সাইফুরের মৃত্যু স্বাভাবিক ছিলো না …
প্রকাশিত হয়েছে : ৩১ অক্টোবর ২০১৫, ১১:৫১ পূর্বাহ্ণ
তমাল ফেরদৌস ::
কিছু মানুষ চলে গেলে তার বিকল্প আর খুঁজে পায়না জাতি। হারালেই তাদের কদর আমরা বুঝতে পারি। এসব ক্ষণজন্মা মানুষ আলোচনা সমালোচনায় মুখর থাকেন সারা জীবন। আমাদের দুর্ভাগ্য যে, আমরা তাদের শেখানো পথ ধরেও হাঁটতে পারি না। মহান ¯্রষ্টা কিন্তু এদের দিয়ে আমাদের ভাগ্যের পরিবর্তন করে থাকেন। এমনিই একজন মানুষ ছিলেন আমাদের প্রয়াত অর্থমন্ত্রী, বিএনপির নীতি-নির্ধারক এম সাইফুর রহমান বস্তু মিয়া।
সদা সহজ সরল অভিব্যক্তি তার মুখে লেগে থাকতো। তিনি যে কতো প্রতিভায় প্রতিভাবান ছিলেন তা লিখে শেষ করা যায় না বা প্রকাশ করা যায় না। আপাদমস্তক এই মানুষটি জীবনকে উপভোগ করেছেন খুবই সাধারণ নিয়মে। তার সমগ্র চিন্তা-চেতনায় ছিলো দেশপ্রেম আর সমাজের বঞ্চিত ও নীপিড়িত জনগোষ্ঠীর কল্যাণ। তার জীবদ্দশায় সিলেট বিভাগের যে উন্নয়ন করে গেছেন তা আর কেউ করতে পারবেন কিনা সন্দেহ রয়েছে।
তার মৃত্যুটি ছিলো আমার কাছে একটি অস্বাভাবিক বিষয়। স্বাভাবিক মৃত্যু বলে আমার কাছে মনে হয়নি কোনসময়। আমি সাংবাদিক হিসেবে হয়তো বিষয়টিকে নিয়ে একটু বেশিমাত্রায় ঘাটাচ্ছি। এই ঘাটানোর অনেক যৌক্তিক কারণও রয়েছে। আমি আগেও অনেকবার এই কথাটি লিখেছি বিভিন্ন লেখায়। কারণ এখনও তার মৃত্যু নিয়ে অনেকের মনে নানা প্রশ্ন রয়েছে।
যেদিন তার মৃত্যু হয় সেদিন ছিলো শনিবার। তিনি বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় তাকে বহন করা জীপ গাড়িটি ঘরের সম্মুখের সিঁড়ির সাথে ধাক্কা খায়। এরপরও তিনি ঢাকার পথে রওয়ানা দেন। আশুগঞ্জের খড়িয়ালা নামকস্থানে তার জীপটি দুর্ঘটনায় পতিত হয়। জীপে থাকা অন্যান্য সব যাত্রী যার যার আসন থেকে বের হলেও তিনি বেরুতে পারেন নি এবং তাকে জীপের যাত্রী কেউই বের করে নিয়ে আসেন নি। পরবর্তীতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সিলবেল্ট কেটে বের করে কুমিল্লায় হাসপাতালে নিয়ে যায়। এর আগেই তার অকাল মৃত্যু হয়।
আপনি কি ভাবতে পারেন তার মতো একজন বর্ষিয়ান নেতার এমন করুণ মৃত্যু হবে। তার সময়ে এদেশের অর্থনীতির চাকাগুলো তার ঈশারায়ই ঘুরতো। কিন্তু তার মৃত্যুকে নিছক একটি দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে। কোন তদন্ত হয়নি, বিএনপির কেউই এনিয়ে কোন কথা বলেন নি। সবাই চুপ থেকেছেন। রাজনৈতিক বক্তব্যও আসেনি কারো কাছ থেকে। এরও ব্যাপক ব্যাখ্যা রয়েছে। যা হয়তো খুঁজলে পাওয়া যাবে। যার বদৌলতে দেশ ও সমাজ উপকৃত হলো তার মৃত্যু নিয়ে কোন সাড়া-শব্দ হয়নি। আমি নির্দ্বিধায় বলতে পারি সুষ্ঠু তদন্ত হলে তার মৃত্যুর আসল রহস্য বের হয়ে আসবে।
