মোহাম্মদ আবু তাহের এড.
সাইফুর রহমান; একজন ক্ষণজন্মা মানুষ ও ব্যতিক্রমী রাজনীতিবিদ
প্রকাশিত হয়েছে : ৫ সেপ্টেম্বর ২০১৫, ১০:১৫ পূর্বাহ্ণ
বাংলাদেশের কিংবদন্তীতুল্য অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক আকাশের উজ্জ্বল নক্ষত্র সাবেক অর্থমন্ত্রী এম. সাইফুর রহমানের ৫ সেপ্টেম্বর ২০১৫ইং ৬ষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী। বাংলাদেশের দীর্ঘতম সময়ের ও সফলতম সাবেক এ অর্থমন্ত্রী ২০০৯ সালের এই দিনে তাঁর প্রিয় জন্মভূমি মৌলভীবাজার এর বাহার মর্দন থেকে ঢাকা যাওয়ার পথে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান। সাইফুর রহমান তাঁর রাজনৈতিক জীবনে ১২বার জাতীয় বাজেট পেশ করে এ উপমহাদেশ তথা গোটা বিশ্বে রেকর্ড সৃষ্টি করেন। তিনি বাংলাদেশের অর্থনীতির ভিতত দাঁড় করিয়ে ছিলেন। দেশের অর্থনীতি ও সামাজিক বিষয়গুলো ছিল তাঁর নখদর্পনে। বাংলাদেশের মত তৃতীয় বিশ্বের একটি দরিদ্র দেশের অর্থনীতিকে শক্ত কাঠামোর উপর দাঁড় করানোর ব্যাপারে তাঁর ভূমিকা ছিল অসামান্য।
বিদেশী সাহায্য ছাড়াও যে দেশ চলতে পারে দেশের উন্নতি হতে পারে সেই ধারনাও দিয়েছিলেন সাইফুর রহমান। বিএনপি’র সাফল্যের সাথে সাইফুর রহমান নামটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। দেশের অর্থনীতিতে তিনি সবচেয়ে বেশি সংস্কার করেছেন। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যে সাফল্য অর্জিত হয়েছে, তার অন্যতম রূপকার তিনি । দেশ প্রেমিক বিশাল হৃদয়ের এই ণজন্মা মানুষ আমাদের ছেড়ে এ পৃথিবী থেকে চলে গেলেও তাঁর কর্মই তাঁকে বাঁচিয়ে রাখবে চিরকাল।
মরহুম সাইফুর রহমান যে এক ব্যতিক্রমী রাজনৈতিক নেতা ছিলেন বৃহত্তর সিলেট তথা দেশের উন্নয়নে নিবেদিত প্রাণ ছিলেন তা দলমত নির্বিশেষে সকল মানুষই স্বীকার করেন। দেশের জন্য দেশবাসীর উন্নয়নের জন্য এমন এক রাজনৈতিক নেতার বর্তমান সময়ে খুবই প্রয়োজন ছিল। তাঁর মত উদারপন্থী বাস্তবতায় বিশ্বাসী সংস্কারবাদী এমন একজন নেতা দেশে প্রায় দুর্লভ।
পৃথিবীতে কখনো কখনো ণজন্মা মানুষের মাঙ্গলিক স্পর্শে সবকিছুই সোনা হয়ে উঠতে পারে। সাইফুর রহমান এর ব্যতিক্রমী জীবন সে সত্যেরই সাক্ষ্য বহন করে। অতুলনীয় মেধার অধিকারী ছিলেন তিনি। বিশ্ব ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে তিনি বাংলাদেশের মুখ পৃথিবীর বুকে উজ্জল করেছেন। সাইফুর রহমান জনকল্যাণে জীবন্ত কিংবদন্তীতে পরিণত হয়েছিলেন। ছাত্রজীবনে সাইফুর রহমান ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। তিনি প্রথমে মৌলভীবাজার পরে সিলেট এম.সি কলেজ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা শেষ করে উচ্চ শিক্ষার জন্য যুক্তরাজ্যে চলে যান। সেখানে তিনি চাটার্ড একাউটেন্ট উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করেন। তারপর তিনি বিএনপি’র প্রতিষ্ঠাতা মরহুম প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সংস্পর্শে এসে বিএনপি-তে যোগদান করে হয়ে গেলেন যথার্থ অর্থেই একজন রাজনৈতিক নেতা। তবে তিনি ছিলেন এক ব্যতিক্রমী রাজনৈতিক নেতা। তিনি ছিলেন একজন মানবতাবাদী নেতা। সাইফুর রহমান এখন আর আমাদের মাঝে নেই। তিনি এখন পরপারে, তিনি এখন না ফেরার দেশে।
