গণ মানুষের কবি দিলওয়ার
প্রকাশিত হয়েছে : ১০ অক্টোবর ২০১৫, ৬:০৪ অপরাহ্ণ
তমাল ফেরদৌস:
মন, মগজে, চিন্তা-চেতনায় বাঙালিকে লালন ও ধারণ করা। সর্বোপরি সাধারণ মানুষকে ধারণ করে যিনি লিখে যেতেন। জাতি-জ্ঞাতি, ধর্ম-বর্ণ তথা যেকোন বৈষম্যের উর্ধ্বে ওঠে তিনি ত্যাগ করেছিলেন তার পূর্ব পুরুষের পদবি খাঁন। অতি উচ্চ শিক্ষিত ছিলেন না বলেই হয়তো তিনি আত্মকেন্দ্রিক না হয়ে হয়েছিলেন সকলের। সাংবাদিকতা, শিক্ষকতা, অনুবাদক, মুক্তি সংগ্রামী, দেশপ্রেম, আধ্যাত্মিকতা, কাব্যিকতা, প্রগতিশীলতা ও মানবিকতায় তিনি ছিলেন অনন্য। তিনি হলেন বাংলা একাডেমী ও একুশে পদকপ্রাপ্ত গণ মানুষের কবি দিলওয়ার।
কবি দিলওয়ার আজ আমাদের মাঝে স্বশরীরে নেই তবে তার অজ¯্র সৃষ্টিকর্মে তিনি আমাদের মাঝেই ঠাঁই নিয়েছেন। তার পুরো নাম দিলওয়ার খাঁন। পিতা মরহুম মোহাম্মদ হাসান খাঁন ও মাতা মরহুম মোছাম্মাৎ রহিমুন্নেসা। ৮ ভাই বোনের মধ্যে তিনি ৭ম। জন্ম আধ্যাত্মিক নগরী সিলেটের সুরমা নদীর তীরবর্তী ভার্থখলা নামক স্থানের খাঁন মঞ্জিলে ১৯৩৭ সালের ১লা জানুয়ারি এবং একই স্থানে ২০১৩ সালের ১০ অক্টোবর তার মৃত্যু হয়। তার দুই স্ত্রী ছিলেন আনিসা দিলওয়ার ও ওয়ারিশা দিলওয়ার। ১৯৬০ সালে তিনি আনিসা খাতুনের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন এবং ১৯৭৫ সালে পতœীবিয়োগ হলে তিনি ওয়ারিশাকে বিয়ে করেন।
শুরুতেই গণমানুষের একান্ত কাছাকাছি চলে আসার পেছনে তাঁর জাগ্রত বিবেকবোধ দিয়ে হয়তো অনুভব করেছিলেন। তাইতো কবির লিখা কবিতায় সমাজ ও মানুষের কথা বেশি বেশি করে ওঠে এসেছে। তিনি তাঁর লিখায় উদারতা, সহজ-সাবলিল শব্দচয়ন, আধুনিক কবিতার অন্তমীল, গণমানুষের কল্যাণ, দেশাত্ববোধ, স্থানীয় সংস্কৃতির অভিব্যক্তি, অন্যায়-অবিচার, আগাগোড়া বাস্তবতার নিরিখে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। আমরা তার লিখনি হতে অনেক উপাদান পাই যা আমাদেরকেই এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
তার জীবনী ও লেখালেখির বিভিন্ন গ্রন্থ ঘাটালে জানা যায়, ১৯৪৯ সালে ১২ বছর বয়সে প্রাচীনতম দৈনিক ‘যুগভেরী’তে ‘সাইফুল্লাহ হে নজরুল’ কবিতাটি প্রকাশিত হয়। অনেক লেখকই মনে করেন যে, তার লেখনি ও চর্চায় কবি নজরুলের জীবন ও লেখার একটা সাদৃশ্য ও প্রভাব পাওয়া যায়। ১৯৫৩ সালে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘জিজ্ঞাসা’ প্রকাশিত হয়। তাঁর ঘনিষ্টজন লেখক ও শিক্ষাবিদ আব্দুল খালিক, কথা সাহিত্যিক আকমল হোসেন নিপু, কবি আহমদ সিরাজ প্রমুখের লেখনি ও বিভিন্ন সময়ে আলাপচারিতা থেকে অনেক কিছুই জানা যায়। লেখক ও শিক্ষাবিদ আব্দুল খালিক এর পথের পাঁচালী উপন্যাসে শিক্ষা প্রসঙ্গ ও বিবিধ চিন্তা বই থেকে জানা যায়, কবির লিখনি সফল, সার্থক ও সৃজনশীল। পঞ্চাশের দশকের প্রথমদিকে কবি দিলওয়ারের কবিতায় বায়ান্ন পরবর্তী আমাদের সাহিত্য সংস্কৃতিতে সামন্তবাদ বিরোধী, মুক্তিয্দ্ধু ও প্রগতিশীল মানবতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনাপ্রসূত ধারার কাব্য সৃষ্টির প্রবণতা লক্ষণীয়।