এম সাইফুর রহমান শুধু বিএনপির একজন নেতাই ছিলেন না, ছিলেন দলের চেয়ারপার্সনের কাছে সর্বোচ্চ গুরুত্বপ্রাপ্ত একজন ব্যক্তি। তার প্রমাণ তিনি সংষ্কারপন্থী গ্রুপে যাওয়ার পরও বেগম খালেদা জিয়া তাকে দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে রেখেছিলেন। কারণ তার বিকল্প সারা বিএনপিতে নেই। তার বিদেশীদের (পররাষ্ট্রনীতি) সাথে লবিং ছিলো ঈর্ষণীয়। তিনি ভারত, চীন বলেন আর আমেরিকাই বলেন। সবার সাথে সমান তালে কূটনৈতিক সম্পন্ন স্থাপনে ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী একজন। তার মেধা ও প্রজ্ঞার ধারে কাছেই কেউ যেতে পারেন নি। রাজনীতির মারপ্যাঁচেও তিনি ছিলেন দক্ষ একজন কারিগর। তার কারিগরীতে নিজ দল কিংবা বিরোধীদলের বাঘা বাঘা নেতা ধরাশায়ী হতেন। এটি ছিলো একটি অন্যতম প্রধাণ কারণ কুতুবদের রোষানলে পড়ার।
তিনি সিলেট বিভাগের উন্নয়নের জন্য মরিয়া হয়ে লেগে থাকতেন। একারণে দেশের অন্যান্য জেলা ও বিভাগ উন্নয়ন বঞ্চিত থাকতো। সিলেটের রাস্তাঘাট, শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে শুরু করে প্রান্তিক পর্যায়ে উন্নয়নের ছোঁয়া লাগে তার হাত ধরে। একসময় তিনি সবার চক্ষুশূল হয়ে ওঠেন। তাকে দমানোও যায়না আবার দমার মানুষও নন তিনি। একারণে দেশের কুতুবরা একপক্ষে এবং তিনি একা অন্যপক্ষে চলে যান স্বাভাবিকভাবে।
সংসদ বলুন আর দলীয় স্থায়ী কমিটির সভা-ই বলুন? সবখানেই তার জয়জয়কার আর তার নেওয়া সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়িত হতো। তাকে টপকিয়ে কেউ যাওয়ার মেধা ছিলো না। তাই বিকল্প পন্থা অবলম্বন করা হয়েছে তাকে একেবারেই দমাতে। তাই তিনি দলের কেন্দ্রীয় কুতুবসহ বিরোধীদের কুনজর ও রোষানলে পড়েন। এটিও আরেকটি অন্যতম কারণ ছিলো কুতুবদের রোষানলে পড়ার।
একটু ভাবলেই বুঝবেন যারা সৎ, নিষ্ঠাবান ও মেধাবী ব্যক্তিরা একটু সরাসরি কথা বলতে ভালবাসেন। আমরা তাদের সমালোচনা করতে কোনভাবেই ধৈর্য্যের পরিচয় দেই না। কিন্তু তাদের আবিষ্কার বা আমাদের সমাজের জন্য যে আর্শীবাদগুলো রেখে যান তা আমরা অবলীলায় ভোগ করি। আমরা জানি সুশিক্ষিত মানুষরা আতœকেন্দ্রীক হয়। আর স্বশিক্ষিত মানুষরা আত্মকেন্দ্রীক নয়। কিন্তু সাইফুর ছিলেন প্রকৃত শিক্ষিত একজন ব্যক্তি, তিনি আত্মকেন্দ্রিক নয়। তাই তিনি নিজের চিন্তাভাবনা, পরিকল্পনা দেশ ও এলাকার উন্নয়ন নিয়ে বিলিয়ে দিয়েছিলেন।
এম সাইফুর রহমানের সাথে আবার সমাজকল্যাণমন্ত্রী সৈয়দ মহসীন আলীর হৃদ্যতা ও ঘনিষ্টতা ছিলো খুব। দুজনের রাজনৈতিক পরিচয় ছিলো ভিন্ন কিন্তু জেলার উন্নয়নে দুজনের পরিকল্পনা ও চিন্তাভাবনা ছিলো অভিন্ন। তারা দুজনই মানুষের উন্নতি সমাজের উন্নতির কথা ভেবেছেন আজীবন। তাদের জীবতাবস্থায় হয়তো আমরা কেউ তাদের বুঝতে পেরেছি আবার অনেকেই বুঝিনি।
এম সাইফুর রহমান ও সৈয়দ মহসীন আলী এই দুজনের মৃত্যুর পর আমরা হারালাম অভিযোগ নিয়ে যাবার জায়গা বা সুযোগ গ্রহণ করার জায়গাটা। এজেলার মানুষ এখন অনেকটা অভিভাবকশুণ্য হয়ে গেলো।