ভিক্ষাবৃত্তিই আমার মুক্তিযুদ্ধের পুরস্কার
প্রকাশিত হয়েছে : ১০ ডিসেম্বর ২০১৫, ৮:৩৬ পূর্বাহ্ণ
মো. নাজমুল ইসলাম, কুলাউড়া ::
বীর মুক্তিযোদ্ধা সফর আলী একাত্তরে টগবগে তরুণ ছিলেন। দেশমাতৃকার মুক্তির আকাঙ্খায় সেদিন জীবন বাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন মরণপণ সংগ্রামে। মুক্ত স্বাধীন স্বদেশে এখন জীবন বাঁচাতে আজ হাত পাতেন অপরের করুণার আশায়। আর বিড় বিড় করে নিজেকে প্রশ্ন করেন এই কি বিজয়, এই কি স্বাধীনতা?
ভিক্ষাবৃত্তিই আমার মুক্তিযুদ্ধের পুরষ্কার। এই কথা দিয়ে নিজের ভেতরের চাপা ক্ষোভ প্রকাশ করেন সফর আলী।
মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলার পৃথিমপাশা ইউনিয়নের মনরাজ গ্রামের টগবগে যুবক সফর আলী ৬৯’র আন্দোলনমুখর দিনে তৎকালীন মুজাহিদ বাহিনীর চাকুরি ছেড়ে নেমে আসেন রাজপথে। রাজপথের মিছিলে কুলাউড়ার মরহুম সংসদ সদস্য আব্দুল জব্বারের নেতৃত্বে বিভিন্ন মিছিল মিটিংয়ে অংশগ্রহণ করেন। যুদ্ধের আগ মুহুর্তে তিনি দেশ স্বাধীনের পক্ষে স্বক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
বাল্যকালে পিতৃহারা সেদিনের এই টগবগে যুবক মরহুম সমাজকল্যাণ মন্ত্রী সৈয়দ মহসীন আলী, কুলাউড়ার মরহুম সংসদ সদস্য আব্দুল জব্বার, জুড়ী উপজেলা চেয়ারম্যান মরহুম আলহাজ্ব আব্দুল মুমিত আসুক সাহেবের সাথে ৪নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার মেজর সি. আর দত্তের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে সম্মুখ সমরে অংশগ্রহণ করেন তিনি। যুদ্ধে যাওয়ার সময় মা, স্ত্রী, কন্যাসহ পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে বিদায় নেয়ার সময়টুকু পাননি।
৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে অনেক সাথীকে হারিয়ে মাতৃভূমি শত্রুমুক্ত করেছেন। দেশ ও জাতির বিজয় অর্জিত হয়েছে।
১৬ ডিসেম্ভর বিজয়ের ৪৪ বছর পার হচ্ছে এমন সময় তার অনুভূতি জানতে চাইলে কান্নাজড়িত কন্ঠে বীর মুক্তিযোদ্ধা সফর আলী জানান, দেশ স্বাধীনের পরপরই সকল নেতার দ্বারস্থ হয়েছেন তিনি একটি কাজ পাইয়ে দেওয়ার জন্য। তার ভাগ্যে জুটেনি কোন কাজ। শরীরের শক্তি থাকায় দেশ স্বাধীনের পর তিনি রিক্সা চালিয়ে পরিবারের সদস্যদের অন্নের সংস্থান করতেন। অসুস্থ মা চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুবরণ করেছেন।
এখন আর শরীরে শক্তি নেই। স্ত্রী, কন্যাসহ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে প্রায়ই অর্ধাহারে থাকতে হয়। মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাষ্ট থেকে ২ হাজার টাকা ভাতা প্রদান করা হয়। এই ভাতার টাকায় সংসার চলে না, নিজের কোন বাড়ি ভিটে নেই। শ্বশুড় বাড়ির একখন্ড জমিতে যাযাবরের মত তাকে দিনাতিপাত করতে হয়।
বর্তমানে তিনি কুলাউড়া উপজেলার কাদিপুর ইউনিয়নের মনসুর গ্রামে বসবাস করছেন। প্রতিনিয়ত মানুষের করুণার পাত্র হয়ে তাকে হাত পাততে হয়। মৃত্যুর পর রাষ্ট্রীয় সম্মানে সমাহিত করার চেয়ে তাঁর কাছে এ মুহুর্তে নিয়মিত দুমুঠো অন্নই চাহিদা। জীবনের শেষ বয়সে অসুস্থ এই বীর মুক্তিযোদ্ধার ডান হাতটি পঁচে পড়ার উপক্রম। সরকারি স্বাস্থ্য কেন্দ্রে তাকে দেখা হয় অবহেলিত চোখে, ঔষুধ সরবরাহ করা হয় মাত্র ৩ টাকার।
এই মুহুর্তে তার আর্তি মাথা গুজার একটু স্থান, নিয়মিত দুমুঠো ভাত খেয়ে জীবনের শেষ সময়ে একটু শান্তিতে মৃত্যুবরণ করা।