আমার সাথে কবির পরিচয় ও কথা হয় ২০০০ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার সাপ্তাহিক ধলাই পত্রিকা অফিসে। তখন থেকে যতটুকু দেখেছি ও জেনেছি কবি দিলওয়ার একজন সাধারণ ঘরাণার মানুষ ছিলেন। তার চেতনা ও লালিত স্বপ্নগুলোও ছিলো সাধারণ মানের। তিনি প্রকৃতিকে লালন করতেন মনেপ্রাণে। তার কাব্যচর্চায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ দুই ক্ষেত্রেই প্রকৃতির প্রভাব রয়েছে। এছাড়া নিরলস অধ্যয়ন, অধ্যাবসায়, জগৎ ও জীবন এবং সর্বোপরি জীবন সম্পর্কে গভীর পাঠগ্রহণ তাকে চর্চায় এগিয়ে নিয়েছে। তিনি অর্ধ-শতাধিক বছর কাব্যচর্চা করেছেন। কবিতা, ছড়া, গান, গল্প ও প্রবন্ধ মিলে ২০/২২টি গ্রন্থ তার জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে ঋঅঈওঘএ ঞঐঊ গটঝওঈ নামে তার একটি ইংরেজী কাব্যগ্রন্থও রয়েছে।
তার উল্লেখযোগ্য সাহিত্য সংকলনগুলো হলো, সমস্বর (১৯৬৯-৭৪), উল্লাস (ফেব্রুয়ারি ১৯৭২), মৌমাছি (জুন ১৯৭৫), গ্রাম সুরমার ছড়া (১৯৭৬), মরুদ্যান (জানুয়ারি ১৯৮১), সময়ের ডাক (১৯৮৫), সিলেট পরিদর্শক (প্রধান সম্পাদক ১৯৮৬)। এছাড়া ১৯৬৪ সালে দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ঐকতান, ১৯৬৫ সালে গীতিগ্রন্থ পূবাল হাওয়া, ১৯৬৯ সালে চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ উদ্ভিন্ন উল্লাস,
তিনি ১৯৬৭ সালে দৈনিক সংবাদ পত্রিকার সহকারী সম্পাদক, ১৯৭৩-৭৪ সালে ঢাকাস্থ রুশ সংস্কৃতি কেন্দ্র থেকে প্রকাশিত মাসিক ‘উদয়ন’ পত্রিকার সিনিয়র অনুবাদক, ১৯৭৪ সালে দৈনিক গণকণ্ঠ পত্রিকার সহকারী সহকারী সম্পাদক ও ‘চলমান শব্দাবলী’ নামে কলাম লিখা এবং ১৯৫৬ সালে সিলেটের দক্ষিণ সুরমা হাইস্কুলে দুইমাস শিক্ষকতার চাকুরী করেছেন।
কবি উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেন নি তবে তিনি ১৯৫২ সালে রাজা গিরিশচন্দ্র হাইস্কুল থেকে এসএসসি ও ১৯৫৪ সালে সিলেটের মুঁরারীচাঁদ কলেজ থেকে আইএ পাশ করেন। ১৯৫৭ সালে শারিরিক অসুস্থতার কারণে বিএ পরীক্ষা দেওয়া হয়নি।
তিনি ভারতের আসাম ও ত্রিপুরা থেকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সংবর্ধিত হয়েছেন। এছাড়া ২০০৮ সালে একুশে পদক, ১৯৮০ সালে বাংলা একাডেমী পুরষ্কার, ১৯৮৬ সালে ময়মনসিংহ সাহিত্য সংসদ কর্তৃক আবুল মনসুর সাহিত্য পুরষ্কার, ১৯৯৯ সালে হবিগঞ্জের দেওয়ান গোলাম মোর্তাজা স্মৃতিপদক ও সম্মাননা অর্জন ও ১৯৮৭ সালের ৯ আগষ্ট যুক্তরাজ্য প্রবাসী কর্তৃক লন্ডনস্থ সিলেট সেন্টারে সংবর্ধিত হয়েছেন।
কবি দিলওয়ার ঊণসত্তরের গণআন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ১৯৭০ সালে ‘সমস্বর লেখক ও শিল্পী সংস্থা’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি আত্মগোপনে থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে গ্রামে গ্রামে গিয়ে কর্মী সংগ্রহ ও প্রশিক্ষণ প্রদানে অগ্রজ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭৭ সালে জাতীয় শিশু কিশোর সংগঠন খেলাঘরের সিলেট শাখার সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৬০ সালে তার লেখা ‘তুমি রহমতের নদীয়া’ এই গানটি দিয়ে তৎকালীন রেডিও পাকিস্থানের উদ্বোধন হয়।#