তিনি কৃষি ও কৃষকের প্রকৃত বন্ধু ছিলেন। কৃষকরা যাতে তাদের জীবন মান উন্নত করতে পারে তা নিয়ে তিনি ভাবতেন। তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন কৃষিই দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। বস্তিবাসী মানুষের মানবাধিকারের কথাও তিনি বলতেন। যা তিনি ভাবতেন তা তিনি সভা সমিতিতেও বলতেন। শ্রমজীবী মানুষের অধিকারের প্রতিও তিনি ছিলেন অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল। এমন এক বিশাল হৃদয়ের মানুষ তিনি ছিলেন যার গুনাগুণ বলে শেষ করা যাবে না। সত্যিকার অর্থেই তিনি ছিলেন ঈর্ষনীয় একজন সফল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। আমার মত একজন মানুষের পক্ষে তাঁর গুনাগুণ বলে শেষ করতে পারার নয়। অনেক দিনই তাঁর সাথে কথা বলার সুযোগ পেয়েছি। তিনি সব সময়ই পরিচিত মানুষের জীবন যাপনের খোঁজ খবর নিতেন। তিনি প্রবাসীদের খুবই ভালবাসতেন, স্নেহ করতেন এবং প্রবাসীদের দেশে বিনিয়োগ করতে উপদেশ দিতেন।
২০০৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসের একটি ছোট্ট ঘটনা উল্লেখ করতে চাই। আমি তখন লন্ডনে । হঠাৎ শুনলাম সাইফুর রহমান মহোদয় লন্ডনে আসবেন। লন্ডনের হাইড পার্কের একটি বিলাস বহুল হোটেলে উঠবেন। লন্ডনে বসবাসরত কমিউনিটি নেতা ও আমার আত্মীয় জনাব আব্দুল হান্নানকে নিয়ে আমরা হিলটন হোটেল পার্ক লেনে গেলাম। নিজের চোখে দেখলাম দীর্ঘ সময় বিমান ভ্রমন করার পরও তিনি ক্লান্তি বোধ না করে যুক্তরাজ্য প্রবাসী কমিউনিটি নেতৃবৃন্দকে সাক্ষাৎ করার সুযোগ দিলেন। এত বড় মাপের একজন নেতা কোন প্রকার বিশ্রাম ছাড়াই সাক্ষাৎ প্রার্থী অনেক নেতৃবৃন্দের সাথে কথা বললেন কুশল বিনিময় করলেন এবং সকলকে তিনি দেশে বিনিয়োগ করে দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করার পরামর্শ দিলেন। প্রবাসীদেরকে তিনি যে কত ভালবাসতেন তা বলে শেষ করা যাবে না। এমন একজন ব্যতিক্রমধর্মী নেতার অভাব পূরণ হবার নয়।
মানুষের জীবনে জন্ম ও মৃত্যু শ্বাশত। এমন কেউ নেই যাকে মৃত্যু স্পর্শ করবে না। কুরআনে বলা হয়েছে কুল্লু নাফছিন জায়িকাতুল মউত অর্থাৎ প্রত্যেক আত্মা মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে। মানুষ যেমন নিজের ইচ্ছায় এ পৃথিবীতে আসেনি তেমনি নিজের ইচ্ছায় এ পৃথিবী ছেড়ে যেতে পারবে না। তাকে অবশ্যই আল্লাহ্ তা’আলার অমোঘ নিয়তির নির্দেশ মানতে হবে। কিন্তু মানুষ ইচ্ছে করলে মৃত্যুকে জয় করতে পারে। মানুষ চাইলে বেঁচে থাকতে পারে শত শত বছর। আর শত শত বছর বেঁচে থাকতে হলে এমন কিছু কর্ম করে পৃথিবীতে রেখে যেতে হবে যার মাধ্যমে মানুষের মাঝে বেঁচে থাকা যায়। ঠিক তেমনি একজন মানুষ ছিলেন সাইফুর রহমান। তাঁর কর্মময় জীবন ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অনুপ্রেরণা যোগাবে নিঃসন্দেহে। সত্যিকার অর্থেই এক আদর্শ মানুষ ছিলেন তিনি।
মানুষের একটা ক্ষণস্থায়ী জীবন নিয়ে এই পৃথিবীতে আসে এরপর চলে যায়। এই ক্ষণস্থায়ী জীবন অর্থবহ হয় তখনই যখন তার কর্মে সন্তুষ্ট হয় স্বজন, প্রতিষ্ঠান ও দেশবাসী। মূলত মানুষ হচ্ছে তার কর্মেরই যোগফল। মানুষ তার কর্মের মধ্যেই বেঁচে থাকে চিরকাল । সাইফুর রহমান তাঁর কর্মের মাধ্যমে বেঁচে থাকবেন। মহান আল্লাহ পবিত্র কালামে পাকে ঘোষণা করেছেন আল্লাজী খালাকাল মাওতা ওয়াল হায়াতা লিইয়াবলুয়াকুম আইয়্যূকুম আহ্ছানু আমালা অর্থাৎ তিনি সৃষ্টি করেছেন মৃত্যু ও জীবন যেন তিনি তোমাদেরকে পরীক্ষা করতে পারেন কে তোমাদের মধ্যে কর্মে শ্রেষ্ঠ। সাইফুর রহমান এর কথা তাঁর কাজে প্রমাণিত হতো। তিনি বিশ্বাস করতেন জৈবিক গুণ দিয়ে মানুষ হওয়া যায় না। মানুষকে মানুষ হতে হয় কর্ম দিয়ে। সাইফুর রহমান তাঁর কর্ম দিয়েই শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছেন নিঃসন্দেহে বলা যায়। মহান আল্লাহ্ তা’আলা তাঁর সকল সৎকর্মকে কবুল করে তাঁকে জান্নাতুল ফেরদাউস দান করুন। আমীন।