটি উন্নত রাষ্ট্রে। রূপকল্প ২০২১ ও ২০৪১ তাই কেবল গন্তব্য নয়, বরং পরিণত হয়েছে উন্নয়ন সোপানে সামাজিক আন্দোলনের এক মহা অভিযাত্রায়।
এখন শুধুই এগিয়ে যাবার পালা:
২০১২ সালে দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার মধ্য দিয়ে দেশে দারিদ্র্যের হার অতি দ্রæত কমে আসছে। মিয়ানমার ও ভারতের সংগে সমুদ্রসীমার মামলায় জয় পেয়ে বাংলাদেশ প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর বিশাল সমুদ্রসীমার মালিক হয়েছে। এ বøু-ইকোনমিকে কাজে লাগিয়ে সম্পদ উত্তোলন ও দেশের উন্নয়নে তা বিভিন্নভাবে কাজে লাগানোর পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে ভিশন ২০৪১- এ। আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের সংগে বাংলাদেশের কুটনৈতিক সম্পর্ক আরও বাড়ানো হয়েছে। বিশেষ করে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়গুলোকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে বহির্বিশ্বের সংগে নতুন সম্পর্ক স্থাপনে জোর দেয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হচ্ছে। এসডিজির মতো এর সংগে যুক্ত হয়েছে দুর্নীতি কমানো এবং সর্বক্ষেত্রে সুশাসন নিশ্চিত করা।
ক্ষুদ্র দেশের সীমিত সম্পদ দিয়ে এত বৃহৎ জনগোষ্ঠীর কল্যাণ সাধন ও কাঙ্খিত উন্নয়ন সরকারের পক্ষে দুরূহ হলেও তা সম্ভব। জাতিসংঘের এমডিজি পুরস্কারপ্রাপ্ত রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ তা ইতিমধ্যে প্রমাণ করেছে। ২৯ জুন পাস হওয়া এবং ১ জুলাই থেকে কার্যকর হওয়া ২০১৭-১৮ সালের বাজেটে প্রতিটি উদ্যোগের বিপরীতে বরাদ্দ এবং উপকারভোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি তারই শুভ ইংগিত বহন করে।সংবিধানের ১৫ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, একটি দেশের উন্নয়ন লক্ষ্য বাস্তব রূপ দেয়ার জন্য প্রয়োজন পরিকল্পিত অর্থনীতির পথ অনুসরণ করা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ১০টি বিশেষ উদ্যোগ, রূপকল্প ২০২১ এবং রূপকল্প ২০৪১ আমাদের রাষ্ট্রীয় চ্যালেঞ্জ। কোন দেশ তখনই কোন চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে যখন অর্থনৈতিক কাঠামো, শক্তি ও সামর্থে সে নিজেকে যোগ্যতাসম্পন্ন মনে করে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে যে গতিতে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে আশা করা যায় ২০৪১ সালের আগেই উন্নয়ন, অগ্রগতি সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি বাল্যবিবাহ, যৌতুক, জঙ্গী ও সন্ত্রাসবাদ ও দারিদ্রমুক্ত উন্নত বাংলাদেশ গড়ে উঠবে- এই প্রত্যাশা এবং বিশ্বাস আমাদের সকলের।